X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

অরক্ষিত ধানমন্ডি লেকে বাড়ছে শঙ্কা

কবির হোসেন
২৬ মে ২০২৩, ১০:০০আপডেট : ২৬ মে ২০২৩, ১০:০০

রাত তখন সাড়ে ৮টা (মঙ্গলবার ১৬ মে), হাল্কা বৃষ্টির সঙ্গে বইছে ঝড়ো বাতাস। কলাবাগান ক্লাব মাঠ ও শেখ রাসেল শিশু পার্কের পেছনের ওয়াকওয়ে দিয়ে হাঁটতেই একেবারে নীরবতা। বৃষ্টির মধ্যেই ওই পথ ধরে হাঁটছেন দুই-একজন। কলাবাগান খেলার মাঠের পাশে অবস্থিত সিটি করপোরেশনের ময়লার ডিপোর পাশ দিয়ে লেকের প্রবেশমুখ। কলাবাগান ক্লাবের পেছন বরাবর লেকের মাঝখানে তিনটি ব্রিজের সংযোগস্থলে গোলচত্বর, আছে বসার জায়গা। ঝড়ের মধ্যেই ওই গোলচত্বরে ১০ থেকে ১৫ জনের একদল তরুণ যার যার মোবাইল ফোনে ব্যস্ত। তাদের কেউ কেউ অনলাইনে টাকা দিয়ে কার্ড (জুয়া) খেলছে। তাদের কয়েকজনকে মাদক সেবন করতেও দেখা যায়।

ওই গোলচত্বরে একই দৃশ্য দেখা যায় গত ১৮ মে বৃহস্পতিবার দুপুরেও। প্রথমে একজনের উপস্থিতি।  কিছুক্ষণের মধ্যে আরও কয়েকজন এসে জড়ো হয়। পর দিন শুক্রবার দুপুরেও সেখানে প্রকাশ্যে মাদক সেবন করতে দেখা যায় একদল তরুণকে।

লেকে নিয়মিত ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের অভিযোগ—  এটি একদিনের দৃশ্য নয়। ধানমন্ডি লেকের আনাচে-কানাচে এই দৃশ্য প্রায় প্রতিদিন দেখা যায়। তারা বলছেন, লেক এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে ছিনতাইকারীদের আনাগোনা রয়েছে।
রবীন্দ্র সরোবরের আশপাশের রাস্তায় প্রায়ই ছিনতাইয়ের শিকার হন ঘুরতে আসা মানুষ

এছাড়া গত বছরের শেষ দিকে, চলতি বছরের জানুয়ারি ও মে মাসে ধানমন্ডি লেক থেকে তিনটি মরদেহ উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। লেকের ভেতরে পর্যাপ্ত সিসিটিভির ব্যবস্থা না থাকায় মরদেহগুলো কীভাবে লেকের পানিতে এলো, তা  শনাক্ত করতে হিমশিম খাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এ অবস্থায় ধানমন্ডি লেককে ঘিরে দিন দিন শঙ্কা বাড়ছে স্থানীয় বাসিন্দাসহ ঘুরতে আসা লোকজনের মাঝে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং অফিসার মোহাম্মদ হিমেল মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অফিসের কাজে প্রায় সময় আমাকে ধানমন্ডি লেকের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। সময় পেলে লেকে একটু জিরিয়ে নেই। আজও (১৮ মে) বেলা ১২টার দিকে লেকের মাঝে এই গোলচত্বরে বসেছিলাম। সেখানে প্রকাশ্যে কয়েকজন তরুণকে মাদক সেবন করতে দেখেছি। শুনেছি, মাঝে মাঝে লেকে নাকি লাশ পাওয়া যায়। আমরা যারা নিয়মিত লেকে আসি, তাদের জন্য এসব অস্বস্তিকর সংবাদ। শুধু তাই নয়, অনিরাপদও।

এর আগেও ধানমন্ডি লেক এলাকায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে আহত  ও নিহতের হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের ১৭ এপ্রিল রাত সোয়া ৮টার দিকে ধানমন্ডি লেক পাড়ে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আহত হন দুই শিক্ষার্থী।  একই বছরের ২২ অক্টোবর সন্ধ্যার পর কলাবাগান থানার ১৯/নর্থ সার্কুলার রোডের বাসিন্দা মেরিন ইঞ্জিনিয়ার শাহাদত হোসেন ধানমন্ডি লেকে হাঁটাহাঁটির জন্য আসেন। পরে রাত আড়াইটার দিকে রবীন্দ্র সরোবর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তার শরীরে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিল। এ ঘটনার পরদিন শাহাদতের স্ত্রীর বড় ভাই শফিউল আজম চৌধুরী বাদী হয়ে ধানমন্ডি থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাত পরিচয়ের ছিনতাইকারীদের আসামি করা হয়।

রাতের বেলা লেক-সংলগ্ন এলাকায় নেই কোনও নিরাপত্তা ব্যবস্থা এ ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেফতারও করে ধানমন্ডি থানা পুলিশ।

এর আগের বছরের ৩ জুন সন্ধ্যায় ধানমন্ডি লেকের রবীন্দ্র সরোবর এলাকায় তিন শিক্ষার্থীকে ছুরিকাঘাত করে ছিনতাইকারীরা।

ধানমন্ডি লেকে চলাচলকারী ডিঙি নৌকার ব্যবস্থাপক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে  দায়িত্ব পালন করে আসছেন আরিফ হোসেন শুভ। তার ভাষ্য, লেকের নির্দিষ্ট  এলাকায় তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নিরাপত্তাকর্মী নিয়োজিত আছে। তিনি বলেন, ‘লেকের সব জায়গা যে নিরাপদ তা বলবো না। রাতের বেলায় লেকের দক্ষিণ পাশে ও পুরনো জাহাজ বাড়ির সামনে প্রায়ই ছিনতাই হয়।’ আরিফ হোসেন শুভ বলেন, ‘কিছু কিছু বিষয়ে আমাদের ভয় বাড়ছে। যেহেতু আমরা এখানে কাজ করি। কোনও অঘটন ঘটলে প্রথমে আমাদেরই জিজ্ঞাসাবাদ করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মাঝে মধ্যে লেকে মরদেহ পাওয়া যাচ্ছে। এসব নিয়ে তো আতঙ্কে থাকতে হয়।’

নাম প্রকাশ না করে লেকের একজন ভ্রাম্যমাণ হকার বলেন, ‘কিছু তো ঝামেলা আছেই। আমরা তো সব কথা বলতে পারি না। মাঝে মধ্যে ঝামেলা হয়। বিশেষ করে তরুণদের মাঝে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মারামারি লাগে। এছাড়া বড় ধরনের কোনও ঝামেলা আমার চোখে পড়েনি।’

সন্ধ্যার পর বা রাতে লেকপাড়ের ওয়াক-ওয়েগুলো পথচারীদের জন্য মোটেও নিরাপদ নয় ধানমন্ডি থানার পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে গত এক বছর ধরে লেকে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে আসছেন ডিএমপির মিরপুর জোনের পুলিশ কনস্টেবল আব্দুর সবুর। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত  রবীন্দ্র সরোবরে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। আব্দুর সবুর বলেন, ‘লেকে কিছু উঠতি বয়সী স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী এসে বেশিরভাগ সময় ঝামেলা বাধায়। সামান্য কিছু নিয়ে দুই পক্ষের মারামারি লেগে যায়। ওদের জন্য মাঝে মধ্যে লেকে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তবে আমাদের নির্দেশ দেওয়া আছে, স্কুল ড্রেস পরা কোনও শিক্ষার্থীকে যেন লেকে অবস্থান করতে না দেওয়া হয়।’

লেকের নিরাপত্তার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নারী নিরাপত্তা প্রহরীরা সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত লেকের বিভিন্ন এলাকায় দেখভাল করেন। এ ছাড়া পুলিশের একটি টিম সকাল থেকে রাতে দোকানপাট বন্ধ হওয়া পর্যন্ত রবীন্দ্র সরোবরের পাশে অবস্থান করে। ধানমন্ডি ফাঁড়ির পুলিশও টহলে থাকে আশপাশের রাস্তায়। তবে রাতে লেকের ভেতরের দিকে নিরাপত্তার কোনও ব্যবস্থা থাকে না। জানা গেছে, সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় লেকে কোনও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই।

জানতে চাইলে ধানমন্ডি লেকের উন্নয়ন কাজের নকশাকারী স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘আমরা যেভাবে লেকটি নিয়ে পরিকল্পনা করেছিলাম, সে অবস্থা এখন আর  নেই।’

তিনি বলেন, ‘লেক হচ্ছে বিনোদনের জায়গা। সেটি বর্তমানে বাণিজ্যকরণ হয়েছে। পুঁজিবাদী করা হয়েছে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল— লেকের মাধ্যমে যা আয় হবে, সবটুকু লেকের উন্নয়নের কাজে ব্যয় করা হবে। এখন আর এ নীতিতে চলছে না। লেক পরিচালনা করছে সিটি করপোরেশন। অথচ এখানে তাদের নিজস্ব কোনও সিকিউরিটি নেই। সেখানে অপরাধ তো বাড়বেই।’
মাদকসেবী ও বখাটেদের কারণে লেকে বেড়াতে আসা লোকেরা প্রায়ই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন

সংশ্লিষ্টরা জানান, রাত ১০টার মধ্যে লেকের দোকানপাট বন্ধ করে দেন ব্যবসায়ীরা। তবে সাধারণ মানুষের জন্য লেকে প্রবেশের সুনির্দিষ্ট কোনও সময় সীমা না থাকায় সারা রাতই মানুষের চলাচল থাকে।  গভীর রাতেও লেকের ভেতরে অনেককে ঘুরাঘুরি করতে দেখা যায়।

এ বিষয়ে ধানমন্ডি থানার ওসি মো. ইকরাম আলী মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘লেকটি দেখভালের দায়িত্বে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। থানা এলাকা হিসেবে আমরা আছি নিরাপত্তার দায়িত্বে। ধানমন্ডি লেকে চারদিক থেকে অবাধে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে। সুতরাং, যে যেখান দিয়ে পারে, সেভাবে ঢুকছে। ফলে অপরাধীরা সুযোগটি নিচ্ছে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে যে মরদেহগুলো লেক থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, সেগুলোকে ‘আত্মহত্যা’ বলে আমরা ধারণা করছি।

লেকের নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির রমনা বিভাগের ধানমন্ডি অঞ্চলের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. ইহসানুল ফিরদাউস  বলেন, ‘আমি গত দুই বছর ধরে এ এলাকায় কাজ করেছি। এসব বিষয়ে বহু অভিযান চালিয়েছি। অনেক ছিনতাইকারী ও সন্ত্রাসীকে গ্রেফতারও করেছি। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর, রায়েরবাজার, লালবাগ ও বছিলা থেকে কিছু উচ্ছৃঙ্খল তরুণ আসে, মূলত তারাই লেকের বাইরে ও ভেতরে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে এ চক্রের অনেককে আমরা গ্রেফতার করেছি।’

লেকের দেখভালের দায়িত্ব ডিএসসিসির হলেও রাতের বেলা লেক এলাকার পাহারার জন্য তাদের কোনও নিরাপত্তাকর্মী নেই তিনি আরও বলেন, ‘ধানমন্ডি লেকের সব জায়গায় সিসিটিভির ব্যবস্থা নেই। ফলে অনেক সময় প্রকৃত ঘটনা শনাক্ত করতে বাধাগ্রস্ত হই। চলতি মাসে লেকে যে মরদেহটি পাওয়া গেছে, তাকে আশপাশে অস্বাভাবিকভাবে ঘুরতে দেখা গেলেও প্রকৃতপক্ষে কীভাবে তিনি লেকের পানিতে পড়লেন, সেটা কিন্তু আমরা খোঁজে পাইনি। যেখানে যদি পর্যাপ্ত সিসিটিভি থাকতো, তাহলে সহজে শনাক্ত করতে পারতাম।’

ইহসানুল ফিরদাউস বলেন,  ‘যেসব অপরাধী ধানমন্ডি লেকে এসে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে, তাদের  বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। তাদের আমরা প্রতিনিয়ত নজরদারিতে রাখছি। তারপরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ফোর্সের অভাবে একেবারে প্রতিটি জায়গায় নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হয় না। আমরা সবসময় সতর্ক রয়েছি।’

ছবি: সাজ্জাদ হোসেন

/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
কোটি টাকার আইসসহ গ্রেফতার সংগীতশিল্পী এনামুল রিমান্ডে
তামাক কর বাস্তবায়নে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ তরুণের অকালমৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব
ইয়াবাসহ ইউপি চেয়ারম্যানের ছোট ভাই গ্রেফতার
সর্বশেষ খবর
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ