X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১
লিবিয়ার ‘গেমঘরে’ আটকে রেখে যুবককে নির্যাতন

অসহায় পরিবারের সদস্যরা, উদ্ধারের আকুতি

নুরুজ্জামান লাবু
০১ অক্টোবর ২০২৩, ২৩:২৬আপডেট : ০১ অক্টোবর ২০২৩, ২৩:৩৩

দুই হাত পেছনমোড়া করে বাঁধা। উপুড় করে শুইয়ে রাখা হয়েছে। হাঁটু ভাজ করে পায়ের তলায় লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে দুই-তিন জন। নির্যাতনের ফলে চিৎকার করছেন এক যুবক। এই দৃশ্য মোবাইল ফোনে ভিডিও করে পাঠানো হয়েছে পরিবারের সদস্যদের। মারধরকারীরা পরিবারের কাছে দাবি করেছেন সাড়ে ১২ লাখ টাকা। তা না হলে মেরে সাগরে লাশ ভাসিয়ে দেবেন সেই হুমকিও দিয়েছেন। কিন্তু এত টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই পরিবারের। ফলে চোখের জল ফেলা ছাড়া আর যেন কিছুই করার নেই তাদের। নির্মম এই ঘটনাটি ঘটেছে লিবিয়ায়।

নির্যাতনের শিকার যুবক গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের বাসিন্দা অসহায় কৃষক আবুল কাশেমের ছেলে লাজু মিয়া। যারা নির্যাতন করছেন তারাও বাংলাদেশি। সমুদ্রপথে মানবপাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা কুমিল্লার বাসিন্দা শরীফ হোসেনের নেতৃত্বে চলছে এই ভয়াবহ নির্যাতন। প্রায় দেড় মাস পার হতে চলছে এখনও শরীফের ‘গেমঘরে’ বন্দি সেই যুবক।

নির্যাতনের শিকার লাজুর চাচাতো বোন সালমা জানান, শাহরুল নামে তাদের এক প্রতিবেশী লিবিয়াতে থাকেন। সেই শাহরুলের মাধ্যমে তার ভাই লাজু গত বছরের অক্টোবর মাসে লিবিয়াতে যায়। সেখানে ছয়-সাত মাস কাজ করে। পরে স্থানীয় জসিম নামে এক ব্যক্তি তাকে সাগর পথে ইতালিতে পাঠানোর প্রস্তাব দেয়। এজন্য তারা লাজুর পরিবারের কাছ থেকে সাড়ে সাত লাখ টাকাও নেয়। কিন্তু সেই জসিম লাজুকে ইতালি না পাঠিয়ে মানবপাচারকারী চক্রের মাফিয়া শরীফের কাছে বিক্রি করে দেয়। এরপর শরীফ তাকে ‘গেমঘরে’ আটকে রেখে আরও সাড়ে ১২ লাখ টাকার জন্য নির্যাতন শুরু করে।

নির্যাতনের শিকার লাজুর বাবা আবুল কাশেম জানান, লিবিয়া থেকে তাদের কাছে লাজুকে নির্যাতনের ভিডিও পাঠিয়ে এই টাকা দাবি করে। এতে তারা দিশেহারা হয়ে পড়েন। তাদের সাড়ে ১২ লাখ টাকা দেওয়ার সামর্থ্যও নেই। উপায়ন্তর না দেখে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শরণাপন্ন হন। পরে র‌্যাব-১১ এর কুমিল্লা ক্যাম্পের কর্মকর্তাদের কাছে বিষয়টি জানালে তারা মানবপাচারকারী শরীফের বাবা ও ভাইসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেন।

র‌্যাব-১১ সূত্র জানায়, লিবিয়া থেকে নির্যাতনের শিকার পরিবারের সদস্যদের মুক্তিপণের টাকা দেওয়ার জন্য বারবার চাপ দেওয়া হচ্ছিল। পরে তারা টাকা দেওয়ার কথা বলে অপহরণকারী চক্রের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। লিবিয়ার মানবপাচারকারী চক্রের হোতা শরীফের নির্দেশনা অনুযায়ী মুক্তিপণের টাকা নেওয়ার জন্য তার বাবা আনোয়ার হোসেন, ভাই শিহাব ও সুমন মিয়া নামে এক সহযোগী এসেছিল। ছদ্মবেশে মুক্তিপণের টাকা নেওয়ার সময় র‌্যাব সদস্যরা ওই তিন জনকে আটক করেন। পরে তাদের বিরুদ্ধে কুমিল্লার চান্দিনা থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।

কুমিল্লার চান্দিনা থানা পুলিশ জানায়, গ্রেফতারকৃত আনোয়ার, শিহাব ও সুমনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। পরে তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। রিমান্ডে থাকা অবস্থায় তারা ভিকটিম লাজু মিয়াকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য নানাভাবে চাপ দিয়েছেন। কিন্তু অপহরণকারী চক্রের সদস্যরা ভিকটিমকে এখনও ছাড়েনি।

চান্দিনা থানার পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আজিজুল ইসলাম জানান, তারা বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত লিখে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের ন্যাশনাল কমিউনিকেশন ব্যুরো (এনসিবি)’র কাছে পাঠিয়েছেন। এনসিবি ইন্টারপোলের মাধ্যমে লিবিয়ার স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভিকটিমকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে পারে।

পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, লিবিয়ার প্রশাসনিক অবস্থা তেমন সুবিধাজনক নয়। সেখানে একেক এলাকায় একেকটি সন্ত্রাসী গ্রুপ নিজ নিজ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। এজন্য ইন্টারপোলের মাধ্যমে সেখানকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করাটাও কঠিন।

ওই কর্মকর্তা জানান, মানবপাচারকারী মাফিয়া এই চক্রটির বাংলাদেশি সহযোগীদের চাপ দিয়ে ভিকটিমকে উদ্ধার করা সম্ভব। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সদিচ্ছা থাকতে হবে। অনেক সময় মাফিয়া চক্রটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দিয়ে তদবির করিয়ে পার পেয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।

ইউরোপে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে দেশের শত শত যুবককে নানাভাবে প্রথমে নিয়ে যায় লিবিয়ায় (ইনসেটে শরীফ হোসেন)

নির্যাতন চলছেই, মামলা তুলে নিতেও হুমকি

ভিকটিম লাজু মিয়ার চাচাতো বোন সালমা জানান, লিবিয়া থেকে মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা মাঝে মধ্যেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। এখন তারা মামলা তুলে নেওয়ার জন্য নানাভাবে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। মামলা তুলে না নিলে ভিকটিম লাজুকে মেরে ফেলা হবে বলেও হুমকি দিয়েছে।

সালমা বলেন, ‘আমরা গরীব মানুষ। যে কোনওভাবে আমার ভাইকে বাঁচাতে চাই। আমরা এখন কি করবো, কিছুই বুঝতে পারছি না।’

ভিকটিমের পরিবারের সদস্যরা জানান, মামলার শুনানির দিন শরীফের বাবাকে জামিন করাতে ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাকর্মীকে তারা ভাড়া করে আদালতে নিয়ে গিয়েছিল। অনেক টাকা দিয়ে বড় বড় উকিলও ধরেছিল। কিন্তু আদালত জামিন দেননি। কিন্তু এভাবে কত দিন? একসময় টাকার কাছে পরাস্ত হয়ে আদালত থেকে তারা জামিনে বের হয়েও আসবে।

পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, মানবপাচার আইনে মামলা দায়ের হলে ভিকটিমকে উদ্ধারের আগে মামলা তুলে নেওয়া বা ডিসমিস করার কোনও সুযোগ নেই। ভিকটিমকে উদ্ধারের পর আদালত যদি চায় তবে মামলা নিষ্পত্তি করা যাবে। এছাড়া মামলা তুলে নিলেই যে ভিকটিমকে ছেড়ে দেওয়া হবে তারও তো কোনও গ্যারান্টি নেই।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করতে চায় অসহায় পরিবারটি

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের জীবনপুরের বাসিন্দা আবুল কাশেম। আগে গ্রামেই অটোরিকশা চালাতেন। এখন মানুষের বাসায় কাজ করেন। সংসারের স্বচ্ছলতার আশায় বড় ছেলে লাজু মিয়াকে লিবিয়ায় পাঠিয়েছিলেন। প্রথম দফায় বিদেশ পাঠাতে ভিটামাটি বিক্রি করেছেন। সংসারে স্বচ্ছলতা আসার বিপরীতে এখন পুরো পরিবার দিশেহারা। ছেলেকে ফেরত পাবেন কিনা তা নিয়েই আছেন সংশয়ে।

আবুল কাশেম বলেন, ‘আমার তো সব শ্যাষ হয়্যা গেলো। এখন ছেলেটাক ফেরত পাইতে চাই। কিন্তু কিছুতেই তাকে ছাড়তেছে না। কি যে করবো কিছুই বুঝতে পারতেছি না। আমরা একটু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাই। প্রধানমন্ত্রী যদি চায় তাহলে ছেলেটাক ফেরত পামু। আমরা গরীব মানুষ, আমাদের কথা তো কেউ শুনবার চায় না। হামাক (আমাদের) প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করি দেন।’

মানবপাচার নিয়ে কাজ করেন সংশ্লিষ্ট একজন জানান, বিদেশে গিয়ে বিপদে পড়া বা অপহরণের শিকার, নির্যাতনের শিকারের ঘটনা অহরহ ঘটছে। কিন্তু যেসব ঘটনায় তোলপাড় হয় সেগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নিয়ে উদ্ধারের তোড়জোড় চলে। গরীব মানুষের ক্ষেত্রে এত তোলপাড়ও হয় না, ফলে উদ্ধারও হয় না। সরকার চাইলে লিবিয়ার বাংলাদেশের দূতাবাসকে কাজে লাগিয়েও ছেলেটিকে উদ্ধার করতে পারে।

বেপরোয়া মাফিয়া শরীফ, নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না

সংশ্লিষ্টরা জানান, কুমিল্লার চান্দিনার বাসিন্দা শরীফুল কয়েক বছর আগে কাজের উদ্দেশে লিবিয়া গিয়েছিলেন। সে সময় তার বাবা চান্দিনায় একটি চায়ের টং দোকান পরিচালনা করতো। সেটা দিয়ে তাদের সংসারের খরচ নির্বাহ হতো। কিন্তু লিবিয়ায় অবস্থান করে শরীফ ধীরে ধীরে মানবপাচারকারী চক্রের মাফিয়া হয়ে ওঠেন। তার নেতৃত্বে একটি চক্র বাংলাদেশি বিভিন্ন যুবকদের ধরে এনে বা কিনে এনে নিজেদের গেমঘরে আটকে রেখে নির্যাতন করেন। এরপর পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করেন। দেশে তার বাবা আনোয়ার, ভাই শিহাব, স্ত্রীসহ স্বজনরা মুক্তিপণের টাকা সংগ্রহ করতো। এভাবে শরীফ ও তার স্বজনেরা প্রায় ১০ কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। কুমিল্লা ছাড়াও, চাঁদপুর, গাজীপুর ও টঙ্গিতে তাদের সম্পত্তি রয়েছে। একাধিক বহুতল আবাসিক ভবনও রয়েছে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, শরীফ সমুদ্রপথে ইউরোপে মানবপাচারের বড় সিন্ডিকেটের মূল হোতা। এর আগে একাধিক ঘটনায় দেশের বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। কিন্তু লিবিয়া থেকে তাকে ফেরানো যাচ্ছে না। লিবিয়াতে থেকেই সে একের পর এক অপহরণ বাণিজ্য করে যাচ্ছে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা জানান, এরকম মাফিয়াদের ঠেকানোর একমাত্র কৌশল হলো তাদের ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা দায়ের করা। মামলা দায়েরের পর আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী অবৈধভাবে অর্জিত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা। যখন কোনও অপরাধী দেখবে যে, অবৈধভাবে অর্জিত সম্পত্তি ভোগ করতে পারছে না, তখন অপরাধীদের মধ্যে অপরাধ করার প্রবণতাও কমবে।

আরও পড়ুন-

লিবিয়ায় মুক্তিপণ আদায়, দেশে কোটি টাকার সম্পদ মাফিয়া শরীফের

 

/আরআইজে/
সম্পর্কিত
ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে মৃত ৮ বাংলাদেশির মরদেহ হস্তান্তর
তিন মামলায় মিল্টনের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
পাচার হওয়া বোনকে নিতে এসে কলকাতায় অসহায় দশায় চট্টগ্রামের তরুণ
সর্বশেষ খবর
অনেক নার্ভাস ছিলেন সাইফউদ্দিন
অনেক নার্ভাস ছিলেন সাইফউদ্দিন
বকশিবাজার মোড়ে বাসের ধাক্কায় পথচারী নিহত
বকশিবাজার মোড়ে বাসের ধাক্কায় পথচারী নিহত
১২ বছর পর মুম্বাইয়ের মাঠে কলকাতার জয়
১২ বছর পর মুম্বাইয়ের মাঠে কলকাতার জয়
বেড়িবাঁধে উন্নত নিরাপত্তা ও গতিশীলতা: মেয়র আতিকের কাছে ইউল্যাবের আবেদন
বেড়িবাঁধে উন্নত নিরাপত্তা ও গতিশীলতা: মেয়র আতিকের কাছে ইউল্যাবের আবেদন
সর্বাধিক পঠিত
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
নদীতে ধরা পড়ছে না ইলিশ, কারণ জানালেন মৎস্য কর্মকর্তা
নদীতে ধরা পড়ছে না ইলিশ, কারণ জানালেন মৎস্য কর্মকর্তা