শরতের স্নিগ্ধ সকালে আয়োজন শুরু হয় পারিবারিক আবহে। শ্রদ্ধায় অবনত ভালোবাসার ও কাছের মানুষগুলো একে একে আসতে থাকেন রাজধানীর ধানমন্ডির বাড়িতে। পরিবারের সদস্যরা ও আগত স্বজন-শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিয়ে শুরু হয় ব্যতিক্রমী স্মরণসভা।
‘তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা’ গানটি পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু হয় দৈনিক আজকের কাগজের প্রকাশক ও সম্পাদক, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) ও জেমকন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা কাজী শাহেদ আহমেদের স্মরণসভা।
শুক্রবার (১০ নভেম্বর) সকালে রাজধানীর ধানমন্ডিতে ‘আর্ট অব লিভিং বাংলাদেশ’ পরিবার এই ‘স্মরণসভা’র আয়োজন করে।
কাজী শাহেদ আহমেদের জীবনব্যাপী শিক্ষা, পারিবারিক জীবন, তার জীবনের সফলতার গল্প বলতে শুরু করেন তার ভালোবাসার মানুষগুলো। নানা কথামালায় উঠে আসে—বাড়তি প্রাপ্তির কোনও যোগ নেই; যা কিছু, তার সবটাই নিজের অর্জন। লাইফ লং লার্নার, শিক্ষা উদ্যোক্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তার প্রিয়জন, স্ত্রী-সন্তান ও আত্মীয়স্বজন।
অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া কাজী শাহেদ আহমেদের গুণমুগ্ধ মানুষগুলো বলতে থাকেন, ‘আমরা তাঁকে স্মরণ করি আমাদের চিন্তায়, প্রতিটি কাজে ও উদ্যোগে।’
সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে ব্যতিক্রমী স্মরণসভা শুরুর পর কাজী শাহেদ আহমেদের জীবনভিত্তিক ভিডিও প্রদর্শন করা হয়। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা ও উপস্থাপনা করেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বিটিভির সাবেক মহাপরিচালক ম. হামিদ। অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন বিমান চন্দ্র বিশ্বাস।
ম. হামিদ বলেন, কাজী শাহেদ আহমেদের জীবনে বাড়তি প্রাপ্তির যোগ নেই। যা কিছু, তার সবটাই নিজের অর্জন। আমরা যেন তার অনুসরণ করতে পারি আমাদের জীবনে।
অনুষ্ঠানে স্মারকপত্র পাঠ করেন আর্ট অব লিভিংয়ের শিক্ষক রাফি হোসেন। তিনি বলেন, নিষ্ঠা ও প্রেরণার বাতিঘর কাজী শাহেদ আহমেদ। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এ মানুষটি সবাইকে আপন করে নিতে পারতেন। যেখানে হাত দিয়েছেন, সেখানেই সফলতার ছাপ রেখেছেন। বাস্তবতার নিরিখেই স্বপ্ন জয়ের ছক আঁকতে ভালোবাসতেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, প্রথম জীবনে সেনা কর্মকর্তা হিসেবে কাজ শুরু করলেও পরে তিনি শিল্প, সাহিত্য, সাংবাদিকতা, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ইউল্যাব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যেমন তার শিক্ষা উদ্যোক্তার বিষয়টি ফুটে ওঠে, তেমনি জেমকন সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করে সাহিত্যপ্রেমী মনোভাব প্রকাশ পায় তার। আত্মজীবনী তার লেখক পরিচয়কে স্পষ্ট করেছে।
স্মরণসভায় বক্তব্য দেন ডাটাসফটের এমডি মাহাবুব জামান, আর্ট অব লিভিং কান্ট্রি ডিরেক্টর বজলুর রহমান খান, মেডিনোভার এমডি ডা. মনোয়ার হোসেন, আর্ট অব লিভিংয়ের শিক্ষক আতিকুর রহমান, রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজিব ও ব্যারিস্টার তানিয়া আমির।
এ ছাড়া প্রয়াত কাজী শাহেদ আহমেদের পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা এই স্মরণসভায় অংশ নেন।
পরিবারের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন কাজী শাহেদ আহমেদের স্ত্রী রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ও আর্ট অব লিভিংয়ের শিক্ষক আমিনা আহমেদ, আমিনা আহমেদের ভাই রেজা হক, কাজী শাহেদ আহমেদের বড় ছেলে কাজী নাবিল আহমেদ, ছোট ছেলে কাজী ইনাম আহমেদ।
স্মরণসভায় আমিনা আহমেদ খানসহ পরিবারের হাতে কাজী শাহেদ আহমেদের একটি প্রতিকৃতি ও স্মারকপত্র তুলে দেওয়া হয়, যেটি এঁকেছেন শিল্পী কিরীটি রঞ্জন বিশ্বাস।
আমিনা আহমেদ স্মৃতিচারণা করেন কাজী শাহেদ আহমেদের জীবনবোধ, রুচি, ভালোবাসা ও একাগ্রতা নিয়ে। জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়ে অনেক স্মৃতি তুলে ধরেন তিনি।
বড় ছেলে যশোর-৩ (সদর) আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ বাবাকে স্মরণ করেন। আয়োজকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি। সফল মানুষ ও আদর্শ পিতা হিসেবে কাজী শাহেদ আহমেদের মূল্যায়ন করেন তিনি।
মেজ ছেলে জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউন ও ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকার প্রকাশক কাজী আনিস আহমেদ। স্মরণসভায় জানানো হয়, তিনি বর্তমানে দেশের বাইরে রয়েছেন।
ছোট ছেলে জেমকন গ্রুপের পরিচালক কাজী ইনাম আহমেদ বাবাকে ‘ওয়ান্ডারফুল ফাদার’ হিসেবে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, আমার বাবা ছিলেন একজন লাইফ লং লার্নার। তিনি ডায়েরি মেনটেইন করতেন। পিতার জীবনব্যাপী শিক্ষার বিষয় তুলে ধরেন তিনি। তার কথায় উঠে আসে, পরিবারকে কীভাবে শিখিয়েছেন এবং তিনি নিজেও পরিবার থেকেও শিক্ষা নিয়ে নিজেকে ঋদ্ধ করেছেন।
প্রসঙ্গত, কাজী শাহেদ আহমেদ ১৯৪০ সালের ৭ নভেম্বর যশোরে জন্মগ্রহণ করেন। প্রকৌশলবিদ্যায় পড়ালেখা শেষে তিনি ১৪ বছর সেনাবাহিনীতে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ মিলিটারি অ্যাকাডেমির প্রতিষ্ঠাকালীন প্লাটুন কমান্ডারদের একজন ছিলেন তিনি।
কাজী শাহেদ আহমেদ চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ১৯৭৯ সালে ‘জেমকন গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ব্যবসায়িক জীবন শুরু করেন। বাংলাদেশে প্রথম অর্গানিক চা-বাগানের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি।
১৯৭৫ সালে তিনি ফুটবল ক্লাব আবাহনী লিমিটেডের হাল ধরেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ক্লাবটির ডিরেক্টর ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
উল্লেখ্য, গত ২৮ আগস্ট সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮২ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কাজী শাহেদ আহমেদ।