ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল ফোন, ট্যাব, টেলিভিশনে বসে থাকা শিশুর চোখের সমস্যার বিষয়ে ধাতস্থ হতে না হতেই এবার উঠে এসেছে ভিজ্যুয়াল পলিউশনের কবলে পড়ে মানসিক সমস্যার শঙ্কার কথা। গবেষণা বলছে, ৯৫ শতাংশ নগরবাসীর এ সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই। অথচ অভিভাবকরা এ সমস্যা নিয়ে হাজির হচ্ছেন চিকিৎসকদের কাছে। মনোরোগ বিশ্লেষকরা বলছেন, রাস্তায় এমনকি বাসায় নিজের ঘরে এলোমেলো ভিজ্যুয়াল, অতিরিক্ত সময় ডিজিটাল বিলবোর্ডে চোখ দিয়ে থাকার কারণে কেবল শিশু না, বড়রাও মানসিক সমস্যা নিয়ে আসছেন। এ থেকে বের হতে হলে এলোমেলো এই বাধাগুলো সরানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এমনকি ডিজিটাল কনটেন্ট রাস্তায় কী দেওয়া যাবে বা যাবে না, তা নিয়েও নির্দেশনা থাকতে হবে। কারণ, মগজে জমে যাওয়া ভিজ্যুয়াল যে ক্ষত তৈরি করে তা মানসিক অস্থিরতার কারণ হতে পারে।
সম্প্রতি এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) ‘ভিজ্যুয়াল পলিউশন ইন দ্য সিটি অব ঢাকা-অ্যা পাবলিক হেলথ, এনভায়রনমেন্ট, অ্যান্ড ট্রাফিক ডিসট্রাকশন’ গবেষণা ফলাফলে জানা যায়, ভিজ্যুয়াল পলিউশনের কারণে চোখ এবং মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকা শহরে প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার শিশু চোখ ও মাথাব্যথাজনিত সমস্যায় ভোগেন।
এসডোর এই গবেষণায় বলা হয়েছে, ভিজ্যুয়াল পলিউশনের কারণে ২৪ শতাংশ মানুষ চোখের সমস্যায় ভুগছে, যার মধ্যে শিশুরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ঢাকা শহরের ২৭টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে দেওয়া এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকার বাসিন্দা যারা মানসিক সমস্যাগ্রস্ত, তাদের সংখ্যা প্রায় ১৭ শতাংশে পৌঁছেছে। এই রোগীদের অনেকেই চলার পথে দীর্ঘ সময় রাস্তায় ডিজিটাল বিলবোর্ডের কারণে মানসিক অস্থিরতায় ভুগছেন।
নগরীর রাস্তায় ডিজিটাল বিলবোর্ড, তারযুক্ত বিদ্যুতের খুঁটি এবং বিদ্যুৎ বিতরণ নেটওয়ার্ক, কুয়াশা, গ্রাফিটি ইত্যাদি ভিজ্যুয়াল পলিউশনের উদাহরণ। গবেষণায় আরও একটি শঙ্কার দিক উঠে আসে। তারা বলছেন, ভিজ্যুয়াল পলিউশনের কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ৪০ শতাংশ বেড়েছে। যেখানে ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ৫ হাজার ২২৭ জনের, ২০২২ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৮ হাজার ৮০০ জন। ভিজ্যুয়াল পলিউশনকে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এমনকি ভিজ্যুয়াল পলিউশনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মানবসৃষ্ট আবাসভূমি নষ্ট হওয়ার কারণে বাস্তুসংস্থানের ক্ষতি হচ্ছে বলেও উল্লেখ আছে গবেষণায়।
গবেষণার ফলাফলের বিষয়ে এসডোর মহাসচিব এবং স্টাডি টিম লিডার ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, ‘ভিজ্যুয়াল পলিউশনের পরিণতি সুদূরপ্রসারী। এর মধ্যে রয়েছে মানসিক বিভ্রান্তি ও অবসাদ, মতামত প্রকাশের ক্ষমতা হ্রাস, বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি, মানসিক অস্থিরতা ও অসুস্থতা, চোখের সমস্যা, নান্দনিকতা বোধ হ্রাস, কমিউনিটির সামগ্রিক ক্ষতি ইত্যাদি। যে শিশুরা শৈশব থেকেই ভিজ্যুয়াল পলিউশনের সংস্পর্শে এসেছে, তারা প্রায়ই অপ্রীতিকর পরিবেশের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তাদের স্বাভাবিক আবেগ হারিয়ে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘ভিজ্যুয়াল পলিউশন বিষয়টি ধাপে ধাপে মোকাবিলা করতে হবে। এই পলিউশনের ঝুঁকি কমাতে এ সম্পর্কে আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে এ সম্পর্কে বোঝাতে হবে।’
এ বিষয়ে এখনও কোনও গবেষণা নেই উল্লেখ করে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘এটা খুব জরুরি একটি আলোচনা এবং বিদেশে এ বিষয়ে অনেক কাজ হচ্ছে। আমাদের পঞ্চ-ইন্দ্রিয় রয়েছে এবং তার মাধ্যমে আমরা সব সংবেদন নিয়ে থাকি। সেটা যদি শরীর-মনের উপযোগী না হয়, তবে দেহ-মন আক্রান্ত করে।’
তিনি বলেন, ‘টেলিভিশনে বীভৎস চিত্র কেন দেখানো হয় না? কারণ, এসব বীভৎসতা মস্তিষ্কের কোনও একটা জায়গায় ক্ষত তৈরি করে। এক ধরনের ভার্চুয়াল ইমেজ মগজে তৈরি হয়। সেখানে সঞ্চিত হয় খারাপ অনুভূতি। যদি বেশি বেশি খারাপ অনুভূতি সঞ্চিত হয় তবে মন খারাপ হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে আধুনিক অফিস সেটিংসের ক্ষেত্রেও এই ভিজ্যুয়াল পলিউশন বিষয়টা মাথায় রাখ হয়। মনে রাখতে হবে, নান্দনিকতা উৎপাদনশীলতাকে বাড়ায়, মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করে। আমরা এ ধরনের অস্থিরতার রোগীদের পাচ্ছি। আরও সচেতনতা তৈরির দরকার আছে।’