X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

অপরাধীচক্রের নেতৃত্ব দিতো পা হারানো মামুন

নুরুজ্জামান লাবু
২৪ মার্চ ২০২৪, ২২:০৪আপডেট : ২৪ মার্চ ২০২৪, ২২:৩০

প্রায় ১৬-১৭ বছর আগে দুর্ঘটনায় একটি পা হারায় মামুন। চিকিৎসকরা তার ডান পা উরু বরাবর কেটে ফেলে দিয়েছিলেন। এরপর থেকে প্লাস্টিকের পা ব্যবহার করে আসছে সে। দৌড়াতে পারে না, হাঁটাচলাও করতে হয় সাবধানে। কিন্তু তারপরও প্রায় এক দশক ধরে একটি অপরাধীচক্রের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল মামুন। সম্প্রতি ধানমন্ডির মাস্টারমাইন্ড স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী জামিনুর রহমানকে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায় ছয় সহযোগীসহ তাকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের রমনা বিভাগ।

জিজ্ঞাসাবাদে মামুন গোয়েন্দাদের জানায়, তার গ্রামের বাড়ি বরগুনার আমতলী এলাকায়। আগে কাপড়ের ব্যবসা করতো। থাকতো বরিশালে। ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিল।  ১৬-১৭ বছর আগে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ডান পা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে চিকিৎসকরা তার ডান পা কেটে ফেলতে বাধ্য হয়। এরপর ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে অপরাধীচক্র গড়ে তোলে মামুন।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আজহারুল ইসলাম মুকুল জানান, মামুন একজন পেশাদার অপরাধী। বিভিন্ন সময় অপরাধ করে জেলেও গিয়েছে। কিন্তু জেল থেকে জামিনে বের হয়ে এসে আবারও অপরাধে জড়িয়ে পড়তো। তার এবং দলের সদস্যদের জেল থেকে জামিনে বের করে আনার জন্য সার্বক্ষণিক একজন উকিল নিয়োগ করে রেখেছিল সে। এই চক্রের অন্য সদস্যদেরও গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে।

জিজ্ঞাসাবাদে মামুন জানায়, এলাকায় বিভিন্ন অপরাধ করে বেড়াতো সে। তার চক্রে অন্তত ১৫ জন সদস্য রয়েছে। জেলে গিয়ে কিংবা রাজনীতি করতে গিয়ে তাদের সঙ্গে পরিচয়। তারা ঢাকা ও ঢাকার আশেপাশের এলাকায় চুরি-ছিনতাই-ডাকাতি ও অপহরণ করে বেড়াতো। প্রতিটি অপরাধ কর্মকাণ্ডের পর তারা আবার নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে আত্মগোপন করতো।

গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে এই মামুনের নেতৃত্বেই পটুয়াখালীতে শিবু কুমার দাস নামে এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে ২৫ কোটি টাকা মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা করা হয়। পরে পুলিশি তৎপরতায় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ওই ব্যবসায়ীকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যায় অপহরণকারী চক্রের সদস্যরা। পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল রাজধানীর একাধিক এলাকায় অভিযান চালিয়ে মামুন ও তার বেশ কয়েকজন সহযোগীকে গ্রেফতার করে।

যেভাবে অপহরণ করা হয়েছিল জামিনুরকে

মামুন জানায়, ধানমন্ডির মাস্টারমাইন্ড স্কুলের শিক্ষার্থী জামিনুর রহমানকে অপহরণের পুরো পরিকল্পনাটি সে সাজিয়েছিল। জামিনুরকে স্কুলে আনা-নেওয়া করতো কামরুল নামে এক গাড়িচালক। কামরুল সম্পর্কে মামুনের শ্যালক। মামুনের পরিকল্পনায় তারা ঘটনার দিন সকালে সবাই প্রথমে কলাবাগান এলাকায় মিলিত হয়। একটি মোটরসাইকেলে মামুন, মহসনি ও রনি মিলে জামিনুরকে বহন করা প্রাইভেটকারটির পিছু নেয়। ধানমন্ডি ১০/এ সড়কে গিয়ে এক পাশ থেকে গাড়িকে মোটরসাইকেল দিয়ে ধাক্কা দেওয়া হয়। গাড়িচালক কামরুলকে আগেই অপহরণের কৌশলের কথা জানিয়ে রেখেছিল মামুন। পরিকল্পনা মতো ড্রাইভার কামরুল গাড়িটি থামানোর সঙ্গে সঙ্গেই মামুন, রনি ও নুর আলম প্রাইভেটকারে উঠে পরে। গাড়িটি প্রথমে কামরুলই চালাচ্ছিল। কিছু দুর যাওয়ার পর মামুন নিজে গিয়ে চালকের আসনে বসে।

জিজ্ঞাসাবাদে মামুন জানায়, ডান পা প্লাস্টিকের হলেও সে গাড়ি চালাতে পারে। গাড়টি নিয়ে সোজা চলে যায় সাভারের ময়লার মোড় এলাকায়। সেখানে সহযোগী আসলামের বাসায় নিয়ে জামিনুরকে আটকে রাখা হয়। এর আগেই অবশ্য জামিনুরের স্কুল ড্রেসের ওপর দিয়ে একটি টি-শার্ট পরিয়ে দেওয়া হয়, যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে।

মামুন জানায়, জামিনুরকে আসলামের বাসায় রেখে সে গাড়ি নিয়ে প্রথমে বসিলা ওয়াসপুর এলাকায় গাড়িটি রেখে আসে। এরপর জামিনুরের কাছ থেকে নেওয়া তার বাবা ও মায়ের নম্বরে একাধিকবার ফোন করে। কিন্তু প্রথম দিকে তার বাবা-মা ফোন ধরছিলেন না। ঘণ্টাখানেক পর আবার ফোন দিলে জামিনুরের বাবা আনিসুর রহমান ফোন ধরেন। তখন তাকে জানানো হয় যে, ছেলেকে অপহরণ করা হয়েছে এবং মুক্তিপণ বাবদ ৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা দাবি করে মামুন।

যেভাবে মুক্তিপণের টাকা নেওয়া হয়

মামুন জানায়, প্রতিবার ফোন দিয়েই ফোনটি বন্ধ রাখতো সে। আর ঘন ঘন জায়গা পরিবর্তন করতো। যাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তার অবস্থান শনাক্ত করতে না পারে। এক পর্যায়ে জামিনুরের বাবা ব্যবসায়ী আনিসুর রহমানের সঙ্গে ১৪ লাখ টাকা মুক্তিপণের রফা হয়। সাইনবোর্ড এলাকার মৌচাক সড়কে এই টাকা নিয়ে যেতে বলে সে।

মামুন জানায়, সেখানে লোকজনসহ অবস্থান করছিল সে। মুক্তিপণের টাকা নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় নুর আলম নামে এক সহযোগীকে। নুর আলম আরেক সহযোগীকে নিয়ে একটি মোটরসাইকেলসহ সড়কের পাশে অপেক্ষা করছিল। তাদের নির্দেশনা মতো একটি পলিথিন ব্যাগে ১৪ লাখ টাকা গাড়ি থেকে সড়কের পাশে ফেলে দিয়ে যান আনিসুর রহমান। নুর আলম সেই টাকা নিয়ে পাশেই তার বাসায় যায়।

১১ জন ভাগ করে নেয় টাকা

জিজ্ঞাবাসাদে মামুন জানায়, মুক্তিপণের টাকা নিয়ে তারা সবাই মিলে নুর আলমের টিনশেড বাসার পাশেই একটি ফাঁকা কক্ষে গুণে দেখেন। পরে মামুন সবাইকে ৮০ হাজার টাকা করে ভাগ করে দেয়। নিজে নেয় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। বাকি টাকা নিজেদের তহবিলে রাখা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে নূর আলম জানায়, টাকা ভাগাভাগি নিয়ে তাদের মধ্যে ঝামেলাও তৈরি হয়েছিল। তাদের এক সহযোগী পুরো টাকা নিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। পরে ভাগের টাকা নিয়ে নুর আলম চট্টগ্রামের এক বাসায় গিয়ে আত্মগোপন করেছিল। মামুন জানায়, সে তার ভাগের টাকা নিয়ে জুয়া খেলেছে। কিছু টাকা পরিবারকেও দিয়েছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন অর রশীদ জানান, চক্রটির সদস্যরা বিভিন্ন ধনী ব্যবসায়ীর গাড়িচালক হিসেবে নিজেদের লোককে চাকরি দেওয়ার ব্যবস্থা করে। এভাবে তারা তথ্য সংগ্রহের পর টার্গেট ব্যক্তিকে অপহরণ করে। নয়তো ধনী লোকের গাড়িচালককে কৌশলে নিজেদের দলে ভিড়িয়ে তথ্য সংগ্রহ ও অপহরণ করে।

আরও পড়ুন:

অপহরণ মামলায় জেল, কারাগারে বসে ফের অপহরণের পরিকল্পনা

ধানমন্ডিতে স্কুলছাত্রকে অপহরণের নেপথ্যে নিজেদের গাড়িচালক

 

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
এপি'র সাংবাদিককে গ্রেফতার করলো রাশিয়া
গুলশানে চোর সন্দেহে পেটানোর পর যুবকের মৃত্যু, একজন গ্রেফতার
যাত্রাবাড়ীতে চাঁদা আদায়ের সময় গ্রেফতার ১৫
সর্বশেষ খবর
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ