X
মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪
৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

নাটবল্টুর সঙ্গেই কাটছে শৈশব-কৈশোর

আতিক হাসান শুভ 
০১ মে ২০২৪, ১৪:০০আপডেট : ০১ মে ২০২৪, ১৪:০৬

দুপুরের তপ্ত রোদেই গাড়ির নাটবল্টুসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ গুছিয়ে কেবল ছোট্ট একটা টুলের উপর বসেছে সুমন (১৪)। সকাল ৯টা থেকে শুরু হওয়া কাজ শেষ হতে আরও ঘণ্টাখানেক লাগবে তার। এর মধ্যে নাস্তা হিসেবে খেয়েছে কেবল দুটো সিঙ্গারা আর কয়েক গ্লাস পানি। রোদের তীব্রতায় বারবার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, ঠিকভাবে কথাও বলতে পারছে না সে। শুধু সুমন নয়, পুরান ঢাকার ধোলাইপাড়ে এলে এমন অনেক কিশোর-তরুণেরই দেখা মিলবে। গাড়ির নাটবল্টু, বিয়ারিং, স্প্রিং, ব্রেক, চাকা কিংবা টায়ার ইত্যাদি যন্ত্রাংশ গোছাতে আর পরিষ্কার করতে করতেই যাদের অনেকের শৈশব পেরিয়ে গেছে, আবার কেউ কেউ কৈশোর কাটিয়ে যৌবনে পা দিয়েছেন।

গাড়ির একটা যন্ত্রাংশ পরিষ্কার করতে করতেই ধোলাইপাড়ে কাজ করার পেছনের গল্প বলছিল সুমন। বাংলা ট্রিবিউনকে সে জানায়, তার বাড়ি বরিশালের হিজলা উপজেলায়। বয়স যখন সাত বা আট বছর, তখন থেকেই এখানে। এক মামা এখানে কাজ করেন, তার সঙ্গেই এসেছিল সে।

এখানে কাজের বিষয়ে জানতে চাইলে সুমন নিচুস্বরে উত্তর দেয়, ‘আমার বাবাকে আমি কখনও দেখিনি। শুনেছি তিনি মাকে ছেড়ে চলে গেছেন। পরে আমার মায়ের আরেক জায়গায় বিয়ে হয়। আমার আর আমার মায়ের সঙ্গে থাকা হয়নি। আমি নানুর কাছে বড় হয়েছি। তারপর একদিন নানুর বাড়িতে পাশের বাড়ির রায়হান মামা এসে বললো, ঢাকায় চল, তোকে কাজ শেখাবো। ২০১৭ সালে তখন আমি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। কোনও কিছু না ভেবেই তখন ঢাকায় চলে আসছি। সেই থেকেই আমি এখানে।’

ধোলাইপাড় এলাকার বেশিরভাগ যন্ত্রাংশেই কাজ করে শিশু-কিশোররা

পুরান ঢাকার ধোলাইপাড় এলাকায় দৃষ্টি মেললেই দেখা যাবে, এখানে হালকা থেকে ভারী; সব কাজই করছে সুমনের মতো শিশু-কিশোররা। মোটরগাড়ির গাড়ির পার্টস বিক্রি, মাইক্রোবাস ধোয়ামোছাসহ গাড়ির যাবতীয় মেরামতের কাজ খুব গুরুত্ব দিয়ে করছে তারা। বিনিময়ে কপালে জোটে খুবই সামান্য বেতন। তবে বেতনের চেয়ে কাজ শেখা এবং জানার প্রতি আগ্রহ এসব শিশু-কিশোরদের।

কাজ শেখার বিষয়ে রনি (১৬) নামের এক কিশোর বাংলা ট্রিবিউনকে বলে, ‘আমি গত পাঁচ বছর ধরে ৬ হাজার টাকা বেতনে এখানে আছি। এখানে মহাজনের সঙ্গে থেকে সব কাজ শেখার চেষ্টা করছি। এখন আমি মোটামুটি গাড়ি সংক্রান্ত সব কাজ জানি। তাছাড়া গাড়ির কোন পার্টসের দাম কত, সেই বিষয়েও জানা আছে। আমি চাইলে এখন নিজেই একটা ব্যবসা শুরু করতে পারবো।’

ধোলাইপাড়ে সুমন এবং রনির মতো এমন অসংখ্য শিশু-কিশোর আছে, যাদের নানা কারণে ঠাঁই হয়েছে ইট-পাথরের এই শহরে। তাদের মধ্যে আরেকজন রোমান (১৪)। আর্থিক অভাব-অনটনের কারণে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেই পরিবারের হাল ধরেছে সে। গত পাঁচ বছর ধরে বানিয়ানগরের একটা গ্যারেজে কাজ করে এই কিশোর। মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) তপ্ত দুপুরে তীব্র গরমের মাঝে গ্যারেজের মালামাল নিতে এসে তার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। 

রোমান বলে, ‘হিসাব-নিকাশ করার মতো পড়াশোনা আমি করেছি। ক্লাস ফাইভে আমার রোল নম্বর ছিল ২। কিন্তু আমার বাবা মো. সেলিম প্যারালাইজড হয়ে যাওয়ার কারণে আমাকে ক্লাস ফোরে থাকতেই গ্যারেজে কাজ শুরু করতে হয়। তখন থেকেই এই কাজের সঙ্গে জড়িত। কাজ করে আর বাসায় পড়াশোনা করতে ভালো লাগতো না। তাই আস্তে আস্তে পড়াশোনা বাদ দিয়ে কাজ শুরু করেছি। এখন আমার রোজগারের টাকাতেই আমি আমার বাবা-মা আর ছোট বোনকে নিয়ে থাকি। আমি যদিও পড়াশোনা করতে পারিনি কিন্তু আমার ছোট বোন স্কুলে পড়ছে।’

ধোলাইপাড়ের একটু সামনে এগিয়ে যেতেই একটা দোকানে গাড়ির ভেঙে যাওয়া পার্টস মেরামত করতে দেখা যায় জসিম উদ্দিন (২৬) নামের এক যুবককে। যার শৈশব-কৈশোর কেটেছে এখানেই। ধোলাইপাড়ের এই নাটবল্টুর পল্লীতে একসময় অন্যের দোকানে কাজ করলেও এখন নিজেই গাড়ির পুরাতন মালামাল নিয়ে বসেছেন ফুটপাতে।

ফুটপাতের দোকানগুলোতে হালকা-ভারী সব কাজই করে শিশুরা

রুজি-রোজগার কেমন হয়, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখানে কাজ জানা থাকলে আর গাড়ির পার্টসের সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকলে দৈনিক দুই-তিন হাজার টাকা ইনকাম করাও কোনও ব্যাপার না। তবে যদি কাস্টমার আসে আরকি, কাস্টমার না থাকলে আবার এতো হয় না।’

১৫-১৬ বছর আগের কথা স্মরণ করে জসিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একটা সময় এতো বেশি গাড়ি ছিল না। এতো দোকানও ছিল না। গাড়ির সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে এখানকার দোকান ও ব্যবসা দুইটাই বাড়ছে। মেইনরোড থেকে ছাড়িয়ে আশপাশের বিভিন্ন অলিগলি পর্যন্ত ঢুকে গেছে পুরোনো গাড়ির যন্ত্রাংশের এই ব্যবসা। এখানে একেবারে ছোট বা ফুটপাতে বসে যারা ব্যবসা করছে তারা কমবেশি সবাই আগে অন্যের দোকানে কাজ করতেন। কাজ শিখে আস্তেধীরে সবাই এখন নিজে নিজে ব্যবসা করছেন।’

সরেজমিনে পুরান ঢাকার ধোলাইখাল গিয়ে দেখা গেছে, বর্তমানে এখানে কয়েক হাজার পার্টসের দোকান আছে। সেই দোকানের সামনের ফুটপাতে ফেলে রাখা হয়েছে গাড়ির পুরোনো ইঞ্জিন। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ইঞ্জিনের নাটবল্টু খুলে সব যন্ত্রাংশ আলাদা করে ফেলেন শ্রমিকরা। ইঞ্জিন থেকে পাওয়া যন্ত্রাংশ মহাজনের হাত ঘুরে চলে যাচ্ছে আশপাশের বিভিন্ন ছোট ও মাঝারি দোকানে। ধোলাইখাল টং পট্টি থেকে টায়ার পট্টির এপাশ ওপাশে দুই চক্কর দিতেই এসবের দেখা মিললো। শার্ট-প্যান্ট পরা ভদ্রলোকদের আকৃষ্ট করতে দোকানদারের আপ্রাণ চেষ্টার কমতি নেই।

 ধোলাইপাড়ে আছে কয়েক হাজার পার্টসের দোকান

ধোলাইখালের বেশ কয়েকজন পুরোনো ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের। শিশুশ্রমের বিষয়ে তারা বলেন, ব্যবসায়ীরা তাদের এক বিবেচনায় আশ্রয় দেয়। যারা এখানে আসে তাদের বেশিরভাগের পরিবারের অবস্থা খারাপ থাকে। আবার কেউ তো সরাসরি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। তারা কাজ শিখে ধীরে ধীরে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে। আবার ব্যবসায়ীরা তাদের প্রয়োজনীয় ভরণ-পোষণ দেওয়ার পাশাপাশি পারিশ্রমিকও দিয়ে থাকে।

ধোলাইখাল টং মার্কেটের ব্যবসায়ী জলিল মিয়া বলেন, ‘এখানে এমনও ছেলে আছে যাদের পরিবার বলতে কেউ নেই। আবার অনেকে পরিবার থেকে বিতাড়িত। আবার অনেকের পরিবারের আর্থিক অবস্থা দুর্বল দেখে এখানে কাজ শিখে তারপর তারা এখানেই ব্যবসা করে বা অন্য জায়গায় গিয়ে ব্যবসা শুরু করে। অনেকের আবার পড়াশোনা ভালো লাগে না। মূলকথা হচ্ছে শিশুশ্রমের যে বিষয়টি সেটা আপাতদৃষ্টিতে মনে হলেও পরিস্থিতি বুঝতে পারলে তা আর হবে না। কারণ এদের যদি আমরা কাজ না শেখাই, তাহলে দেখা যাবে এদের কেউ অভিভাবকহীন হয়ে বিপথগামী হচ্ছে। পরে পুরো সমাজ নষ্ট হবে।’

ব্যবসায়ীরা বলছেন, শিশুদের কাজ দিয়ে তাদের ভবিষ্যত সুরক্ষিত করছেন তারা।

ধোলাইখালের আরেক ব্যবসায়ী জামাল হোসেনর সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের। তার সঙ্গে ধোলাইখালের প্রায় ৫০ বছরের সম্পর্ক। জীবনের চৌদ্দ আনা এখানেই কেটেছে তার। গাড়ির সব ধরনের নাটবল্টুই আছে তার কাছে। সবই রিকন্ডিশন্ড, মানে পুরান গাড়ির। কীভাবে কর্মচারী থেকে ব্যবসায়ী হয়ে উঠলেন সেই গল্প শুনিয়ে বলেন, ‘আমরা চাইলে অনায়াসে বেতন দিয়ে দোকানে যুবক দেখে স্টাফ নিয়োগ দিতে পারি। কিন্তু ১০ থেকে ১২ বছর বয়সী যারা কাজ শিখতে আসে তাদের তো আমরা ফেলে দিতে পারি না।’

নিজের তুলনা টেনে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমার বয়স ৬০-৬২ বছর। আমি যখন ১০ বা ১২ বছরের ছিলাম তখন থেকেই এখানে। আজ আমার ঢাকা শহরে নিজস্ব বাড়ি আছে। এখন আমারে যদি তখন আমার মহাজনে কাজ না শিখাইতো দোকানে না রাখতো, তাহলে তো আজ আমার এই অবস্থা হতো না। বেকার বসে না থেকে কোন একটা কাজ জানা ভালো। তাহলে জীবনে কিছু একটা করা যাবে। যদি ছোট বলে আমরা গুরুত্ব না দেই তাহলে পরে দেখা যাবে আজেবাজে সঙ্গ পেয়ে খারাপ হয়ে গেলো।’

/ইউএস/
সম্পর্কিত
এডিস মশার বিস্তার নিয়ন্ত্রণে সবার সহযোগিতা চান মেয়র তাপস
ব্যাটারিচালিত যানবাহন ও চালকদের লাইসেন্সসহ চার দাবি
জেনারেল আজিজের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের বিষয়ে আগেই জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র
সর্বশেষ খবর
অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর করতে কাজ করছে বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়া
অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর করতে কাজ করছে বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়া
নিষেধাজ্ঞায় ‘বিস্মিত’ জেনারেল আজিজ, বললেন ‘এতে লাভ নেই’
বাংলা ট্রিবিউনকে সাক্ষাৎকারনিষেধাজ্ঞায় ‘বিস্মিত’ জেনারেল আজিজ, বললেন ‘এতে লাভ নেই’
টসে হেরে ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ
টসে হেরে ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ
বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের কিরগিজস্তান সফর
বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের কিরগিজস্তান সফর
সর্বাধিক পঠিত
১০০ লিচু ১০০০ টাকা, তবু দুশ্চিন্তায় এই গ্রামের চাষিরা
১০০ লিচু ১০০০ টাকা, তবু দুশ্চিন্তায় এই গ্রামের চাষিরা
সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা
সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা
সংসদীয় কমিটির তোপের মুখে টেলিটক
সংসদীয় কমিটির তোপের মুখে টেলিটক
পশু আমদানিতে সম্মতি দেবে না প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়
পশু আমদানিতে সম্মতি দেবে না প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়
ভোটারের অপেক্ষায় কুমিল্লার একটি কেন্দ্র
ভোটারের অপেক্ষায় কুমিল্লার একটি কেন্দ্র