ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তিন এলাকায় আগামী আগস্ট মাস থেকে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হচ্ছে নতুন নকশার ব্যাটারিচালিত ই-রিকশা। এসব রিকশাকে আনা হবে নিবন্ধনের আওয়ায়, চালকদেরও থাকবে লাইসেন্স। তবে বর্তমানে সড়কে চলমান ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা এখনই উচ্ছেদ হচ্ছে না, পুরনোগুলোর সঙ্গে চলবে নতুন ই-রিকশা। পর্যায়ক্রমে অনিবন্ধিত অটোরিকশা সরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি ই-রিকশার কার্যক্রম সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে কর্তৃপক্ষের। সংশ্লিষ্টদের আশা, এ উদ্যোগে নগরের ট্রাফিক ব্যবস্থায় ফিরবে শৃঙ্খলা।
অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগ নতুন নীতিমালা তৈরি করেছে। ‘সিটি করপোরেশন এলাকায় তিন চাকার স্বল্পগতির ব্যাটারিচালিত রিকশা (ই-রিকশা) চলাচল প্রবিধান, ২০২৫’ নামে এ নীতিমালায় ই-রিকশা নিবন্ধন ও চালকের লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পাশাপাশি চালকদের প্রশিক্ষণ, নিরাপদ ব্যাটারি ব্যবস্থাপনা, বিমা ও পার্কিং-চার্জিং অবকাঠামোসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, রাজধানীসহ দেশের সব সিটি করপোরেশন এলাকায় তিন চাকার স্বল্পগতির ব্যাটারিচালিত ই-রিকশার জন্য প্রণয়ন করা এই নীতিমালা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে নগরের ট্রাফিক ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। চালক ও যাত্রী উভয়ের জন্য নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত হবে। একই সঙ্গে দূষণহীন, নবায়নযোগ্য শক্তিনির্ভর পরিবহন ব্যবস্থার প্রসারে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে।
এছাড়াও, নতুন কাঠামোর মাধ্যমে ই-রিকশা নিবন্ধন, চালকের লাইসেন্স প্রদান, প্রশিক্ষণ, যানবাহনের গতি ও মান নিয়ন্ত্রণ, নির্দিষ্ট রুটে চলাচল, চার্জিং ও পার্কিং অবকাঠামো গড়ে তোলা এবং আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা– সব মিলিয়ে একটি সুশৃঙ্খল ও পরিবেশবান্ধব নগর পরিবহন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি হবে।
সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী, এসব নীতিগত ও প্রযুক্তিগত সহায়তার ফলে ই-রিকশা এখন থেকে আর অনিয়ন্ত্রিত নয়, বরং একটি বৈধ, নিয়মতান্ত্রিক ও কার্যকর যানবাহন হিসেবে নগরজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
হাইকোর্টের আদেশ ও কার্যক্রমের সূচনা
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে অভিযোগ রাজধানীবাসীর দীর্ঘদিনের। গত কয়েকবছর এটি বন্ধের উদ্যোগ নিলেও ব্যর্থ হয় সরকার। এমনকি হাইকোর্টের নির্দেশনাও উপেক্ষা করে সড়কে চলাচল করে এসব রিকশা। কেননা বন্ধের উদ্যোগ নিলেই বাধা ও প্রতিবাদ আসে এসব রিকশার চালকদের কাছ থেকে।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের ১৯ নভেম্বর হাইকোর্ট ঢাকা মহানগরীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলে প্রতিবাদ জানায় ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকরা। পরবর্তীতে এসব রিকশার চালক-মালিকের পক্ষ থেকে দায়ের করা একটি মামলায় একই আদালত ২৫ নভেম্বর এক মাসের জন্য স্থিতাবস্থা জারি করেন। এরই প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার বিভাগ ওই বছরেই ২৭ নভেম্বর বুয়েট প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে।
পরে একাধিক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় সিটি করপোরেশনকে নিবন্ধন ও লাইসেন্স প্রদানকারী সংস্থা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। সেই লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯ সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং সংশ্লিষ্ট অধ্যাদেশের খসড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়।
নিবন্ধন ও লাইসেন্স বাধ্যতামূলক, ফিটনেস ও বিমা সংযুক্ত
নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, সিটি করপোরেশন এলাকায় চলাচলকারী সব ই-রিকশার রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রতিটি যানবাহনকে নির্দিষ্ট রুট ও ওয়ার্ডভিত্তিক রেজিস্ট্রেশন নম্বর ও নম্বর প্লেট দেওয়া হবে। একটি জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৩টি রিকশা নিবন্ধনের সুযোগ রাখা হয়েছে। প্রতিটি রিকশার জন্য ইউনিক রেজিস্ট্রেশন নম্বর এবং দুই বছর পরপর ফিটনেস পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এসব রিকশাচালকের জন্য ১৮ বছর বয়স, বাংলা পড়া-লেখা জানার সক্ষমতা, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও স্বাস্থ্য পরীক্ষায় পাস বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এছাড়া চালকের ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা বিমা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। লাইসেন্স নবায়নে ৫ বছর অন্তর ড্রাইভিং পরীক্ষা দিতে হবে।
নির্ধারিত গতি ও রুট, ফুটপাতে চলাচল নিষিদ্ধ
প্রবিধানে উল্লেখ আছে, ই-রিকশা কেবল সিটি করপোরেশন ও ট্রাফিক বিভাগের নির্ধারিত রুটেই চলবে। হাইওয়ে, এক্সপ্রেসওয়ে, বাস রুট, কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা জোন এবং ফুটপাতে চলাচল নিষিদ্ধ। শহরে সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার (কি.মি.), স্কুল বা পদচারী এলাকায় সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ১৫ কি.মি. নির্ধারণ করা হয়েছে।
নকশা ও প্রযুক্তিগত মান নিশ্চিতকরণ
নতুন ই-রিকশার দৈর্ঘ্য ২৫০ সেন্টিমিটার ও প্রস্থ ১১০ সেন্টিমিটার সীমার মধ্যে থাকবে। লিথিয়াম আয়ন বা লেড অ্যাসিড ব্যাটারির ক্ষেত্রে নিরাপদ কেসিং ও ইনসুলেশন আবশ্যিক। প্রতিটি যানবাহনের আয়ুষ্কাল ৫ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া প্রত্যেক ই-রিকশা চালক ব্যতীত সর্বোচ্চ দুইজন যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। এর বেশি নিলে আইনভঙ্গ হিসেবে গণ্য হবে।
প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে ই-রিকশা চালকদের
নীতিমালার আলোকে, সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে ব্র্যাক এবং যুব উন্নয়ন অধিদফতরের মাধ্যমে চালকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রথম ধাপে ২০০ জন মাস্টার ট্রেইনারের প্রশিক্ষণ শুরু হচ্ছে ঢাকার ১০টি ভেন্যুতে। পরবর্তী ধাপে আরও ১০০ জন প্রশিক্ষণার্থীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
প্রশিক্ষণের আওতায় থাকবে ট্রাফিক আইন, রোড মার্কিং, যানজট এড়ানোর কৌশল, ব্যাটারির নিরাপদ ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ, যাত্রী পরিবহনের নিয়মাবলী প্রভৃতি।
ব্যাটারির পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থাপনা ও রিসাইক্লিং বাধ্যতামূলক
ই-রিকশায় ব্যবহৃত ব্যাটারির পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে প্রবিধানে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। উন্মুক্ত স্থানে ব্যাটারি ফেলা, পোড়ানো বা নিক্ষেপ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ব্যাটারি পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ ও সংগ্রহে পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র পাওয়া প্রতিষ্ঠান বা ডিলারদের মাধ্যমেই কাজ করতে হবে।
সোলার চার্জিং স্টেশন স্থাপন এবং ক্লিন এনার্জি ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান করা হবে। সিটি করপোরেশন ও অনুমোদিত রিসাইক্লিং প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাটারি সংগ্রহ ও পুনঃব্যবহারে সরাসরি কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
জরিমানা ও শাস্তির বিধান
নীতিমালা লঙ্ঘন করলে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯ অনুযায়ী শাস্তি বা জরিমানার বিধান রয়েছে। প্রয়োজনে পুলিশের সহায়তায় তা আদায় ও বাস্তবায়ন করা হবে।
প্রথমে ঢাকার তিন এলাকায় চালানো হবে ই-রিকশা
আগামী আগস্ট থেকে সড়কে বুয়েটের নকশায় তৈরি ই-রিকশা চলবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ।
শনিবার (২৮ জুন) ডিএনসিসি নগর ভবনে ই-রিকশা চালকদের প্রশিক্ষণে মাস্টার ট্রেইনার তৈরির কার্যক্রম উদ্বোধনকালে তিনি জানান, ঢাকা দক্ষিণ সিটির আওতাধীন পল্টন ও ধানমন্ডি এলাকা এবং উত্তর সিটির আওতাধীন উত্তরা এলাকায় প্রাথমিকভাবে চালু হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তৈরি তিন চাকার ব্যাটারিচালিত ই-রিকশা। তবে বর্তমানে এসব এলাকায় বিদ্যমান ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা উচ্ছেদ করা হবে না, এগুলোর পাশাপাশি চলবে নতুন ই-রিকশা। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে সরিয়ে নেওয়া হবে অনিবন্ধিত রিকশাগুলো।
ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, 'আমরা এই যানবাহনের ডিজাইনে নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছি। প্রশিক্ষিত চালকেরাই লাইসেন্স পাবেন এবং এই ব্যবস্থার মাধ্যমে নগরীতে রোড সেফটির একটি কার্যকর কাঠামো গড়ে উঠবে।'
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, 'জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম অংশীদার ছিলেন আমাদের রিকশাওয়ালা ভাইয়েরা। তাদেরকে যখন আমরা নিবন্ধন ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে লাইসেন্সিং সিস্টেমে আনবো, তখন আর কেউ তাদের অবৈধ বলার সুযোগ পাবে না। তারা যথাযথ নাগরিক মর্যাদা নিয়ে চলতে পারবেন।'