তিন বছরের মধ্যে সদ্যসমাপ্ত ২০২৩ সালের গড় বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি। ২০২১ সালে বায়ুমান সূচক ছিল ১৫৯ এবং ২০২২ সালে গড় বায়ুমান সূচক ছিল ১৬৩। এটা ২০২৩ সালে বেড়ে হয় ১৭১। তবে শুধু ডিসেম্বর মাস হিসাব করলে গত বছরের তুলনায় এবার এ মাসে দূষণের মাত্রা কিছুটা কম ছিল।
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এক গবেষণা থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়।
বাতাসে দূষণের ক্ষেত্রে যে মানদণ্ড ব্যবহার করা হয় তা হলো—এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই)। বিশেষজ্ঞরা জানান, সাধারণত ছয় ধরনের পদার্থ এবং গ্যাসের কারণে দূষণের মাত্রা বেড়ে যায়। এর মধ্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণা অর্থাৎ ‘পিএম (পার্টিকুলেটেড ম্যাটার) ২ দশমিক ৫’-কে ঢাকায় দূষণের জন্য বেশি দায়ী করা হয়। ক্ষতিকর ছয় ধরনের পদার্থের মধ্যে প্রথমেই আছে ‘পিএম ২ দশমিক ৫’ অথবা ২ দশমিক ৫ মাইক্রো গ্রাম সাইজের ক্ষুদ্র কণা। এরপর ‘পিএম-১০’ সবচেয়ে বেশি। বাকি চারটির মধ্যে আছে সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন, কার্বন মনোক্সাইড ও সিসা। এই ছয় পদার্থ ও গ্যাসের ভগ্নাংশ গড় করেই বায়ুর সূচক নির্ধারণ করা হয়। সেই সূচককে বলা হয় এয়ার কোয়ালিটি বা সংক্ষেপে একিউআই।
বায়ু বিশেষজ্ঞরা বলেন, একিউআই সূচক শূন্য থেকে ৫০ পর্যন্ত ‘ভালো’ বলে বিবেচিত হয়। ৫১ থেকে ১০০ ‘মোটামুটি’, ১০১ থেকে ১৫০ পর্যন্ত ‘সতর্কতামূলক’, ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত ‘অস্বাস্থ্যকর’, ২০১ থেকে ৩০০-এর মধ্যে থাকা একিউআই মাত্রাকে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ বলা হয়। আর ৩০১-এর বেশি স্কোরকে ‘বিপজ্জনক’ বা দুর্যোগপূর্ণ বলা হয়।
ক্যাপস জানায়, ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে বায়ুদূষণের মাত্রা ছিল ২২০। ২০১৭ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২০৪। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে দূষণ একটু বেড়ে হয় ২১১। ২০১৯ সালে আবার কমে গিয়ে হয় ২০৫। ২০২০ সালে অনেকটা বেড়ে হয় ২৩২। ২০২১ সালে আবার কমে হয় ২০৭। ২০২২ সালে বেড়ে ২৪৯ এবং ২০২৩ সালে তা এসে দাঁড়ায় ২২৮-এ। এ হিসাবে গত বছরের তুলনায় এবার দূষণের মাত্রা কম।
আবার সবচেয়ে কম বায়ুদূষণ সূচক ছিল ২০১৭ এবং ২০২০ সালে, যথাক্রমে ১৪৬ এবং ১৪৩।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বায়ুমান যাচাই করা একিউআই জানায়, সোমবার (১ জানুয়ারি) প্রায় সারা দিনই ঢাকা ছিল বায়ুদূষণের শীর্ষ অবস্থানে। সন্ধ্যা ৬টায় মাত্রা ছিল ২৬৯। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল পাকিস্তানের লাহোর, ২২৬। যুক্তরাষ্ট্রের হুসস্টোন ছিল তৃতীয় অবস্থানে, মাত্রা ২১৬। চতুর্থ অবস্থানে ছিল কলকাতা, ২০৫।
এর আগে সোমবার সকাল ৯টা ২১ মিনিটে ঢাকায় বাতাসের মান ছিল ২৫৩। তখনও ঢাকা ছিল শীর্ষ অবস্থানে। বায়ুর মানমাত্রা বিচারে এ মাত্রাকে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ বলা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঢাকায় বায়ুদূষণের জন্য মূলত ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধুলোকে দায়ী করা হয়। এই দূষণের ফলে অনেক বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এই দূষণ সব বয়সী মানুষের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে শিশু, অসুস্থ ব্যক্তি, প্রবীণ ও অন্তঃসত্ত্বাদের জন্য বায়ুদূষণ খুবই ক্ষতিকর।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার (২৮ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) উচ্চ আদালতের নির্দেশনা কার্যকর করতে পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর এক চিঠি পাঠায়। চিঠিতে বলা হয়েছে, ২২ মিলিয়নের (২ কোটি ২০ লাখ) বেশি লোকের শহর রাজধানী ঢাকা আন্তর্জাতিক ও জাতীয় বিভিন্ন সূচকে পরিবেশগত মানদণ্ডে পিছিয়ে রয়েছে। পৃথিবীর অযোগ্য শহরগুলোর তালিকায় ঢাকার অবস্থান সপ্তম। ঢাকা নগরীর বাতাস প্রায়শই বিশ্বে শীর্ষ দূষিত বাতাস হিসেবে চিহ্নিত হয়, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।
এতে আরও বলা হয়, ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে বেলা জনস্বার্থে একটি মামলা করে। সেই মামলার শুনানি নিয়ে ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ ও জনস্বাস্থ্য রক্ষায় বিবাদীদের ব্যর্থতা কেন বেআইনি, আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ও জনস্বার্থ পরিপন্থি ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত। একই সঙ্গে একটি সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং বায়ুর মান উন্নয়নের নির্দেশ কেন প্রদান করা হবে না তাও জানতে চাওয়া হয়। পাশাপাশি বায়ুদূষণের প্রধান উৎসসমূহ চিহ্নিতকরণ ও তা হ্রাসের সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং অস্বাস্থ্যকর, অতি অস্বাস্থ্যকর ও বিপজ্জনক বায়ু থেকে জনসাধারণকে রক্ষায় অ্যালার্ট সিস্টেম চালুর নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ-এর পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান কামরুজ্জামান মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গত ৮ বছরের তুলনায় গড়ে এই বছরে ১০ ভাগেরও বেশি বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা একটা বড় শঙ্কার বিষয়। আগের কয়েক বছরের ধরন অনুযায়ী, বাংলাদেশে সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বায়ুর মান এতটাই খারাপ থাকে যে এই পাঁচ মাসে সারা বছরের প্রায় ৬৫ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। এ বছরের নভেম্বর থেকে দেখা যাচ্ছে যে প্রতি তিন দিনের মাঝে যেকোনও একদিন দিনের কোনও না কোনও সময়ে ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত নগরীতে রূপান্তরিত হয়েছে এবং তার বায়ুর মান সূচক ৩৩০-এর ওপরে থাকছে।
বায়ুদূষণের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বায়ুদূষণে তিন ধরনের ক্ষতি হয়। একটি তাৎক্ষণিক, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি। তাৎক্ষণিক ক্ষতির মধ্যে যাদের শ্বাসতন্ত্রীয় রোগগুলো রয়েছে হাঁচি, কাশি, হাঁপানি—এসব রোগ যাদের আছে সেগুলো বেড়ে যায়। অ্যালার্জি বেড়ে যায়। ফাঙ্গাল ইনফেকশন জাতীয় রোগগুলো বাড়ে। ফুসফুসের প্রদাহ বাড়ে, নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা বাড়ে। মধ্যমেয়াদে এই অসুখগুলো বাড়তে বাড়তে ফুসফুসের সম্প্রসারণ ও প্রসারণ ক্ষমতা কমে যায়। পাশাপাশি বায়ুদূষণের মূল কারণ যে ক্ষুদ্র কণা, সেগুলো ফুসফুসের রন্ধ্রগুলো ছোট করে দেয়। পাশাপাশি রক্তে মিশে গিয়ে লিভার ও কিডনি অকার্যকর করে। দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার প্রধান শঙ্কা হচ্ছে ফুসফুসের ক্যান্সার। তাই এ বিষয়ে সচেতনতা ও সাবধানতা খুব জরুরি।