X
শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫
২৬ বৈশাখ ১৪৩২

প্রতিবেশগত সংকটে ১৩ এলাকা, নীতিমালা বাস্তবায়নে সক্রিয় হচ্ছে সরকার

সালমান তারেক শাকিল
০৫ জুন ২০২৪, ১৩:০২আপডেট : ০৫ জুন ২০২৪, ১৩:০২

কালের সাক্ষী হয়ে আছে ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জের ‘মারজাত বাঁওড়’। উপজেলার কাষ্টভাঙ্গা ইউনিয়নে অশ্বখুরাকৃতির এই হ্রদকে কেন্দ্র করে আশপাশে হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসব হয়। পূজাকে কেন্দ্র করে হাজার মানুষের সমাগমও ঘটে। আধা মাইল চওড়া ও সাত মাইল লম্বা সরকার নিয়ন্ত্রিত এই হ্রদটিকে ১৯৯৯ সাল থেকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইকোলোজিকালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া বা ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করে। যদিও গেলো ২৫ বছরেও হ্রদটিতে মাছধরা বন্ধ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।

‘মারজাত বাঁওড়’ হ্রদের মতো পরিস্থিতি ঢাকা মহানগরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদীর ক্ষেত্রেও। ইসিএ ঘোষিত এই চারটি নদীর (ঢাকার চারপাশে) বর্তমান অবস্থারও খুব একটা পরিবর্তন নেই। ঢাকা মহানগরের ময়লা, আবর্জনা, স্যুয়ারেজের তরল ময়লা, দূষণ সবই যেন এই চার নদীমুখী। বুড়িগঙ্গায় নিয়মিত পড়ছে লঞ্চের ময়লা, বর্জ্যও।

পরিবেশ, বন, জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বাংলা ট্রিবিউনকে বলছেন, ইসিএ বাস্তবায়নে সক্রিয় রয়েছে মন্ত্রণালয়। আগামী কিছুদিনের মধ্যেই ইসিএ বাস্তবায়নে উদ্যোগগুলো সামনে আসবে। যদিও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ‘সংশ্লিষ্ট লোকবল’ ও ‘আর্থিক সংকট’ বড় সমস্যা সৃষ্টি করছে বলেও জানান কর্মকর্তারা। 

কালীগঞ্জের মারজাত বাঁওড়

পরিবেশ অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও পরিবেশগত মানোন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারের ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সর্বশেষ সংশোধিত ২০১০)’ অনুসারে বিভিন্ন সময়ে কিছু এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ পর্যন্ত দেশের ১৩টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। 

এগুলোর মধ্যে ১৯৯৯ সালে ইসিএ ঘোষণা করা হয়, সুন্দরবন (রিজার্ভ ফরেস্টের চারদিকের ১০ কিলোমিটার); কক্সবাজার-টেকনাফ সমুদ্র সৈকত; সেন্টমার্টিন দ্বীপ; সোনাদিয়া দ্বীপ; হাকালুকি হাওর; টাঙ্গুয়ার হাওর ও মারজাত বাঁওড় হ্রদ। ২০০১ সালে রাজধানীর গুলশান ও বারিধারা লেকটিকে ইসিএ ঘোষণা করা হয়। ২০০৯ সালে বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদীর ঢাকা মহানগরের আশপাশের এলাকার অংশগুলোকে এবং ২০১৫ সালে জাফলং-ডাউকি নদীটিকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার আওতাভুক্ত করা হয়।

দখল-দূষণে বিপর্যস্ত বালু নদও (ফাইল ছবি)

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ১৯৯৯ সালে ইকোলোজিকালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া বা ইসিএ ঘোষণা করা হলেও বিধিমালা হয় আরও পর। ২০১৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০১৬’ ঘোষণা করে।

ইসিএ এলাকায় ৯টি কার্যক্রম নিষিদ্ধ। এসব কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে, প্রাকৃতিক বন ও গাছপালা কর্তন বা আহরণ; সব প্রকার শিকার ও বন্যপ্রাণী হত্যা; ঝিনুক, কোরাল, কচ্ছপ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণী ধরা বা সংগ্রহ; প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংসকারী সব প্রকার কার্যকলাপ এবং ভূমি এবং পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট বা পরিবর্তন করতে পারে এমন সব কাজ।

এছাড়াও মাটি, পানি, বায়ু এবং শব্দ দূষণকারী শিল্প বা প্রতিষ্ঠান স্থাপন; মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর ক্ষতিকারক যে কোনও প্রকার কার্যাবলি; নদী-জলাশয়-লেক-জলাভূমিতে বসতবাড়ি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পয়ঃপ্রণালীসৃষ্ট বর্জ্য ও তরল বর্জ্য নির্গমন এবং কঠিন বর্জ্য অপসারণ এবং যান্ত্রিক বা ম্যানুয়াল বা অন্য কোনও পদ্ধতিতে পাথরসহ অন্য যে কোনও খনিজসম্পদ আহরণও নিষিদ্ধ রয়েছে ইসিএ এলাকায়।

যদিও এই নিষিদ্ধ কার্যক্রম বন্ধ হয়নি ইসিএ ঘোষিত এলাকাগুলোয়। বুড়িগঙ্গা নদীর পরিবেশে কোনও পরিবর্তন আসেনি। সরেজমিনে দেখা গেছে, লঞ্চ থেকে নিয়মিত ময়লা ফেলা হচ্ছে। ঢাকা মহানগরের অধিকাংশ স্যুয়ারেজের ময়লা যাচ্ছে সরাসরি এই বুড়িগঙ্গায়।

মঙ্গলবার (৪ জুন) বিকালে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা হয় সদরঘাটের পারাবত লঞ্চের স্টাফ সাইফুরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আগে লঞ্চে এসে ময়লা নিয়ে যেতো সিটি করপোরেশনের লোক। আমরা ময়লা জড়ো করে রাখতাম। তারা এসে নিয়ে যেতো। কয়েকমাস তারা ময়লা নিতে আসে না। এখন আমরা আমাদের মতো ব্যবস্থা করি। কেউ নদীতে ফেলে আর কেউ ঘাটে ফেলে আসে।’

সদরঘাটে অপেক্ষারত লঞ্চের পাটাতনে জমে থাকা ময়লা-আবর্জনা। দিনশেষে এসব গিয়ে পড়ে নদীতে

লঞ্চের ময়লা নদীতে ফেলার কারণ জানতে চাইলে ফারহান-২ লঞ্চের স্টাফ দেলোয়ার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা লঞ্চের ময়লা বাইরে ফেলি। কিন্তু লঞ্চ ধোয়া পানি তো ফেলা হয় নদীতে। এসব ময়লা পানির সঙ্গে চলে যায়, আর বুড়িগঙ্গার পানি তো এমনিতেই ময়লা।’ 

এ প্রসঙ্গে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সদস্য (অবৈতনিক) মালিক ফিদা আব্দুল্লাহ খান বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ইসিএ ঘোষিত এলাকাগুলোকে রক্ষা করতে নীতিমালা করেছে পরিবেশ, বন, জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত প্রতিষ্ঠান পরিবেশ অধিদফতর মৌজা ও দাগভিত্তিক ইনফরমেশন সিস্টেম তৈরি করছে। তারপর তারা হয়তো ইসিএ বাস্তবায়নে স্থানীয় প্রশাসনকে সেই তথ্য দেবে। তারপর প্রশাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’

মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার মন্তব্য, ‘ওয়াসার ময়লা, সিটি করপোরেশনের ময়লা, সুয়োরেজের ময়লা সব ঢাকার আশেপাশের চার নদীতে পড়েছে। আমাদের তরফে ওয়াসা, সিটিকেও বারবার তাগাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনও অগ্রগতি নেই। এগুলো বন্ধ করতে পারলে আমরা বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষা নদীকে ঠিক করতে পারবো। এমনকি আমরা শিল্প কারখানাগুলোকেও চাপ দিচ্ছি দূষণবন্ধে।’

বুড়িগঙ্গা নদীর মতো ইসিএ ঘোষিত ‘মারজাত বাঁওড়’। ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার কাষ্টভাঙ্গা ইউনিয়ন এলাকার অশ্বখুরাকৃতির এই হ্রদটিতে নিয়মিত মাছ আহরণ করছেন ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রভাবশালী নেতার ভাগনে। ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, ভারতে খুনের শিকার সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের একজন ‘ভাগনে’ নিয়মিত মাছ আহরণ করছেন হ্রদ থেকে। 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্থানীয় কাষ্টভাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আয়ুব হোসেন খান এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি তো পরিবেশ অধিদফতরের কমিটিতে আছি। স্থানীয় পরিবেশ অধিদফতরে অভিযোগ গিয়েছিল শুনেছি, পরে ডিডি (সহকারী পরিচালক) এসে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে যান। যদিও কোনও কাজ হচ্ছে না বলে অনেকে অভিযোগ করছেন। আমি আশা করি, পরিবেশ অধিদফতর এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবে।’

দূষণের শিকার বুড়িগঙ্গা (ছবি: সাজ্জাদ হোসেন)

যদিও লোকবল ও আর্থিক সংকটের কারণে ইসিএ ম্যানেজমেন্ট করতে পারছে না পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার ভাষ্য, প্রথম সমস্যা হচ্ছে ইসিএ ঘোষিত ১৩টি এলাকাই পর্যটন এলাকা। এসব এলাকায় মনুষ্যসৃষ্ট সংকটই এই এলাকাগুলোকে অস্তিত্ব সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বাজেট সমস্যার কারণে ইসিএ বাস্তবায়নে ধীরগতি ছিল, যা এখন কাটতে শুরু করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন কোনও-কোনও কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ অনুবিভাগ) ফাহমিদা খানম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেশের ১৩টি ইকোলোজিকালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া বা ইসিএ রয়েছে। আমরা ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান তৈরি করছি। ইসিএ কার্যকর করতে গিয়ে অনেক ধরনের সমস্যাও রয়েছে। অনেকের জমির প্রশ্ন রয়েছে, ব্যক্তিগত জমি রয়েছে। সবকিছু ম্যানেজ করে এটা বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে।’

‘সবকিছু ম্যানেজ করেই ডিমারকেশনের (সীমানির্ধারণ) কাজ চলছে’ বলে উল্লেখ করেন অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ অনুবিভাগ) ফাহমিদা খানম। তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমরা কক্সবাজারের রিমারকেশনের কাজ শেষ করছি। পর্যায়ক্রমে আমরা সবগুলো এলাকারই মৌজা ও দাগ নম্বর ম্যাপিং করে কাজ সম্পন্ন করবো।’

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, বিশ্ব ব্যাংকের একটি বড় অংকের লোনের ইন্টারেস্ট দিয়ে ইসিএ বাস্তবায়নে ফান্ড ম্যানেজমেন্টের প্রক্রিয়া চলমান। এ বিষয়টি সম্ভব হলে ইসিএ বাস্তবায়নে আরও অগ্রগতি আসবে, এমনটিই প্রত্যাশা।

/ইউএস/
সম্পর্কিত
কেরানীগঞ্জে অবৈধ ব্যাটারি কারখানা সিলগালা
বুড়িগঙ্গায় বর্জ্য নিষ্কাশন: পরিবেশ অধিদফতরের যৌথ অভিযান
পরিবেশ দূষণের দায়ে জরিমানা, পলিথিন জব্দ
সর্বশেষ খবর
মাদ্রাসাসহ সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবি
মাদ্রাসাসহ সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবি
ভারত-পাকিস্তান ড্রোন যুদ্ধ: দক্ষিণ এশিয়ায় সংঘাতের নতুন অধ্যায়
ভারত-পাকিস্তান ড্রোন যুদ্ধ: দক্ষিণ এশিয়ায় সংঘাতের নতুন অধ্যায়
মৌলভীবাজার সীমান্তে দুই দিনে আটক ৫৯ জনকে পুলিশে হস্তান্তর
মৌলভীবাজার সীমান্তে দুই দিনে আটক ৫৯ জনকে পুলিশে হস্তান্তর
লেভারকুসেনকে বিদায় বললেন জাবি, যাচ্ছেন রিয়ালে!
লেভারকুসেনকে বিদায় বললেন জাবি, যাচ্ছেন রিয়ালে!
সর্বাধিক পঠিত
জার্সি পরেই যমুনার সামনে দায়িত্বে রমনার ডিসি মাসুদ আলম
জার্সি পরেই যমুনার সামনে দায়িত্বে রমনার ডিসি মাসুদ আলম
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পদত্যাগ করলেন স্নিগ্ধ
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পদত্যাগ করলেন স্নিগ্ধ
রাতভর নাটকীয়তার পর সকালে গ্রেফতার আইভী, দিলেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান
রাতভর নাটকীয়তার পর সকালে গ্রেফতার আইভী, দিলেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান
তিন শিক্ষক আর পাঁচ শিক্ষার্থী দিয়ে চলছে সরকারি বিদ্যালয়
তিন শিক্ষক আর পাঁচ শিক্ষার্থী দিয়ে চলছে সরকারি বিদ্যালয়
আবদুল হামিদের দেশত্যাগ: কিশোরগঞ্জের এসপি প্রত্যাহার
আবদুল হামিদের দেশত্যাগ: কিশোরগঞ্জের এসপি প্রত্যাহার