বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক দীপক শীল বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রসংগঠনগুলোর সহাবস্থান এখন একটি স্মৃতিলব্ধ ব্যাপার। তার ভাষ্য, ঢাবিসহ দেশের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রসংগঠনগুলোর সহাবস্থান এখন কাগজে-কলমে বন্দি।
সম্প্রতি বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে দীপক শীল এ মনোভাব প্রকাশ করেন। এসময় তিনি আগামী নির্বাচন, ঢাবিতে শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া ও বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলেন।
বাংলা ট্রিবিউন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সহাবস্থানের চিত্রটা এখন কেমন?
দীপক শীল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংগঠনগুলোর সহাবস্থান অতীত স্মৃতিতে বন্দি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহাবস্থান খাতা-কলমে এবং ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন নিয়ে গঠিত পরিবেশ পরিষদের মিটিং পর্যন্ত বন্দি অবস্থায় রয়েছে। শিক্ষা অধিকার আদায় থেকে মধুর ক্যান্টিন—সবখানে সব ছাত্রসংগঠনের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে দাস তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে।
ছাত্রদের অনেকে ‘আই হেট পলিটিক্স’ ধারণা লালন করছে এবং তারা রাজনীতিবিমুখ হচ্ছে! বিষয়টি কীভাবে দেখেন?
দীপক শীল: বাংলাদেশের ছাত্র সমাজের গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের ইতিহাস আমাদের জানা আছে। বায়ান্ন'র ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রসমাজ অসামান্য ভূমিকা রেখেছে। সেই ছাত্রসমাজ আজ রাজনীতিবিমুখ হচ্ছে। কারণ, শাসকশ্রেণি নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়া এবং শাসনক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য ছাত্রদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। তারা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করেছে। ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে শিক্ষাঙ্গনের শান্তি ও সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট করেছে। ছাত্রসমাজ আজ নিজস্বতা হারাচ্ছে। হলগুলোতে দখলদারিত্ব আর ভর্তি বাণিজ্য চলছে। ছাত্র সংসদ নির্বাচন হচ্ছে না। ফলে সাধারণ ছাত্ররা রাজনীতিতে আগ্রহ হারাচ্ছে। গত চার দশক ধরে চলে আসা বিরাজনীতিকরণের ফলে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। অবস্থার উত্তরণে গণতান্ত্রিক সমাজকাঠামো একান্ত প্রয়োজন। সাধারণ শিক্ষার্থীরা শাসকশ্রেণির দুরভিসন্ধি বুঝতে পারছে। তারা এ অচলায়তন ভেঙ্গে আলোকিত ঐতিহ্যের ধারায় রাজনীতিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবে অচিরেই। জীবনের জন্যই রাজনীতি। সুতরাং আই লাভ পলিটিক্স বলতে তারা পিছপা হবে না।
ডাকসু কমিটি এক বছরের ওপর মেয়াদোত্তীর্ণ। ডাকসুর নির্বাচন নিয়ে আপনাদের ভাবনা কী? অনিয়মিত ডাকসু নির্বাচনের দায়ভার কোনোভাবে ছাত্রসংগঠনগুলোর ওপর বর্তায় কিনা?
দীপক শীল: দীর্ঘদিন পর ২০১৯ সালে সর্বশেষ ডাকসুর নির্বাচন হলেও সেটি ছিল একটি ব্যালট ছিনতাই ও কারচুপির নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচনের অনুকরণে এখানেও ছাত্রলীগ প্রায় সব পদ বাগিয়ে নেয় এবং দুটি পদ ভিন্ন প্যানেলের দুজনের জন্য ছেড়ে দেয়। এরকম একটি জালিয়াতির নির্বাচনের পর প্রায় সব বিরোধী ছাত্রসংগঠনের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠলেও পদের লোভে ছাত্র অধিকার পরিষদের দুই নেতা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এসে শপথ পাঠ করে ভোট চুরির ডাকসু নির্বাচনের বিরুদ্ধে অনশনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। এসব কারণে এই ডাকসু কখনোই কার্যকর ভূমিকা তো রাখতেই পারেনি; বরং ডাকসুকে ঘিরে অতীতে শিক্ষার্থীদের যে উচ্ছ্বাস ও আগ্রহ ছিল সেটি মারাত্মকভাবে হোঁচট খায়।
ক্যাম্পাসে ছাত্রসংগঠনগুলোর সহাবস্থান নিশ্চিতে ডাকসুর ভূমিকা কতটুকু বলে আপনি মনে করেন?
দীপক শীল: সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত কার্যকর ডাকসু অবশ্যই সহাবস্থান নিশ্চিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারতো। কিন্তু ষড়যন্ত্র, আঁতাত ও কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচিত নেতৃত্ব সেই সহাবস্থান নিশ্চিতে কোনও ভূমিকা রাখতে পারেনি। বরং বিগত ডাকসু নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীনদের একচ্ছত্র আধিপত্য আরও বেপরোয়া হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট কমাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৃহীত মাস্টারপ্ল্যান কতটুকু ভূমিকা রাখবে বলে আপনি মনে করেন?
দীপক শীল: আবাসন সংকট কমিয়ে আনতে বিশ্ববিদ্যালয় গৃহীত মাস্টারপ্ল্যান হয়তো অবকাঠামো নির্মাণ করে সিট সংখ্যা বৃদ্ধি করবে। কিন্তু সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠনের সিট বাণিজ্য, দখলদারিত্ব, গেস্টরুম নির্যাতন কী কমবে? আমি মনে করি, এগুলো আরও বৃদ্ধি পাবে। মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে পরিবেশ পরিষদের সঙ্গে মিটিংয়ের দাবি করেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে। কিন্তু প্রশাসন করলো না। এতে আমাদের মনে হয়েছে—শতবর্ষের বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ধ্বংস করতে ১০ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের নামে মেগা দুর্নীতি-লুটপাট- দখলদারিত্বের আয়োজন করা হচ্ছে।
ব্যক্তিপর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম বয়ে আনলেও উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে ঢাবির অবস্থান হতাশাজনক। এর পেছনে শিক্ষক রাজনীতির কোনও দায় দেখছেন কিনা?
দীপক শীল: শিক্ষকসমাজ বাংলাদেশের নাগরিক। সুতরাং তারা তাদের নাগরিক অধিকার ভোগ করবেন এটাই স্বাভাবিক। রাজনীতি নাগরিক অধিকার। পেশা ও পেশাজীবীর স্বার্থে শিক্ষক রাজনীতি আবর্তিত হবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। শিক্ষকসমাজ দলীয় রাজনীতির সেবাদাস হবেন না, তারা মুক্ত বিবেক প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখবেন। শিক্ষা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় শিক্ষক রাজনীতি ভূমিকা রাখবে এটা সবার প্রত্যাশা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ যেকোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়াতে গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির কোনও বিকল্প নেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষক সংগঠনগুলো এ বিষয়ে উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নসহ প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের সহযাত্রী হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত 'স্মার্ট বাংলাদেশ'—বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
দীপক শীল: স্মার্ট বাংলাদেশ একটি রাজনৈতিক স্লোগান। লুটপাটের অর্থনীতি, দুর্নীতিবাজ প্রশাসন ও দলীয়করণের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। এ অবস্থা থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে চায় বর্তমান সরকার। তাই এ স্লোগান।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে আপনার সংগঠনের পরিকল্পনা কী?
দীপক শীল: জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে রাজনৈতিক দলগুলো। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন একটি স্বাধীন ছাত্র গণসংগঠন। আমরা ছাত্রসমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে থাকি। আমরা চাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ। আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করি। আমরা বিজ্ঞানমনষ্ক জাতি গঠনে একমুখী সর্বজনীন শিক্ষানীতি চাই। আমরা বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে চলি। গত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার হরণ করেছে ক্ষমতাসীনরা। সুতরাং গণমানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গঠনে সংগ্রামরত প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের প্রতি আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকবে।