জন্মদিনে বাবাকে কাছে পাওয়া হলো না মেয়ের

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষক মুবাশ্বার হাসান সিজারের খোঁজ মেলেনি ২০ দিনেও। বাবা নিখোঁজের ঠিক কুড়ি দিন পর ২৭ নভেম্বর মেয়ে আরিয়ানার জন্মদিন। কিন্তু মুবাশ্বার আজ কতদূরে, কোন অজানায়! এই উত্তর নেই বলে ষষ্ঠ জন্মদিনে বাবাকে কাছে পাওয়া হলো না মেয়ের। এ নিয়ে মুবাশ্বারের বোন তামান্না তাসমিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন। রবিবার দিবাগত রাতে তিনি এটি পোস্ট করেন।
ফেসবুকে স্ট্যাটাসের শুরুতে তামান্না তাসমিন ‘ব্রিং ব্যাক মুবাশ্বার’ লিখে হ্যাশট্যাগ দিয়েছেন। এরপর তিনি লিখেছেন, ‘নিজের সন্তান না থাকলে নাকি বাবা-মায়ের উৎকণ্ঠা বোঝা যায় না। হয়তো… কিন্তু নিজের সন্তান থেকে দূরে থাকার যে কি যন্ত্রণা, তা আমার ভাইয়াকে দেখে ওর আশেপাশের সবাই বুঝতো। মেয়ের প্রতি ওর ভালোবাসা অন্য বাবাদের চেয়ে অনেক আলাদা। কারণ চাইলেই সবসময় মেয়েকে কাছে পেতো না ও। এত সৌভাগ্য ছিল না ওর যে, ইচ্ছে হলেই নিজের মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরবে। সেই মানুষটা মেয়ের জন্মদিনে কতদূরে, কোন অজানায়।’
এ স্ট্যাটাসে জানা যায়, প্রতি শুক্রবার আরিয়ানাকে সময় দিতেন মুবাশ্বার। তামান্না তাসমিনের স্ট্যাটাস অনুযায়ী— ‘আমার সদা ব্যস্ত ভাইয়ের শুক্রবার মানেই ছিল আরিয়ানা দিবস। বাপ-বেটি শুক্রবার সারাদিন টইটই করে ঘুরবে, খেলবে। ভাইয়ার চেহারায় সেই একটা দিন অন্যরকম খুশি লেগে থাকতো। সেদিন কখনও অন্য কোনও কাজ রাখতো না ও। যেন গোটা দুনিয়া উল্টে গেলেও ওর কিছু যাবে আসবে না।’
এ বিষয়ে একটি উদাহরণ দিয়েছেন মুবাশ্বারের বোন। গত বছরের কোরবানি ঈদের সময়ের কথা। বাবাকে নিয়ে মুবাশ্বার হাটে গিয়েছিলেন গরু কিনতে। কিন্তু গরু নিয়ে একা বাসায় ফিরলেন বাবা। কারণ হঠাৎ মুবাশ্বার জানতে পেরেছেন আরিয়ানা আজ দেখা করবে। ব্যস, সব ছেড়েছুড়ে দৌড় দিলেন!’
স্ট্যাটাসে তামান্না আরও লিখেছেন, “আমার ভাইয়ের গোটা দুনিয়া জুড়ে আছে এই ছোট্ট মেয়েটা। মেয়েই ওর বন্ধু, ওর বাঁচার সবচেয়ে বড় অবলম্বন। প্রতিদিন ভাইয়া বাবুর (আরিয়ানা) ন্যানিকে কল দিয়ে বলতো— ‘এই, আমার মেয়ে কি করে রে?’ বাবু জেগে থাকলে অল্প কিছুক্ষণ কথা হতো। বাবা-মেয়ের যোগাযোগ বলতে শুক্রবারের দেখা হওয়া আর এই ফোনে কথাটুকুই। এই আধো আধো বুলিতেই যে এত মায়া, এত ভালোবাসা।”

শেষবার দেশের বাইরে যাওয়ার সময় ঘর থেকে বের হওয়ার আগে আরিয়ানাকে কল দিয়ে মুবাশ্বার বলেছিলেন, ‘আম্মু, বাবা বাইরে যাচ্ছি। অনেক লম্বা জার্নি। তুমি দোয়া করো বাবার জন্য, কেমন?’ এই কথা জানিয়ে তামান্না লিখেছেন, ‘আমি জানি খুব ভালো করেই এই এতটুকু কথা না বলে ফ্লাইটে উঠতে হলে ভাইয়ার জার্নি শান্তির হতো না।’

এমন আরেকটি ঘটনা জানা গেলো স্ট্যাটাসে। আরিয়ানা একবার বলেছে, ‘আব্বু ভিডিও কল দাও, তুমি কোন পনি কিনেছো আমি দেখি!’ কিন্তু নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে ভিডিও কল কাজ করছিল না। যতক্ষণ না ভিডিওতে মেয়েকে পরিষ্কারভাবে দেখা গেছে, বোনকে মোটামুটি অস্থির করে রেখেছিলেন মুবাশ্বার। যত অপশন আছে ভিডিও কল করার, সব ন্যানিকে ফোনে বুঝিয়ে ও নির্দেশনা দিয়ে নামাতে হয়েছিল।

মুবাশ্বার যদি কখনও শুনতেন মেয়ে অসুস্থ, তখন তার অসহায়ত্বটা আরও প্রখর হয়ে উঠতো বলে জানান তামান্না তাসমিন। ন্যানিকে কল দিতেন বারবার। বাসায়ও সেই সময় কারও সঙ্গে তেমন কথা বলতেন না।

বোনের লেখায়— “আমার সদা হাস্যোজ্বল ভাইয়ের মুখ গোমরা থাকলে আন্দাজ করতে পারতাম, হয় আরিয়ানার সঙ্গে কথা হয়নি নয়তো বাবু অসুস্থ। বাবুর প্রতিটা কথা, প্রতিটা আবদার ওর জন্য ছিল মহামূল্যবান ব্যাপার। বাবুর কোনও কোনও কথা বিশ্লেষণের সময় ও বলতো— ‘দেখছো ও কতো বিচক্ষণ, মাশাল্লাহ। ও অনেক নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে সবকিছু, বুঝছো!’ গোটা দুনিয়া চষে বেড়ানো ছেলেটা শুধু এই ছোট্ট দুটি হাতের বাঁধনে বাধা ছিল।”

তামান্না তাসমিন আরও জানিয়েছেন, আরিয়ানার জন্মদিন মানে তাদের বাড়ির সবচেয়ে বড় উৎসব। গতবার বড়সড় করে ওর জন্মদিন হয়েছিল বাড়ির বাইরে। রেস্টুরেন্ট, গেমস, ম্যাজিক, কেক সব একাই সামলেছিলেন মুবাশ্বার। তার বোন লিখেছেন, ‘যেন পারলে ওই একটা দিন বাবুর পায়ে গোটা দুনিয়া এনে দেয়!আর আজ… বাবুর ষষ্ঠ জন্মদিনে কোথায় ও? এতদিন ভাইয়া কেমন ছিল জানি না। কিন্তু আমি জানি, আজ কাঁদছে ও। আমি জানি আজ নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে দুর্ভাগা মানুষ মনে করছে ও। আজ বাবুকে কোলে নিতে না পারার কষ্টে ওর বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। আজ বাবুর কণ্ঠে বাবা ডাকটা শোনার জন্য ওর ব্যাকুলতা মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের বাঁচার জন্য আকুলতার চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।’

তামান্না তাসমিন মনে করেন, এবারও নিজের সাধ্যের মধ্যে ধুমধাম করেই একমাত্র মেয়ের জন্মদিন উদযাপন করতেন মুবাশ্বার। এ প্রসঙ্গে স্ট্যাটাসটিতে লেখা রয়েছে, ‘কিন্তু পারলো না। এত মানুষের এত কান্না, এত অনুরোধ, কিছুতেই কিছু হলো না। একমাত্র মেয়ের জন্মদিনে বাপ-বেটির এক হওয়া হলো না।’

স্ট্যাটাসের শেষ দিকে সবার উদ্দেশে মুবাশ্বারের বোন লিখেছেন, ‘আমি জানি, আমার ভাই নিখোঁজ হওয়ায় কারও কিছু যায় আসে না। এত কোটি মানুষের ভিড়ে সন্তানের জন্য একটা বাবার এই দুর্বিষহ হাহাকার হয়তো খড়ের গাদায় সুঁইয়ের মতোই। কিন্তু তবুও একটা অনুরোধ করতে চাই— আমার ভাইয়ের জায়গায় নিজেকে একটু রেখে কল্পনা করেন তো! বেশি না, মাত্র দুই মিনিট… জানি পারেননি… আমি বাজি রেখে বলতে পারি। ঠিকই আপনারা ছুটে গিয়ে নিজের সন্তানকে জড়িয়ে ধরেছেন।’

সবশেষে তামান্না তাসমিনের প্রশ্ন— “আমার ভাইয়ের কষ্ট কি একটু হলেও অনুধাবন করতে পারেন আপনারা এখন? তাহলে বলেন, আমার ভাইটা কেন পারবে না তার একমাত্র মেয়ের জন্মদিনে মেয়েকে কোলে নিতে? একটা ছয় বছরের অবুঝ শিশুকে কেন মিথ্যা কথা বলে ভুলিয়ে রাখতে হবে? আপনি দুই মিনিট পারেননি, সেখানে আমার ভাই ২০টা দিন ধরে তার মেয়ের কাছ থেকে দূরে আছে। সে এতটাই অভাগা যে, মেয়ের জন্মদিনে শুভেচ্ছা পর্যন্ত জানাতে পারলো না, আদর করে দিতে পারলো না। বলতে পারলো না— ‘আম্মু, আমি তো দূরে আছি, আমার জন্য তুমি দোয়া করো!’ বাবুর আধো আধো কণ্ঠে ‘বাবা’ ডাকটা শুনতে পারছে না ও।”

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোসিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুবাশ্বার হাসান সিজার গত ৭ নভেম্বর বিকাল থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। এ বিষয়ে ঢাকার খিলগাঁও থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন সিজার। একসময় সাংবাদিকতাও করেছেন। পরে যুক্তরাজ্যে মাস্টার্স ও অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি করেন তিনি।