এবারের শীতকালটা অন্য বছরগুলোর তুলনায় দীর্ঘ হলো কী? যাবো যাবো করেও না যাওয়ায় বারবারই ভাঁজ করা কম্বলটা আলমারিতে তুলতে পারেননি এখনও। এখনও হুট করে শেষ রাতে বেশ ঠান্ডায় কেঁপেও উঠছেন। এরই মাঝে দখিনা হাওয়ার মনটাও কি একটু উদাস হয়ে একা বসে থাকতে চাইছে? এই আসা-যাওয়ার মাঝেই শীতের নাচন বন্ধ না হতেই এবার ক্যালেন্ডারের পাতায় বসন্ত জাগ্রত। আর ক্যালেণ্ডার বদলানোর সঙ্গেই কুয়াশা ঢাকা সকালগুলো অবগুণ্ঠন খুলে ঝলমলে হয়ে ধরা দিচ্ছে যেন। হরেক রকম ফুল, মাঝ দুপুরের ঝুপ করে চুপ রোদ কথা রেখেছে। আজ বসন্তের শুরু। ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় আজ বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।
ইটকাঠ-কংক্রিটের রাজধানীর কৃত্রিম পরিবেশে বসন্তে প্রকৃতির বদলে যাওয়া সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ খুব বেশি পাওয়া যায় না হয়তো। তারপরও নগরবাসী নিজেদের মতো করে ঋতুবৈচিত্রকে আলাদা করে নেয়। হাজার ব্যস্ততার মধ্যে সেটা উদযাপনও করে। রঙ বেরঙের পোশাকের বাহারি ফুলেল উপস্থিতিতে সে এক অন্যরকম সময়। চারুকলা থেকে বটতলা, অমর একুশের গ্রন্থমেলা থেকে শুরু করে উদ্যান সবখানে রঙ আর রঙ।
এবারের বসন্ত অন্যরকম
পার্কগুলোতে নবীনদের প্রাণখোলা আড্ডা থাকবে, ঘুরে এসে পারিবারিকভাবে রেস্টুরেন্টে খাওয়া থাকবে, নতুন পোশাকের ছোঁয়া থাকবে এবারও। কিন্তু ভালোবাসা দিবস ও পহেলা ফাল্গুন একদিনে হওয়ায় সবকিছুই একটু ভিন্নতা নিয়ে হাজির হবে এবার। পোশাকের রঙ কী হবে? ফাল্গুনের হলুদ নাকি ভালোবাসা দিবসের লাল? এবারে কয়েকবছর পরে শীতের মধ্যেই বসন্তের আমেজ মিলবে। এবার বসন্ত অন্যরকম, এবার মুজিববর্ষের উদযাপনের মধ্যে আছে দেশ।
পহেলা ফাল্গুনে ভালোবাসা দিবস
বদলে গেছে বাংলা বর্ষপঞ্জি। নতুন সংশোধিত বর্ষপঞ্জিতে পহেলা ফাল্গুন অর্থাৎ বসন্তের প্রথম দিনেই হচ্ছে ভালোবাসা দিবস। ইংরেজি বর্ষপঞ্জির ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালন করা হয় সারাবিশ্বে, আর বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বসন্তের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা ফাল্গুন ছিল ১৩ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু বাংলা বর্ষপঞ্জি সংশোধনের পর একই দিনে পড়ছে বসন্ত উৎসব আর ভালোবাসা দিবস।
আজি দখিন দুয়ার খোলা
বসন্ত শুধু শুধু উচ্ছ্বাসের রঙ ছড়ায় না, ঋতুরাজের সঙ্গে আছে ইতিহাসের সংযোগ। আমাদের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শহীদদের রক্তে রঞ্জিত পিচঢালা রাজপথও স্মরণ করিয়ে দেয় এই বসন্ত। ১৯৫২ সালের ৮ ফাল্গুন আর পলাশের রঙিন জাল বুনে সেদিন ছিল তারুণ্যের সাহসী দ্রোহ। বাঙালির জীবনের সঙ্গে বসন্ত রয়েছে গান নিয়ে, প্রকৃতি নিয়ে।
মোগল সম্রাট আকবর প্রথম বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু করেন ১৫৮৫ সালে। নতুন বছরকে কেন্দ্র করে ১৪টি উৎসবের প্রবর্তন করেছিলেন তিনি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বসন্ত উৎসব। শীতের জীর্ণতা শেষে প্রকৃতি নতুন রূপে দেখা দেয়, নতুন ছন্দে কথা বলে। সেই থেকেই এটি শুধু উদযাপনের উৎসব নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্যও।
এবারের দিনটি বদলে যাওয়া নিয়ে নানারকম জিজ্ঞাসা আছে নাগরিকদের মনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সমাজ গবেষক মেজবাহ কামাল মনে করেন, প্রয়োজন হলে বদলটাকে গ্রহণ করতে পারা খুব জরুরি। কিন্তু এইবছর ক্যালেণ্ডার বদলে সেটা চলতি বছরেই কার্যকর না করলেও হতো। তিনি বলেন, আমি বদলের বিরুদ্ধে না। কিন্তু এই যে বদলে যাচ্ছে সেটা কেন সেই ব্যাখ্যা সবার জানার অধিকার আছে। যারা কাজটি করছেন তাদের উচিত ছিল সবার কাছে তথ্যটি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
ক্যালেন্ডার বদলানো জরুরি ছিল উল্লেখ করে ভাষাবিদ ও বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বাংলা ট্র্রিবিউনকে বলেন, বিজ্ঞানভিত্তিক করার জন্য জরুরি ছিল। আগের যে পঞ্জিকা ব্যবহার করা হতো সেটি কুসংস্কারের বিশ্বকোষ হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানী মেঘনাথ সাহার সিদ্ধান্ত অনুসারে পঞ্জিকা সংস্কার করা হয়েছে। এর ফলে ২১ ফেব্রুয়ারি ৮ ফাল্গুন, বিজয় দিবস স্বাধীনতা দিবসের সঙ্গে বাংলা তারিখগুলো মিলে যাবে এবং আগের মতো হবে। এটা না করার কোনও কারণ নেই, ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে পহেলা ফাল্গুন পড়ায় সমালোচনার চেষ্টা চলছে, সেটি কাজের কিছু না।