X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোজার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

এনামুল করীম ইমাম
১৭ মার্চ ২০২৪, ১২:৫৪আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২৪, ১৬:৩৩

আব্বাসি খলিফা হারুনুর রশিদের কাছে এক খ্রিষ্টান পাদরি আগমন করলেন। পাদরি ছিলেন একজন ভালো চিকিৎসক ও হাকিম। বাদশাহকে তিনি বললেন, ‘আমি ধর্মীয় জ্ঞানও রাখি এবং চিকিৎসাবিদ্যাও জানি। আপনার কাছে আমার জিজ্ঞাসা হলো, আপনারা যে বলেন, কোরআন মাজিদ মানবজীবনের মূলনীতি। কোরআনে কি মানুষের সুস্থতা সম্পর্কে কোনও মূলনীতি বলে দেওয়া হয়েছে?’ 
খলিফা উপস্থিত আলেমদের বললেন, আপনারা এ প্রশ্নের উত্তর দিন। তখন একজন আলেম আলি ইবনে হুসাইন দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, কোরআন মাজিদে আমাদের শারীরিক সুস্থতার জন্য বড় একটি গোল্ডেন রুল (সোনালি নীতি) বলে দেওয়া হয়েছে। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “তোমরা পানাহার করো; কিন্তু অপচয় কোরো না।”’ [সুরা আরাফ, আয়াত: ৩১]

অর্থাৎ পানাহার করো; কিন্তু ওভার ইটিং (অতিভোজন) করা যাবে না বরং যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুই খেতে হবে। তারপর আল্লাহর প্রশংসা করতে হবে। এই যে অতিভোজন থেকে নিষেধ করা হয়েছে, এটিই কোরআনের মূলনীতি। অর্থাৎ মানুষ যদি এর ওপর আমল করে, তাহলে তার জীবনে রোগব্যাধি হওয়া আশঙ্কা অনেকটাই কমে যায়। আর এই অভ্যাস গড়ে ওঠে বছরে এক মাস রোজা পালনের মাধ্যমে।

খ্রিষ্টান পাদরি এ কথা শুনে বললেন, ‘আমি একজন চিকিৎসক হিসেবে এ কথা সমর্থন করি যে এটি একটি উত্তম মূলনীতি। আর রোজার মাধ্যমেই মানুষ এই মূলনীতির ওপর সুন্দরভাবে আমল করতে পারে।’

পাদরি এবার বললেন, ‘তোমাদের নবী (সা.) কি আধ্যাত্মিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক সুস্থতা সম্পর্কেও কোনও মূলনীতি রেখে গেছেন?’

আলেম বললেন, ‘হ্যাঁ, প্রিয় নবী (সা.) আমাদের শারীরিক সুস্থতা সম্পর্কেও মূল্যবান নীতি বলে দিয়েছেন। হজরত মিকদাম ইবনে মাদিকারাব (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি বলেন, “কোনও লোক তার পেট অপেক্ষা মন্দ কোনও পাত্রকে ভর্তি করেনি। আদম সন্তানের জন্য এ পরিমাণ কয়েক লোকমাই যথেষ্ট, যা দ্বারা সে নিজ কোমরকে সোজা রাখতে পারে (আল্লাহর ইবাদত করতে পারে)। যদি এর চেয়ে বেশি খাওয়া প্রয়োজন মনে করে, তাহলে এক-তৃতীয়াংশ খাদ্য, এক-তৃতীয়াংশ পানীয় এবং অপর এক তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য খালি রাখবে।”’ [তিরমিজি, হাদিস: ২৩৮০; ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩৩৪৯]

এই হাদিসকে সমর্থন করে বিশ্বখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী হারিস ইবনে কালাদা আস-সাকাফির[ ] বক্তব্য। তিনি বলেছেন, ‘পাকস্থলী সব রোগের কেন্দ্র। আর সংযম সব চিকিৎসার মূল।’ [ফাতহুল মুগিস, লিল-ইরাকি: ১/৩২৬; তাদরিবুর রাবি, লিস-সুয়ুতি: ১/৩৩৮]

এ কথা শুনে খ্রিষ্টান পাদরি চিকিৎসক বলতে লাগলেন, ‘তোমাদের কিতাব ও তোমাদের রাসুল (সা.) জালিনুসের[ ] জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের কোনও কিছু বাকি রেখে যাননি।’

আল্লাহু আকবার! বর্তমানে চিকিৎসকরা নিশ্চিত করেন যে আমাদের খাদ্যাভ্যাসই আমাদের রোগকে চূড়ান্ত করে। যেমন আমরা যদি অনেক বেশি চিনি খাই, তবে সুগারের রোগ হবে। যদি অনেক বেশি ক্রিমি (ননিযুক্ত) ও জুসি (রসযুক্ত) জিনিস খাই, তাহলে স্বাভাবিক শীতলতা বেড়ে হাইপ্রেসার দেখা দেয়। যদি অনেক বেশি তৈলাক্ত জিনিস খাই, তাহলে আলসার ও ব্লাড প্রেসার সৃষ্টি হয়। এ জন্যই বলা হয়েছে, পাকস্থলী সব রোগের কেন্দ্র।

এখান থেকেই রোগ শুরু হয়। এ জন্য যে ব্যক্তি নিজের পাকস্থলী নিয়ন্ত্রণ করে, উপকারী জিনিস ব্যবহার করে এবং ক্ষতিকারক জিনিস থেকে বেঁচে থাকে, ইনশা আল্লাহ সে এসব রোগ থেকে বেঁচে থাকে। এ জন্যই বলা হয়েছে, পাকস্থলী সব রোগের কেন্দ্র।

বক্তব্যের শেষাংশে বলা হয়েছে, ‘সংযম সমস্ত চিকিৎসার মূল’।

আমরা ইচ্ছামতো খাই। খেতে খেতে তার রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে বলি, আল্লাহই সবকিছুর মালিক। আল্লাহ তো অবশ্যই মালিক। তবে তিনি ব্যবহারের জন্য মানুষকে জ্ঞান দিয়েছেন। যখন জ্ঞান বলছে, ‘আমি অসুস্থ, তাই আমাকে ক্ষতিকারক জিনিস খেতে নিষেধ করা হয়েছে, তখন বিরত থাকা উচিত। অবশ্য লক্ষণীয় বিষয় হলো, এভাবে ক্ষতিকারক জিনিস খাওয়া গুনাহ। মনে রাখবেন, চিকিৎসক যাকে শরীরের জন্য ক্ষতিকারক কোনও জিনিস খেতে নিষেধ করেন, সে যদি তা খেয়ে আল্লাহর ওপর ভরসার (তাওয়াক্কুল) কথা বলে, তাহলে এতে তার তাওয়াক্কুলের সওয়াব তো হবেই না; বরং গুনাহ হবে। এমনকি যদি তা খেয়ে মারা যায় যায়, তাহলে আশঙ্কা আছে যে কিয়ামতের দিন তার আত্মহত্যার শাস্তি হবে।

বর্তমান পৃথিবীতে সব বিজ্ঞানী সমর্থন করেন যে সংযম চিকিৎসা থেকে উত্তম। ইংরেজিতে প্রবাদও আছে, ‘Prevention is better than cure.’

বেশি খাওয়ার কারণে রোগ হয়
বিশেষ একটি পরিমাণ খাওয়া মানুষের জন্য উপকারী; কিন্তু যদি তাতে অতিরিক্ত লোড দেওয়া হয়, তাহলে উপকারের জায়গায় ক্ষতি হয়। এ জন্য অতিভোজন মানুষকে অসুস্থ করে দেয়। বেশি খেলে চর্বি বেড়ে যায়, মোটা হয়ে যায়, ওজন বেড়ে যায়; ওজন বাড়া মুমিনের জন্য বিপদ। কারণ, তখন সে কোনও কাজের থাকে না। ইবাদত করতে পারে না। এই খাদ্যাভ্যাসকে নিয়ন্ত্রণ করে রোজা।

একটু চিন্তা করলে দেখবেন, বর্তমানে এমন রোগ অনেক, যার সম্পর্ক অতিভোজনের সঙ্গে। যেমন ব্লাডপ্রেসার, ডায়াবেটিক, গ্যাস্ট্রিক, আলসার ইত্যাদি। কম খাওয়ার কারণে যে রোগ হয়, তা বর্তমানে নেই।

অভ্যাস হোক কম খাওয়ার
খাবার সর্বদা প্রয়োজন অনুযায়ী হওয়া উচিত। প্রতিটি মানুষের খাবার তার শরীর অনুপাতে হয়ে থাকে। সুতরাং যে পরিমাণ ক্ষুধা, যদি তার চেয়ে দুই-চার লোকমা কম খায়, তবে এটা ভালো একটা খাদ্যাভ্যাস। আমরা বলি না যে মানুষের কাছে আল্লাহর নেয়ামত থাকবে, তারপরও সে ক্ষুধার্থ থাকবে। না, অবশ্যই খাবে। কিন্তু কতটুকু? শরীর যতটুকু প্রয়োজন অনুভব করে তার থেকে কিছু কম। এ জন্যই তো হাদিসে নববিতে এরশাদ হয়েছে, ‘এক-তৃতীয়াংশ খাদ্য, এক-তৃতীয়াংশ পানীয় এবং অপর এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য খালি রাখবে।’ [তিরমিজি, হাদিস: ২৩৮০]

প্রিয় নবী (সা.)-এর এই নির্দেশ মেনে চললে খাবার ভালোভাবে হজম হবে। শরীরের অংশ হয়ে তা উপকারে আসবে।

নববী অভ্যাস
প্রিয় নবী (সা.) কম খাওয়ায় অভ্যস্ত ছিলেন। যদি এক দিন খাবার খেতেন, তাহলে দ্বিতীয় দিন ক্ষুধার্ত থাকতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘প্রিয় নবী (সা.) মদিনায় আসার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার পরিবারের লোকেরা একনাগাড়ে তিন রাত গমের রুটি পেট পুরে খাননি।’ [সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৪৫৪; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৯৭০; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ২৬৪২৭]

সুস্থ থাকার অন্তর্নিহিত মর্ম
খলিফা উমরের (রা.) দরবারে খ্রিষ্টান চিকিৎসকদের একটি দল এসে মদিনায় একটি হাসপাত‌াল নির্মাণের অনুমতি চাইলে জনগণের কল্যাণে তিনি অনুমতি দিলেন। হাসপাতাল চালু করার এক মাসের মাথায় চিকিৎসক দল খলিফার দরবারে এসে অনুযোগের স্বরে বললো, আমরা এসেছিলাম চিকিৎসা সেবা প্রদান করে আর্থিকভাবে লাভবান হতে; কিন্তু গত এক মাসে এখানে একজন রোগীও পেলাম না। আপনাদের শহরে কি একজন রোগীও নেই? লোকজন কি অসুস্থ হয় না? খলিফা জবাব দিলেন, ‘আমরা এমন এক জাতি, ক্ষুধা না লাগলে আমরা খাই না; আর যখন আমরা খাই, তখন পেট ভরে খাই না।’ [মিনহাজুল মুসলিম: ১৬৪]

হজরত আবু বকর (রা.) বলেন, ‘আমি তিনটি জিনিস তিন জায়গায় খুঁজেছি; কিন্তু সেখানে পাইনি। পেয়েছি অন্য তিন জায়গায়। এক. আমি রিজিক খুঁজেছি দুনিয়ার ভেতরে। কিন্তু রিজিকের সন্ধান পেয়েছি আসমানে। দুই. আমি চিকিৎসাকে খুঁজেছি ওষুধের ভেতরে। তিন. আর সুস্বাস্থ্যকেও খুঁজেছি ওষুধের ভেতরে; কিন্তু আমি চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যকে খুঁজে পেয়েছি কম আহারের মধ্যে।’ [ম‌ুনাব্বিহাত লি-ইবনে হাজার আসকালানি রহ.]

প্রিয় পাঠক! মানুষ সুস্থ থাকার জন্য পরিমিত খাবার গ্রহণ করবে। কিন্তু এই অভ্যাস এক দিনেই হওয়া সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার বার্ষিক অনুশীলন। এই অনুশীলনই হলো পবিত্র রমজানের রোজা।

অতএব উপরোক্ত আলোচনার দলিল-প্রমাণ দ্বারা নিশ্চিত হওয়া গেলো যে ইবাদত হওয়ার পাশাপাশি রোজা মানুষের শারীরিক সুস্থতাও নিশ্চিত করে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে উত্তমরূপে রোজা রাখার তাওফিক দান করুন।

মুহাদ্দিস: মাদরাসা দারুর রাশাদ, মিরপুর-১২, পল্লবী, ঢাকা।

/এনএআর/
সম্পর্কিত
আজ ঈদ
ঈদুল ফিতরে করণীয়
চাঁদ দেখা যায়নি, ঈদ বৃহস্পতিবার
সর্বশেষ খবর
রাফাহ শহরে নতুন করে  ইসরায়েলি হামলায় ১৩ ফিলিস্তিনি নিহত
রাফাহ শহরে নতুন করে ইসরায়েলি হামলায় ১৩ ফিলিস্তিনি নিহত
টিভিতে আজকের খেলা (২৯ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৯ এপ্রিল, ২০২৪)
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ আজ
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ আজ
যশোরে তীব্র গরমে মরে যাচ্ছে মাছের পোনা, ক্ষতি ‌‘২০ কোটি টাকা’
যশোরে তীব্র গরমে মরে যাচ্ছে মাছের পোনা, ক্ষতি ‌‘২০ কোটি টাকা’
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ