ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনসহ এক দফা দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৩৯টি রাজনৈতিক দলের যুগপৎ আন্দোলনের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে শুক্রবার (১২ জুলাই)। এই এক দফার আন্দোলন গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর রাজপথ থেকে আলোচনার টেবিলে উঠে আসে। এবার বিএনপির পক্ষ থেকে আবারও যুগপৎভাবে কর্মসূচি দিতে বৈঠক ডাকা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে তিনটি দলের সঙ্গে বৈঠক করবে বিএনপি। এ প্রতিবেদন লেখার সময় গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের পর এনডিএমের সঙ্গে দলের লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক চলছে।
বিএনপি ও দলটির সঙ্গে যুগপতে যুক্ত জোট ও দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, যুগপৎ কর্মসূচি দেওয়ার জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে। এই প্রস্তাবনায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্নীতি, ভারতের সঙ্গে করা সমঝোতা স্মারক ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির ইস্যুগুলো উঠে এসেছে। বৈঠকে বিএনপির প্রস্তাবনা তুলে ধরে মতামত চাওয়া হবে এবং এর ভিত্তিতে আগামী দিনের কর্মসূচির জন্য পরামর্শ চাইবে দলটি।
ইতোমধ্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগপৎসঙ্গীদের কাছে খালেদা জিয়ার বিষয়টিকে ‘গণতন্ত্রের মুক্তি’ থেকে আলাদা না দেখার আহ্বান জানিয়েছেন। গত ২৮ জুন তিনি তার বক্তব্যে এও উল্লেখ করেন, ‘আমি মনে করি, যে কাজটা আমরা করতে সক্ষম হয়েছি, সব রাজনৈতিক দল একমঞ্চে উঠতে না পারলেও যুগপৎভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই সিদ্ধান্তকে আমি মনে করি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত।’
বিএনপি, গণতন্ত্র মঞ্চসহ যুগপতে যুক্ত দলগুলো গত বছরের ১২ জুলাই এক দফা দাবি ঘোষণা করে। দাবিটি হচ্ছে, ‘বাংলাদেশের জনগণের ভোটাধিকার হরণকারী বর্তমান ফ্যাসিবাদী কর্তৃত্ববাদী অবৈধ সরকারের পদত্যাগ ও বিদ্যমান জাতীয় সংসদ বিলুপ্তি, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে তার অধীনে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি, মিথ্যা গায়েবি মামলা প্রত্যাহার, ফরমায়েশী রায়ে সাজা বাতিল এবং সংবিধান ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।’
দফা-দাবিতে সংস্কার আসবে, কর্মসূচি ‘দ্রুত’
নতুন করে যুগপৎ কর্মসূচির দাবি ও দফার বিষয়ে জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা সাইফুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগামীতে দাবিতেও সংস্কার আসবে। এবার ডামি সরকারের পদত্যাগ, ডামি সংসদ বাতিল, স্বল্পতম সময়ে জাতীয় নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার গঠন ইত্যাদি বিষয় যুক্ত হতে পারে। দফা ও দাবি আপডেট হতে পারে। বৈঠকে পরিবর্তন, পরিবর্ধনের বিষয়গুলো আসবে, আশা করি।’
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটি বৈঠক করছে তিনটি দলের সঙ্গে। এগুলো হচ্ছে—গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, এনডিএম ও গণফোরাম।
শুক্রবার (১২ জুলাই) বৈঠক হবে গণঅধিকার পরিষদ- কর্নেল (অব.) মশিউজ্জামান-ফারুক হাসান, বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ, লেবার পার্টি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও এলডিপির সঙ্গে।
জানতে চাইলে এনডিএমের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ ‘বৈঠকের পর’ আলাপ করার কথা জানান বাংলা ট্রিবিউনকে।
তবে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘সামনের কর্মসূচি নিয়ে বৈঠকে আলাপ হবে। চেষ্টা করছি সপ্তাহখানেকের মধ্যে সব গুটিয়ে ফেলতে।’
সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় জোর দেবে গণতন্ত্র মঞ্চ
গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লিয়াজোঁ কমিটির আসন্ন বৈঠকে তারা বিগত আন্দোলনে সাফল্য-ব্যর্থতার প্রশ্নটি তুলবেন। আন্দোলনের রিভিউ না করে ‘সাংগঠনিক বিচার-আচার’ করলেও রাজনৈতিকভাবে কোনও মূল্যায়ন করেনি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের সঙ্গে আলাপে উল্লেখ করেন, ‘মঞ্চের সিনিয়র একাধিক নেতা আন্দোলনের বিষয়ে পর্যালোচনার প্রসঙ্গটি উত্থাপন করলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। বিশেষ করে ১২ জুলাই এক দফা দাবির পর ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখ অবরোধ কর্মসূচির পর থেকে মৌলিকভাবে যুগপৎ আন্দোলনের শক্তি হারিয়ে যায়। এর রেসপন্সিবিলিটি হচ্ছে আন্দোলনের মেকারদের, যাদের পদ থেকে ওঠানামা করানো হয়েছে, সেখানে তাদের অবদান স্বল্প। সেক্ষেত্রে পলিসি মেকারদের দায়িত্ব নিতে হবে।’
গণতন্ত্র মঞ্চের একজন নেতা বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করবো। লিয়াজোঁ কমিটি শক্তিশালী করে এর মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়াটি জরুরি। এছাড়া এখন তারা বৈঠক করে কী প্রস্তাব দেয়, তার ভিত্তিতে কিছু বিষয় জানার থাকবে। এই সরকারকে তারা আরও সময় দেবে কিনা, দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের দাবি তুলবে কিনা, এই বিষয়গুলো বৈঠকে আসতে পারে।’
বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল মনে করেন, ‘যুগপতের দ্বিতীয় দফার এই বৈঠক আসলে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়।’ স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যের ভাষ্য—দলের শীর্ষ নেতৃত্ব বিগত আন্দোলনের কোনও অ্যাসেস করবে না, এতে করে দায়িত্ব নিতে হয়।’
জানতে চাইলে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলন আবারও মাঠে শুরু করার লক্ষ্য নিয়ে আলোচনা হবে আশা করি। গোটা দেশে যে পরিস্থিতি—দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ গোটা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এই বিষয়গুলো আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরি করছে।’
‘আমাদের গণতন্ত্র মঞ্চের দিক থেকে আমরা গোটা আন্দোলনের পর্যালোচনা করতে চাই। এটা সম্ভব হলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া আরও গণতান্ত্রিক আরও প্রতিনিধিত্বমূলক করতে পারি। সত্যি সত্যি আন্দোলন তুঙ্গ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারি’, বলেন সাইফুল হক।
গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বিএনপির বৈঠকের এখনও দিনক্ষণ নির্ধারণ হয়নি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের বৈঠকে থাকার কথাবার্তা চলছে।
প্রসঙ্গত, অন্তত ৩৯টি রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ ধারায় কর্মসূচি পালন করে আসছে। এসব দল ও জোট হলো— গণতন্ত্র মঞ্চ (৬ দলীয় জোট), ১২ দলীয় জোট, গণফোরাম-পিপলস পার্টি (দ্বিদলীয় জোট), সমমনা জোট (১১), গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য (৪ দল)। এককভাবে পালন করছে বিএনপি, এলডিপি, গণঅধিকার পরিষদ ও বাংলাদেশ লেবার পার্টি।
বিএনপির নেতৃত্বে ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর সরকার পতনের যুগপৎ কর্মসূচি শুরু করে বিরোধী দলগুলো। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ওই দিন থেকে চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত যুগপৎ ধারায় কর্মসূচি পালিত হয়।
শায়রুল কবির খান জানান, ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর প্রথম যুগপৎ ধারায় কর্মসূচি পালিত হয়। সেটি ছিল গণমিছিল। এরপর ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগসহ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা’র এক দফা দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ পদযাত্রা কর্মসূচি হয়েছে ২০২৩ সালের ১৮ জুলাই।
তিনি জানান, বিদায়ী বছরের ২৯ অক্টোবর থেকে ৫ দফা হরতাল, ১৩ দফা অবরোধ ও ১৩ দফা গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করা হয়। সর্বশেষ এ বছরের ৩০ জানুয়ারি কালো পতাকা মিছিল করা হয়।
আরও পড়ুন: