X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

ঘুরে দাঁড়ানোর উপায় নিয়ে যুক্তি-তর্ক চলছে বিএনপিতে

সালমান তারেক শাকিল ও আদিত্য রিমন
২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২০:৫৮আপডেট : ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২১:১১

ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির অন্তত ৫টি বৈঠকে দলের অতীত কর্মকাণ্ড ও প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার পথ-পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টিকে ‘রুটিন-ওয়ার্ক’ হিসেবে নিলেও দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত বিএনপি। দুর্বল সংগঠন নিয়েও চরম প্রতিকূলতার মধ্যে কীভাবে রাজনৈতিকভাবে ঘুড়ে দাঁড়ানো সম্ভব, তা নিয়ে দলীয় নীতিনির্ধারণী নেতাদের মধ্যে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির অন্তত ৫টি বৈঠকে দলের অতীত কর্মকাণ্ড ও প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার পথ-পদ্ধতি নিয়ে যুক্তি-তর্ক হয়েছে। দলীয় প্রধানের মুক্তির বিষয়টি অনিশ্চিত হওয়ায় কোনও কোনও সদস্য পরস্পরের প্রতি দোষারোপ করলেও অধিকাংশ সদস্য মত দিচ্ছেন সমাধানের পথ বের করতে। বিএনপির একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, দনীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টিতে ক্ষমতাসীনদের বিবেচনা কঠোর। আর এ বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বোঝা গেছে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে এসে গত রবিবার আবারও হাইকোর্টে খালেদা জিয়ার জামিন নাকচের ঘটনায়। এরই মধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে দলের নেতারা নিশ্চিত হয়েছেন, সরকারের উচ্চপর্যায়ে খালেদা জিয়াকে নিয়ে ‘নরম’ হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। এমনকী একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রের ভাষ্য, বিএনপি চেয়ারপারসনের কারাবরণ তার ‘প্রাপ্য’ বলে মনে করে সরকার। দলের অভ্যন্তরে এ নিয়ে সিনিয়র নেতাদের মধ্যে দুই ধরনের চিন্তা থাকলেও এখন সবাই একমত এ বিষয়ে যে কার্যকর চাপ তৈরি করতে না পারলে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা সম্ভব হবে না।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করবো। আইনি লড়াই যেহেতু পাশাপাশি চলছে, সে কারণে আপিলেও যাবো। কিন্তু কোর্ট থেকে রেজাল্ট প্রত্যাশা করি না, প্রথম দিকে প্রত্যাশা করেছি। ৫ বছরের সাজা হলে হাইকোর্টে আপিল হলেই জামিন হয়। কিন্তু ম্যাডামের জামিন দিলো না, বরং ৫ বছরের সাজাকে ১০ বছর করলো। আর এখানেই তো বোঝা যায়, আর প্রাপ্তির কিছু নেই। আদালতকে সম্পূর্ণভাবে সরকারের পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। তাদের ফরমায়েশি রায় তারা দিচ্ছেন।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সেলিমা রহমানও প্রায় একই অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘আদালত স্বাধীন নয়। রাষ্ট্রীয় আনুগত্যে কাজ করেন আদালত। তারপরও আইনি প্রক্রিয়ায় যদি খালেদা জিয়ার মুক্তি সম্ভব হয়, তাহলে চেষ্টা চালিয়ে যাবো। তবে মনে হচ্ছে, আন্দোলনের মাধ্যমেই তাকে মুক্ত করতে হবে।’
স্থায়ী কমিটির অন্তত ৫ জন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি দলের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ। ইতোমধ্যেই সিদ্ধান্ত আছে, আদালত ও রাজপথ— উভয় পথেই চেষ্টা চালিয়ে যাবে বিএনপি। তবে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে সংগঠন পুনর্গঠনের কোনও বিকল্প দেখছেন না নীতিনির্ধারকরা। সেক্ষেত্রে চলতি বছরের শেষ দিকে দলের সপ্তম জাতীয় কাউন্সিল করার বিষয়ে প্রাথমিক চিন্তা-ভাবনা চলছে বিএনপিতে।
প্রসঙ্গত, এর আগে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান লিখিতভাবে সংগঠন গোছানোসহ কাউন্সিলের পরামর্শ দিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘দলের পুনর্গঠনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, যার মাধ্যমে আমরা বড় ধরনের আন্দোলন শুরু করবো, তা এখনও শেষ হয়নি।’
কাউন্সিল প্রসঙ্গে নীতিনির্ধারণী এই নেতা বলেন, ‘আগে বাকি কমিটিগুলো করবো, মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলো করবো। মহানগর কমিটি আছে মেয়াদোত্তীর্ণ, এসব কাজ শেষ করে কাউন্সিলর তৈরি করে কাউন্সিল করবো।’
চলতি বছরের শেষ নাগাদ কাউন্সিল করার বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে বলে জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারও।

স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের জেলা-থানাগুলোর কাউন্সিলের কাজ চলছে। এগুলো শেষ হলেই কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হবে। তবে কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের তারিখ নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না।’


খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে আদালত ও রাজপথ— উভয় পথেই চেষ্টা চালিয়ে যাবে বিএনপি। (ছবি: রয়টার্স) দলের তৃণমূল পর্যায়ে গোছানো শেষ হলেই কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হবে বলে মনে করেন সেলিমা রহমান। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘ম্যাডাম কারাগারে। সবকিছু নিয়ে তাদের চিন্তা-ভাবনা আছে। আর কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃত্বের পরিবর্তন আসে। এটা তো একটা চলমান গতি। সেই গতিতে যখন যেখানে প্রয়োজন নেতৃত্বের পরিবর্তন হবে।’
যুক্তি-তর্ক চলছে স্থায়ী কমিটিতে
দলের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির অন্তত ৫টি বৈঠকে দলের অতীত কর্মকাণ্ড ও প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার পথ ও পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। গত ৫, ১৪, ২২, ২৪ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির এসব বৈঠক শেষে কোনও ব্রিফ করেননি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
সেলিমা রহমান অবশ্য বলছেন, ‘স্থায়ী কমিটির বৈঠক নিয়ে লুকোচুরির কিছু নেই। কখনও স্থায়ী কমিটির একদিনের বৈঠকে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না। এ কারণে মিটিং মুলতবি করা হয়। কোনও সিদ্ধান্ত ছাড়াই যেসব মিটিং শেষ হয় পরবর্তীতে সেখান থেকে আবার শুরু হয়। তাই ব্রিফিং বাদ পড়ে। ’
দলীয় একাধিক সূত্রের ভাষ্য, গত বছরের ১৩ জুন থেকে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকগুলোতে তারেক রহমানের নির্দেশে বৈঠকের এজেন্ডা ‘বিশেষ খামে ভরে’ সদস্যদের কাছে পাঠানো হয়। এই প্রক্রিয়ায় গত দেড় মাসে নতুন সংযুক্তি এসেছে। এজেন্ডার বাইরেও আলোচনায় আসে বিভিন্ন বিষয়। বিশেষ করে ২০০১ সালে সরকার গঠন, সরকারে জামায়াতকে অংশীদার করা এবং গত ১১ বছরে নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে আলোচনা হচ্ছে স্থায়ী কমিটিতে। আর পুরো সময় ইন্টারনেটে যুক্ত থাকেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
দলের বিভিন্ন উইংয়ের সূত্রগুলো বলছে, ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হার নিশ্চিত জেনেও অংশগ্রহণ, মঈন-ফখরুদ্দীনের সময় দলে বিভক্তি, সংগঠন না গুছিয়ে ২০০৯ সালে মধ্যবর্তী নির্বাচনের জন্য আন্দোলনে যাওয়া, ২০০৯ সালে মিন্টু রোডে বিরোধীদলীয় নেতার বরাদ্দকৃত বাড়ি গ্রহণ না করা, ২০১৪ সালে নির্বাচন থেকে বিরত থাকা এবং ঢাকা সফরে আসা ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে দেখা না করার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সংসদে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত থাকলেও শেষ মুহূর্তে যোগদানের সিদ্ধান্ত দেওয়ায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। ইতোমধ্যে ‘কালেক্টিভ’ উপায়ে দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ হলেও এ ব্যাপারে অন্য সদস্যদের মত ছিল ভিন্ন। যদিও শীর্ষ নেতৃত্বের এ সিদ্ধান্ত মেনে নেন স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। একই সঙ্গে দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মহাসচিব মির্জা ফখরুল কেন সংসদে যোগ দেননি, তা নিয়েও একাধিক সদস্য বৈঠকে কথা বলেন।
সূত্রগুলো জানায়, ‘আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশল ও নীতি বুঝতে ক্রমাগত ব্যর্থ হওয়ার’ প্রসঙ্গটিও স্থায়ী কমিটির সদস্যদের আলোচনায় স্থান পেয়েছে।
একটি সূত্রের দাবি, আদালতের আদেশে ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি হারানোর পর খালেদা জিয়া কখনোই কোনও অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সেখানে যাননি। দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে এ নিয়েও কথাবার্তা হচ্ছে।
সূত্রটির ভাষ্য, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ সবকিছুই এখন বিবেচনায় নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে দলকে কীভাবে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করা যাবে, এ নিয়েই মূলত নেতারা এখন ব্যস্ত।
জানতে চাইলে সাবেক স্পিকার প্রবীণ নেতা জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘যুক্তিতর্ক মানে কী করি এগোনো যায়, এটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কেউ ডিসএগ্রি করে না। সবাই একমত হচ্ছেন। আলোচনা হয় বিভিন্ন কিছু নিয়ে।’
বিএনপির আরেকটি সূত্রের দাবি, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টিও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির নিরিখে বিবেচনা করার আলোচনা আছে দলে। যদিও সম্প্রতি জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের একজন সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিএনপি তাদের সঙ্গে দূরত্ব রাখার কারণেই রাজপথে সফল হতে পারেনি। বিদ্যমান সম্পর্ক ভবিষ্যতে কোন দিকে যায়, এ নিয়ে এখনও পলিসি ঠিক করেনি জামায়াত।’

/এইচআই/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সন্ধ্যা নামিল শ্যাম: গানে ও চিত্রে মুগ্ধতার সমন্বয়
সন্ধ্যা নামিল শ্যাম: গানে ও চিত্রে মুগ্ধতার সমন্বয়
বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে কাতারের বিনিয়োগ চাইলেন রাষ্ট্রপতি
বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে কাতারের বিনিয়োগ চাইলেন রাষ্ট্রপতি
মুগদায় উচ্ছেদ অভিযান স্থগিত করলেন হাইকোর্ট
মুগদায় উচ্ছেদ অভিযান স্থগিত করলেন হাইকোর্ট
তাপপ্রবাহে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ৮ নির্দেশনা
তাপপ্রবাহে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ৮ নির্দেশনা
সর্বাধিক পঠিত
রাজকুমার: নাম নিয়ে নায়িকার ক্ষোভ!
রাজকুমার: নাম নিয়ে নায়িকার ক্ষোভ!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
সাবেক আইজিপি বেনজীরের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে দুদকের কমিটি
সাবেক আইজিপি বেনজীরের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে দুদকের কমিটি
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা