X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পোড়া মোবিলের গন্ধ ও আমাদের বাংলা নববর্ষ

তপন মাহমুদ
১৪ এপ্রিল ২০১৭, ১২:৪৯আপডেট : ২২ জুন ২০১৭, ১৩:৩৬

তপন মাহমুদ পহেলা বৈশাখের দিন এলে এখনও ভেসে আসে সন্তোষ দার দোকানের আমির্তির ঘ্রাণ।  যদিও বাকি খুব একটা পড়তো না।  কিন্তু হালখাতার দিনে মিষ্টিমুখ করতেই হতো, সঙ্গে নিমকিও।
তবে পহেলা বৈশাখে নাগরিক আয়োজনের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় ২০০০ সালে বরিশাল শহরে গিয়ে।  সবে এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেছি।  যে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেলাম, তারা এই উৎসবের প্রথম সারির আয়োজক।  তারা ছিলেন খেলাঘরের সংগঠক।  সেবারই প্রথম দেখলাম, রাত জেগে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন।  সকালে সেই শোভাযাত্রায় অংশও নিলাম।  সে এক অন্যরকম অনুভূতি।
একটা উৎসব মানুষকে বদলে দিতে পারে।  প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়া থেকেই আমার ভেতরে সেই বোধ শুরু হয়।  এদিনই আমার প্রথম পরিচয়ের শুরু করে বাঙালিত্বের সঙ্গে।  এর আগে পনেরটি বছর বাঙালি জীবন অতিবাহিত করলেও, তা আমাকে কখনও খুব একটা শিহরিত করতে পারেনি।  শুধু একুশে ফেব্রুয়ারির দিনে একটু বোধ কাজ করতো।  সেটা ছিল বাংলা ভাষার প্রতি টানের জায়গা থেকে।
পরে যখন পয়লা বৈশাখ, মঙ্গল শোভাযাত্রা ইত্যাদির ইতিহাস জানতে শুরু করলাম, তার সঙ্গে এটাও বুঝতে শুরু করলাম এই নববর্ষ উদযাপনকে অনেকেই মেনে নিতে পারেন না।  এর মধ্যে তারা নানা ধরনের ধর্ম থাকা-না থাকা খুঁজে পান। যদিও সম্রাট আকবরের হাত ধরে এ ভারতে ইসলাম ধর্ম শক্ত ভিত পেয়েছিল, সুফিবাদী ও সমন্বয়বাদী ধারার মধ্য দিয়ে।  হিজরি চন্দ্রমাসের সঙ্গে মিল রেখে আকবর তৈরি করিয়েছিলেন বাংলা পঞ্জিকা।  শুরু করেছিলেন পহেলা বৈশাখের জাঁকজমক উদযাপন, যার মূল আকর্ষণ ছিল হালখাতা।  এই হালখাতা শব্দটির মাঝেও একটা নতুন জীবনের ডাক আছে।  সবকিছুকে উপড়ে ফেলে নয়, বরং নতুন করে হালনাগাদ করে নেওয়া।

তবে এই সময়ে এসে আমার মনে হয়, শুধু অর্থনীতি আর জীবন-যাপনই না, আমাদের চিন্তাগুলোকে, আমাদের বোধগুলোকে, আমাদের জাতি পরিচয়কেও হালনাগাদ করে নেওয়া দরকার।  সব কিছুকে ধর্ম দিয়ে ব্যাখ্যার দরকার নেই।  ধর্মের বাইরেও জীবনের কোনও অধ্যায় থাকতেই পারে।  হয় তাকে ধর্মের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া দরকার, নয়তো তাকে স্বতন্ত্রতা দিয়ে দরকার শ্রদ্ধা দেখানো।  কিন্তু কথায় কথায় ধর্মীয় ব্যাখা হালে বাঙালি মুসলমানের অসুখে পরিণত হয়েছে।

সেই অসুখের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আমরা নানা সময়ই দেখে থাকি।  দেখেছি ২০০১ সালে রমনা বটমূলে জঙ্গিদের ভয়াবহ হামলায় ১০ জনের প্রাণহানি।  যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে হামলা।  আর বছর দুয়েক আগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নারীর ওপরে যৌন নির্যাতনের ঘটনা।  কিন্তু আফসোস হলো, সেটা থামেনি।  সে অসুস্থতার ভাইরাস রোজই ছড়াচ্ছে।

সরকার যখন কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূল ধারায় নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলো, ঠিক তখনই দেখলাম একদল বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী লোক চট্টগ্রামে পোড়া পেট্রোলের গন্ধ ছড়ালো।  আসলে এর মাধ্যমে কি বার্তা দিতে চাইলো তারা? কারণ, তারা নিশ্চয়ই জানতো, এমন দেয়াল চিত্র ফের তৈরি করে নিতে পারবে চারুকলার শিক্ষার্থীরা।  সেটা হয়েছেও বটে। 

এই পোড়া পেট্রোল যে কয়েকটা আল্পনা পুড়িয়েছে, তা নয়।  এই পোড়ানোর ক্ষত আরও অনেক গভীর।  এই আঘাত অনেক কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে।  আমাদের বাঙালি জাতিসত্ত্বাকে বিভক্ত করার- এ চেষ্টার অনেক দীর্ঘমেয়াদী চক্রান্ত আছে।  এটা একটা প্রতীকী আঘাত, যেটাকে শুধু সাময়িক মোকাবিলা করে সমাধান হবে না।

আমাদেরকে প্রথমেই খুঁজতে হবে এরা কারা? তারা বারবার কেন এমন করছে? পহেলা বৈশাখের উৎসবকে তারা কেন বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে? তারা কেন ভয় দেখিয়ে, আতঙ্কিত করে মানুষকে ঘরে রাখতে চাইছে? কেন বলবার চেষ্টা করছে বাংলা নববর্ষ বা মঙ্গল শোভাযাত্রা মুসলমানদের উৎসব নয় ? এর কোনও ইন্টালেকচুয়াল ব্যাখ্যা আছে তাদের কাছে ?

সকালে ঘুম থেকে উঠে পুরনো বইয়ের স্তূপ থেকে একটা বই নতুন করে পড়লাম, নতুন বছরের শুরুতেই।  ডক্টর তারা চাঁদ-এর গবেষণা বই  ভারতীয় সংস্কৃতিতে ইসলামের প্রভাব।  অনুবাদ করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।  এই লেখক বইয়ের ভূমিকায় বলেছেন, ভারতীয় সংস্কৃতি চরিত্রগতভাবে সমন্বয়ধর্মী।  এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ভাবধারা ও আদর্শ।  এ সংস্কৃতি তার কোটরে ধারণ করেছে বিভিন্ন বিশ্বাস, রীতিনীতি, আচার অনুষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান, শিল্পকলা, ধর্ম এবং সমাজ বিকাশের বিভিন্ন স্তরের দর্শন।  এ সংস্কৃতি আদিকাল থেকে নানাধর্মী উপাদানের মধ্যে ঐক্যের সন্ধান করেছে, যা এর সমন্বয় এনে দিয়েছে।

আমাদের বাংলার জন্য এটা আলাদা কিছু নয়।  কিন্তু এখানকার সনাতনরা যেমন ইসলামকে বহিরাগত বলে বারবার ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তেমনি আরব বা অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা ও পরে এখানকার ধর্মান্তরিত মুসলমান ও তাদের উত্তরসূরীরা ভুলে গেছেন, এখানকার একটা নিজস্ব সংস্কৃতি ছিল এবং আছে।  এখানকার ধর্মকে উপরোক্ত লেখকের বোধের জায়গা থেকে কখনও দেখা হয়নি।  বরং ধর্ম বা সংস্কৃতি এখানে বরাবরই ক্ষমতার বঁলির পাঠা হয়েছে।  আক্রান্ত হয়েছে মানুষওমনুষ্যত্ব।  

আরেকটি ব্যাপার ঘটেছে বা ঘটছে।  সেটা প্রাচীনত্বের প্রতি অন্ধ মোহ।  সেটা থেকে এখানকার হিন্দু-মুসলিম কেউই মুক্ত হতে পারেনি।  আহমেদ ছফা তার ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’ গ্রন্থে যেমনটি বলেছিলেন, আধুনিক ভারতের সৃজন প্রক্রিয়াতে প্রাচীনের প্রাচীনত্বের অংশটুকু সর্বাংশে কাটাতে পারেনি।  অতিকায় যুক্তিবাদী মনীষীদের চিন্তার মধ্যেও বারেবারে প্রাচীন ভারতের হিন্দু মিথ ঝিলিক দিয়ে জেগে উঠেছে...আর তার ফলশ্রুতিতে মুসলিম মিথসমূহ নতুন করে প্রাণ পেয়েছে

এরই ধারবাহিকতায় তাইতো এখনও আমরা খুঁজি পহেলা বৈশাখ ধর্মে আছে কি নেই?  প্রশ্ন তুলি, ইলিশ পান্তা কোনকালে বাঙালিত্বের পরিচায়ক ছিল? কিন্তু ছিল না বলে হতে পারবে না, এটাইতো মৌলবাদী চিন্তা। কিছু ছিল না বলেহবে না , এমনতো কথা নেই।  কারণ সংস্কৃতি মানুষের জীবন যাপনেরই আরেক নাম।  এটা একটা সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা ও তার বদলের সঙ্গে বদলাবেই। 

মানুষ তার প্রয়োজনেই উৎসবের আয়োজন করে।  তৈরি করে নেয় তার নিজস্ব আচার- অনুষ্ঠান।  তাতে সে ইলিশ খাবে নাকি সেমাই, সেটা একান্ত তাদের ব্যাপার। আপনার বাপু রুচি না হলে, যেটা মুখে রুচে সেটা খান, যেটা মনে রুচে সেটা মানেন।  আর কেউ যদি ভাবেন অন্যের আচার-আচরণে তার বিশুদ্ধতা নষ্ট হবে, তাকে বলি আপনি মঙ্গল গ্রহে চলে যাবার চেষ্টা করেন।  ওখানে পহেলা বৈশাখও নেই, আর মঙ্গল শোভাযাত্রাও হয় না।

এতকিছুর পরও আমাদের আসলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই কবিতার লাইনের মতো প্রশ্ন তুলতে হয় কতটা এগোলো মানুষ?’ অথচ আমরা এখনও পোড়া মোবিলে সংস্কৃতিকে স্তব্ধ করতে চাই।  পেছনে টেনে নিতে চাই আমাদের দিনগুলোকে। কি আশ্চর্য ! অপূর্ব সুন্দর আল্পনাগুলোর মাঝেও আমরা সৌন্দর্য না দেখে কদর্যতা খুঁজি!

এগারো শতকের এক মুসলিম সাধকের কথা দিয়েই এ লেখাটি শেষ করতে চাই।  ফরিদউদ্দিন গঞ্জ-ই শাকার বলতেন. ছুরির চেয়ে সূঁচ ভালো।  কেননা, সূঁচ সবকিছু সেলাই করে জোড়া দেয়, আর ছুরি কেটে টুকরো টুকরো করে দেয় সবকিছু।’ এখন আমাদের ভাবতে হবে, আমরা কি অসহিষ্ণুতার ছুরি হাতে সবকিছু ছিড়ে-কেটে ফেলবো নাকি সংস্কৃতির বন্ধনে সবাইকে নিবিড় বাঁধবো।  সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা।

লেখক: জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
‘শো মাস্ট গো অন’
চিকিৎসা সুরক্ষা আইন জরুরি‘শো মাস্ট গো অন’
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ