X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্ষক মন!

শান্তনু চৌধুরী
২১ মার্চ ২০১৮, ১৭:২১আপডেট : ২১ মার্চ ২০১৮, ১৭:২২

শান্তনু চৌধুরী ঘটনা এক. বরিশালে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে তৃতীয় শ্রেণির এক স্কুলশিক্ষার্থীকে। এই ঘটনায় আটক ব্যক্তি পুলিশের কাছে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে ধর্ষণ ও খুনের কথা।
ঘটনা দুই. চট্টগ্রামের ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ওই ছাত্রীর বাবা। একই এলাকায় ধর্ষণের পর সেপটিক ট্যাংকে ফেলে হত্যার চেষ্টা করা হয় তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রীকে। এই ঘটনায় আটক করা হয়েছে স্কুলের দফতরিকে।
ঘটনা তিন.  টাঙ্গাইলে ৯ বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে অবসরপ্রাপ্ত এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। এই ঘটনায় শিক্ষক মৌলভীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। চুয়াডাঙ্গায় এক বন্ধু কাশেম আলী কয়েক দফা ধর্ষণ করেছে তার বন্ধুর মেয়েকে। পরে স্কুলছাত্রীটির গর্ভপাত ঘটানো হলে তার অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে।

ওপরের উদাহরণগুলো গত পনের দিনের। তবে এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। এ ধরনের ঘটনা সারাদেশে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে। এর কিছু কিছু সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে, কিছু কিছু আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। কিন্তু আশঙ্কার কথা হলো, আগে হয়তো মাসে-ছয় মাসে একটি ঘটনা ঘটতো আর এখন সেটি হরহামেশাই ঘটছে। ওপরের ঘটনাগুলো সংবাদমাধ্যম থেকে নেওয়া। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এর বেশিরভাগই ঘটেছে স্কুলে শিক্ষক বা দফতরির মাধ্যমে। আর পরিবারের কাছের মানুষের দ্বারা। কতটা বিস্ময়কর! তাহলে কোথায় নিরাপদ নারী আর কন্যা শিশুরা? পরিবারে তারা বেড়ে উঠতে পারছে না সেখানেও লোলুপ নিকট আত্মীয় ওঁৎ পেতে রয়েছে। কিন্তু অনেক শিশু সেটা হয়তো মুখ ফুটে বলতে পারে না। একটা সময় ছিল পরিবারে, সমাজে সবচেয়ে সম্মানের জায়গাটি ছিল শিক্ষকদের। বাবা-মা শিক্ষকের কাছে নিজের ছেলেমেয়েকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রাথমিক কাজটা সেরে নেওয়ার পর নিশ্চিত থাকতেন এবার ‘মানুষ’ করার দায়িত্ব নেবেন শিক্ষক। আমাদের সময়ে স্কুলের দাফতরিক কাজ করার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়টিও দেখভাল করতেন দফতরি। হয়তো কারও খাতা নেই, পেন্সিল-কলম হারিয়ে গেছে, কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তাকে বাসায় দিয়ে আসতে হবে। এই কাজগুলোও দফতরিরা মনোযোগ দিয়ে করতেন, আন্তরিকতা দিয়ে করতেন। আর এখন তাদের কাছেই অনিরাপদ শিশুছাত্রীরা। শিক্ষকরা গ্রামে-গঞ্জে যে মর্যাদার আসনে বসেছিলেন, এখন সেই আদর্শিক জায়গা থেকে তারা অনেকটাই সরে এসেছেন বলে মনে হয়। যারা কোচিং সেন্টারে পড়ান বা প্রাইভেট টিউশনি করান, সেখানে বাণিজ্যের বিষয়টি তো রয়েছেই, সঙ্গে রয়েছে যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনাও। তাহলে কি নিরাপত্তা নেই? পরিবার থেকে বের হয়ে শিশুকেতো স্কুলেই যেতে হবে, সেখানে নিরাপত্তা নেই। এরপর একটু বড় হলেই চাহনি, স্পর্শ, কথায় যৌন হয়রানি। গাড়িতে ভয়, রাস্তায় হাঁটবেন বা রিকশায় চলতেও নারীদের ভয়। কারণ হয়তো কোনও মিছিল থেকে ঝাঁপটে ধরা হবে। হয়তো কোনও পঙ্গপাল পিছু নিয়ে শ্লীলতাহানি ঘটাবে। তাহলে কোথায় যাবে নারী? এই একবিংশ শতকে এসেও তাকে ঘরবন্দি করে রাখার এই অভিনব কৌশল কোথা থেকে আসছে? কারা মস্তিষ্কে গুঁজে দিচ্ছে এমন ধারণা? প্রথমেই যে কারণটি মাথায় আসে, সেটি উগ্রবাদ। যারা মনোবিজ্ঞানী বা এসব নিয়ে গবেষণা করেন, তারা মাত্রই জানেন ধর্ষক মনে কী খেলা করে? তাদের বেড়ে উঠার মধ্যেই রয়েছে মেয়েকে মানুষ না ভেবে ‘মেয়ে’ ভাবার প্রবণতা। এছাড়া যে সমাজে তারা বাস করে আশেপাশের ‘মুরব্বি’, ওয়াজ বা ধর্মীয় বক্তব্য, উগ্রবাদী বই বা ইন্টারনেটে তারা এমন সব বিষয় শিখছে যা তাদের উস্কে দিচ্ছে নারীর প্রতি তীব্র বিদ্বেষ ছড়াতে। তারা ভাবছে, নারী মানেই অন্দরমহলে থাকবে। ধীরে ধীরে দেশে সেটা এতই প্রকট হয়ে উঠছে যে, নারীবাদী বলে যাদের আমরা জানি, তারাও হয়তো এখন অতটা সোচ্চার হতে পারছেন না। কারণ একটাই ‘ধর্ম’ বিষয়টাই এমন যেটা নিয়ে বলাটাও মুশকিল অনুভূতিতে আঘাত লাগে বলে আবার কুপমণ্ডুক পক্ষ এটাকেই কাজে লাগিয়ে স্বার্থ হাসিল করে ফেলছে। আবার একইসঙ্গে সামাজিক অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতা, হতাশাও মানুষকে এক ধরনের অমানবিক ও হিংস্র করে তুলছে। সম্প্রতি রাজধানীর ধানমন্ডিতে এক পুলিশ সদস্যের আচরণকে যদি উদাহরণ হিসেবেই দেখি, তবে বুঝতে পারবো, মস্তিষ্কে কী ধরনের ধারণা নিয়ে আমরা বেড়ে উঠছি। সফটওয়্যার প্রকৌশলী তানিয়া আলম স্কুটিতে করে সন্তানকে স্কুলে পৌঁছাতে গেলে সেখানে সন্তানের সামনেই হঠাৎ এক ট্রাফিক পুলিশ তানিয়ার উদ্দেশে আপত্তিকর ও আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেন। এ বিষয়ে ফেসবুকে ওই সদস্যের ছবিসহ দেওয়া স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, ‘অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের নাম সাইফুল। ওই পুলিশ সদস্য অন্য গাড়িচালকদের তাকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য উসকে দিচ্ছিলেন। সাইফুল বলছিলেন, ‘মারেন ভাই মারেন। একে তো  মেয়েমানুষ, তার ওপর স্কুটি চালায়। ডেইলি দুইটা বাচ্চা নিয়া দিতে আসে। মারেন। মারলে কোনও সমস্যা নেই। আমি বলছি, মারলে কোনও সমস্যা নেই।’ এই হচ্ছে মানসিকতা। রাষ্ট্রের আইনরক্ষকের যদি এই মানসিকতা হয়, তবে পুরো সমাজ বদলাতে আমরা কতটা পিছিয়ে আছি, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ওপরে যে কয়টি ঘটনার কথা বলেছি, তার মধ্যে প্রতিটি যৌন-নির্যাতনের ঘটনায় দেখা যাচ্ছে জড়িত বা অভিযুক্তরা মাঝ বয়সী। স্কুল কমিটির চেয়ারম্যান,  শিক্ষক, দফতরি থেকে শুরু করে বাবার বন্ধু। সম্প্রতি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের প্রকাশিত এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে– মৌখিক, শারীরিক ও যৌন হয়রানির শিকার ৬৬ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ৪১ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষদের দ্বারা। যার মানে দাঁড়াচ্ছে নারীদের নিগৃহীত করার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরাট একটি অংশেরই সম্ভবত পরিবার আছে। তারা অবিবাহিত তরুণ নয় এবং এরা বিকৃত মানসিকতার।

আমরা যখন স্কুলে পড়তাম, তৎকালীন  মাঝবয়সীরা হয়তো এতটা সাহসী ছিলেন না বা থাকলেও আমরা তার প্রমাণ পাইনি। হয়তো ভয় ছিল। তখন দেখতাম স্কুল ছুটির সময় পাশের চায়ের দোকানে তারা আড্ডা দিতেন। এমন সব। তাহলে এখন কেন এমন হচ্ছে বা প্রতিকারই কী? প্রথমত যেটা হচ্ছে, ছেলেবেলা থেকে আলাদাভাবে মানুষ হওয়া বিশেষ করে কো-অ্যাডুকেশনের  মাধ্যমে যারা বড় হয়নি তাদের মধ্যে বিকৃত মানসিকতাটা একটু বেশিই। আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানেই ধরে নেওয়া ছেলে-মেয়ে আলাদা। আর একটা বিষয়, ছোট থেকেই  ছেলেমেয়ের মধ্যে সম্মানসূচক বোঝাপড়া ও স্বাস্থ্যকর ভাব বিনিময়ের সুযোগ না থাকা। খোঁজ নিলে জানা যাবে, ওই ধর্ষক মন পারিবারিকভাবেও খুব একটা সুখী নন। আবার ইন্টারনেট দুনিয়ায় যাদের অবাধ বিচরণ, তারা এমন সব বিকৃত সম্পর্কের গল্প পড়েন বা ভিডিও দেখতে আগ্রহী হয়ে উঠেন, যার মাধ্যমেও বিকৃত কামভাব জেগে উঠতে পারে। মেয়েদের দমন, পীড়ন বা তাদের হেয় করার মধ্যেও কেউ কেউ আনন্দ পায়। এটাও বিকৃতি। এসবের জন্য পারিবারিক দায় যেমন রয়েছে তেমনি রাষ্ট্রিয় দায়ও এক অর্থে কম নয়। এই সমাজ কীভাবে বেড়ে উঠবে, তা ঠিক করে দিতে হবে রাষ্ট্রকেই। সেটা কখনও প্রকাশ্যে, কখনও অগোচরে। কারণ গেলো এক দশকে বোধকরি বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। রাষ্ট্র যদি উগ্রবাদকে মদদ দেয়, ধর্ষককে প্রশ্রয় দেয়, তবে এই সমাজে মেয়েদের হেয় করা যেমন কমবে না, কমবে না ধর্ষকও। একটা সময় আমাদের প্রতিবাদ, প্রতিরোধের ভাষা ছিল বেশ চাঙ্গা। এখন তেমন নেই বললেই চলে। সে কারণে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এসে গ্রাস করছে। তনুসহ অনেক নারী ধর্ষণ বা হত্যার জন্য এখন সবাই যা সোচ্চার সেটা ঘরোয়াভাবে অথবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। দিনাজপুরের ইয়াসমিন হত্যা বা টিএসসিতে এক সময় নারী লাঞ্ছনার জন্য যে প্রতিবাদ উঠেছিল এখন প্রতিবাদের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছে জুকারবার্গের আবিষ্কার। তাও ভালো, সেটা না হলে চেনা যেত না মানুষরূপী অনেক ধর্ষককে। কিন্তু সময় খারাপ আসছে, এখনই যদি ‘ওঠো, জাগো ভগিনী’ বলে সোচ্চার না হই, তবে সামনের সেদিন হবে ভয়ঙ্কর। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের যে কোনও স্তরে হতে হবে সোচ্চার। কারণ এখনও সমাজের ভালোর পক্ষে, শুভর পক্ষে বেশিরভাগ মানুষ। আর যারা সচেতন বলে দাবি করি তাদেরই জাগতে হবে সবার আগে। তবেই না অন্যরা জাগবে।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ