X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

২১ আগস্ট ট্র্যাজেডি: মৃত্যুর দুয়ার থেকে দেখা

নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন
২০ আগস্ট ২০১৯, ২৩:৫৭আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৫:২৯







নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন ২১ আগস্ট, ২০০৪। এক দুঃসহ বেদনার বীভৎস স্মৃতি। এই বীভৎস স্মৃতি বয়ে যাচ্ছি, হয়তো আজীবন বইতে হবে, আমরা যারা সেই রক্তাক্ত দিনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। সেদিন বিকেলে সারাদেশে জঙ্গিদের বোমা হামলার প্রতিবাদে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ এক সমাবেশের আয়োজন করে ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আমাদের আওয়ামী লীগ পার্টি অফিসের সামনে। সারা শহর থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে সেই সমাবেশে যোগ দেন। বঙ্গবন্ধু এভিনিউর এদিক-ওইদিক পুরো রাস্তা কানায় কানায় পূর্ণ ছিল লোকজনে। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা, আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সেই অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ। আমাদের কেন্দ্রীয় সব সিনিয়র নেতাই উপস্থিত ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। আমি সুপ্রিম কোর্ট থেকে অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য রওনা হই অনুষ্ঠানের আগে আগে।

সিনিয়র নেতারা প্রায় সবাই মঞ্চে ছিলেন। নেত্রীর সঙ্গে মঞ্চে ছিলেন জিল্লুর রহমান, আমির হোসেন আমু, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল জলিল, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মতিয়া চৌধুরী, কাজী জাফরউল্লাহ, মোহাম্মদ হানিফ ও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ প্রায় সব সিনিয়র নেতা। যাদের জায়গা হয়নি তারা মঞ্চের নিচে ছিলেন। মঞ্চ বলতে ছিল ট্রাকের ওপর অস্থায়ীভাবে বসার ব্যবস্থা। সারাদেশে আওয়ামী লীগের ওপর যে রাজনৈতিক নির্যাতন চলছিল আমাদের তখন মঞ্চ করারও পরিবেশ ছিল না।
আমরা কয়েকজন আওয়ামী লীগ অফিসের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া, ক্যাপ্টেন তাজ, দীপু মনিসহ অনেকে। আমার যুবলীগের কিছু নেতাকর্মীও পাশে ছিল। মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমান মহিলা লীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে মঞ্চের একেবারে সামনে বসেছেন। রমনা ভবনের উল্টোদিকে দাঁড়ানো আমরা। বিকেল তিনটা থেকে আমাদের অনেক নেতা বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। বিকেল চারটার দিকে শুরু হয় আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের বক্তব্য দেওয়ার পালা।
সারা দেশে বোমা হামলা, পুলিশের হয়রানির প্রেক্ষিতে দলের নেতাকর্মী এবং সমর্থকরা শেখ হাসিনার বক্তব্য শোনার অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি পাঁচটার দিকে বক্তৃতা শুরু করেন। ২০ মিনিট হবে বক্তব্য দিয়েছেন। আমরা বক্তৃতা শেষে মিছিলে যোগ দেবো বলে প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছি, এমন সময় হামলা শুরু হয়।
চারদিক থেকে এত বিকট আওয়াজ হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধ করেছি কিন্তু এই রকম হামলা আমার চোখে দেখা হয়নি। জীবনেও এমন আওয়াজ শুনিনি। মনে হচ্ছিল হিরোশিমা নাগাসাকিতে বোমা বিস্ফোরণ হচ্ছে। এভাবে দফায় দফায় বিস্ফোরণের শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। এটা যে গ্রেনেড হামলা ছিল সেটা তখনও বুঝিনি। আমি তো যুবলীগের চেয়ারম্যান ছিলাম, সব সময় ওই এলাকায় মিটিং মিছিল করেছি। জায়গাগুলো আমাদের নখদর্পণে। তারপরও বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল গ্রেনেডগুলো কোনদিক থেকে আসছে।

একটার পর একটা গ্রেনেড হামলায় তাৎক্ষণিকভাবে আমরা মাটিতে পড়ে যাই। আমার সঙ্গে ক্যাপ্টেন তাজ, সুবিদ আলী ভূঁইয়া আছেন। তারা যেহেতু সেনাবাহিনীর লোক, এ ধরনের ঘটনার গ্রাউন্ডে হিট করতে হয় তাদের জানা ছিল। আমরা সমবেত কেউই বোধহয় শোকের মাসে এমন একটি জঘন্য ঘটনা ঘটবে সেটা স্বপ্নেও ভাবিনি।
যখন চোখ মেলে তাকালাম, দেখলাম সেখানে লোকজন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কারো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। মঞ্চের চারপাশে প্রচুর স্যান্ডেল-জুতা পড়ে আছে। প্রচুর নিহত ও আহত মানুষ ছিল চারপাশে। কারো হাত নাই, কারো পা নাই। আইভি রহমানের অবস্থা দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। উনি বসা, চোখ দুটো খোলা, নির্বাক। ঠিক মঞ্চের সামনে দু’পাশে দু’জন লোক তাকে ধরে রেখেছে। আমার মনে আছে, আমাদের মিরপুরের এমপি ইলিয়াস মোল্লা আহাজারি করছিলেন।
এরমধ্যে নেত্রীকে তার নিরাপত্তায় নিয়োজিত লোকজন গাড়িতে তুলে দিচ্ছিল। তাকে লক্ষ করে গুলি হচ্ছে। আমরা তখনই বুঝে গেছি এই হামলা ওনাকে লক্ষ করেই। খুনিরা বিশ্বাস করেছিল গ্রেনেডে ওনাকে শেষ করা যাবে। যখন ব্যর্থ হয় তখন তারা ওনার গাড়িতে গুলি করে শেষ করে দিতে চেয়েছে। নেত্রীর দেহরক্ষীর গায়ে গুলি লেগেছে। তখনও জানি না নেত্রী বেঁচে আছেন কিনা, কী অবস্থা! ওনার বুলেটপ্রুফ গাড়ি সেখান থেকে দ্রুত চলে যায়।
এরমধ্যে পুলিশ তাণ্ডব চালাতে শুরু করলো। আমাদের নেতাকর্মীরা যখন আহতদের সাহায্য করতে গেছে, ঠিক সে সময় পুলিশ উল্টো টিয়ারগ্যাস, লাঠিচার্জ ও তাদের গ্রেফতার করতে শুরু করেছে। আহতদের সাহায্য করতে এগিয়ে না এসে পুলিশ যখন উল্টো টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জ ও গ্রেফতার করতে শুরু করলো, তখন বোঝা যাচ্ছিল পুলিশ খুনিদের কাভার দেওয়ার জন্য এসেছে। আমারও মুক্তিযুদ্ধের সময় এমন কাভার দিয়েছি। মাইক্রোবাসে করে পুলিশ খুনিদের চলে যেতে সহায়তা করে।
আমি তখনও পড়ে রইলাম। আমার শরীরে তখন এক বিন্দু শক্তি নেই যে উঠে যাবো। মহিলারা কাতরাচ্ছে চারপাশে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে পুরো রাস্তা। এই দৃশ্য দেখে এতই আতঙ্কিত হয়েছিলাম যে, এসব দৃশ্য আমাকে এখনও তাড়া করে বেড়ায়। ওই বীভৎস দৃশ্য মনে হলে আমি ঘুমাতে পারি না। এভাবে চোখের সামনে এত মানুষকে আমি মরতে দেখিনি। মানুষ কাতরাচ্ছেন, কেউ সাহায্যের জন্য আসছেন না। আসতে চাইলেও পুলিশের বাধায় পারছেন না।
আমাকে জাহাঙ্গীর কবীর নানক, মির্জা আজম এরা নিয়ে গেলো পাশের খদ্দর মার্কেটে। সেখানে একটা দোকানে আমরা শাটার বন্ধ করে প্রায় আধঘণ্টা ছিলাম। তখনও জানি না আমি নিজেও আহত হয়েছি। আমার গায়ে রক্ত পড়ছে কপাল থেকে। গ্রেনেডের স্প্লিনটার আমার মুখে কপালে লেগেছে। মুখের বা পাশে ক্ষত করে দিয়েছে। হাঁটুতে লেগেছে স্প্লিনটার। সম্ভবত এটিএন-এর একজন সাংবাদিক আমাকে আমার শরীর থেকে রক্ত পড়ার কথা বলে।
ঢাকা মেডিক্যালের দিকে প্রচুর লোক দৌড়াচ্ছেন। গাড়িতে, রিকশায়, ভ্যানে যে যেভাবে পারছে যাচ্ছেন। আমার কোনও অনুভূতি নেই যে আমি আহত। কী করবো বুঝতে পারছি না। তবে আমি ভীত ছিলাম না। আমার বরং মনে হচ্ছিল হাতে যদি কোনও অস্ত্র থাকতো, যদি খুনিদের কাছে পেতাম, নিজেই গুলি চালাতাম।
আমার গাড়ি হাইকোর্টে রেখে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে আমার ড্রাইভার ফারুক, যে এখনও আমার সঙ্গে আছে, আমাকে নিতে আসে এবং খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যায়। সবাই আমাকে হাসপাতালে নিতে চাইলো। ঢাকা মেডিক্যালে লাশ পড়ে আছে, আহত মানুষের স্তুপ। সেখানে সেবা পাবো না ভেবে ওরা আমাকে হলি ফ্যামেলি হাসপাতালে নিয়ে গেলো। ভর্তি করার পর ডাক্তাররা প্রাথমিক চিকিৎসা দিলো। মুখের আঘাতটা বেশি ছিল। কিন্তু পরামর্শ দিলো শরীরের স্প্লিনটারগুলো যেন দেশের বাইরে গিয়ে বের করি। ৭ দিন পর আমি ব্যাংককে যাই। সেখানে মুখের বাম দিকে অপারেশন করে ডাক্তাররা স্প্লিনটার বের করে। তবে শরীরের সব জায়গা থেকে বের করেনি। কপালে এখনও স্প্লিনটার আছে।
২১ আগস্ট নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নাই। এই ঘটনা ১৫ আগস্টের মতো জাতির ইতিহাসে আরেকটি কলঙ্কিত দিন। ১২ জন লোক ঘটনাস্থলে মারা গেছে, আরও ১২ জন মারা গেছে হাসপাতালে। তিন শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। এখনও আমার মতো অনেকে শরীরে ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন, গ্রেনেডের স্প্লিনটার নিয়ে বসবাস করছেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ থেকে পরিকল্পনা করে জঙ্গিদের দিয়ে সরকারি দল তাদের প্রধান প্রতিপক্ষের প্রধান সারির সব নেতাকে হত্যা করার এমন প্রচেষ্টা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। খুনি, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি তাদের ক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করে চিরতরে রাষ্ট্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চেয়েছে। ওরা জানতো শেখ হাসিনাকে যদি শেষ করা যায় তাহলে তাদের জঙ্গি শাসনের, দুর্নীতি-লুণ্ঠন-অপশাসনের সব বাধা দূর হয়ে যাবে। বাধা দেওয়ার আর কেউ থাকবে না এই দেশে।
আল্লাহ তাদের সেই ইচ্ছে পূরণ করেননি।

লেখক: বাংলাদেশ সরকারের শিল্পমন্ত্রী, জাতীয় সংসদে নরসিংদী-৪ (মনোহরদী-বেলাব) আসনের সদস্য এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
দেশের জন্য কাজ করতে আ.লীগ নেতাকর্মীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
দেশের জন্য কাজ করতে আ.লীগ নেতাকর্মীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
নির্মোহ মূল্যায়নের খোঁজে জাসদ
নির্মোহ মূল্যায়নের খোঁজে জাসদ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ