X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বেলুচিস্তান কি পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে পারবে? (প্রথম পর্ব)

বিদেশ ডেস্ক
২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৯:৩৬আপডেট : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ২১:৫৯

পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশ বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার দাবি অনেক পুরনো, অনেকটা ভারত বা পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মিরের মতোই। পাকিস্তানের এই পিছিয়ে থাকা অঞ্চলটিতে কীভাবে আর কেন স্বাধীনতার চেতনা জন্ম নিল, অতীতে এই আন্দোলন কেমন ছিল, এর ভবিষ্যতই বা কী – তা নিয়ে বিবিসি রেডিও হিন্দি ও উর্দুতে সম্প্রতি একটি সুদীর্ঘ প্রতিবেদন সম্প্রচার করা হয়েছে। বাংলাদেশের মতো করে পাকিস্তান থেকে বেলুচিস্তান স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে পারবে কিনা, প্রতিবেদনে সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে। বিবিসির মূল রেডিও প্রতিবেদনটির ভাষান্তর করেছেন বাংলা ট্রিবিউনের দিল্লি প্রতিনিধি রঞ্জন বসু। তিন পর্বে তা প্রকাশ করা হচ্ছে। আজ প্রথম পর্ব।

বেলুচিস্তান কি পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে পারবে? (প্রথম পর্ব)

“মুঝে জঙ্গে আজাদি কি মজা মালুম হ্যায়

বেলুচিস্তান পর জুল্ম কা ইন্তেহাঁ মালুম হ্যায়

মুঝে জিন্দেগি ভর পাকিস্তান মে জিনে কা দুয়া না দো

মুঝে পাকিস্তান মে ষাট সাল জিনে কা সাজা মালুম হ্যায়!”

এই পংক্তিগুলো লিখেছেন পাকিস্তানের বিপ্লবী কবি হাবিব জালিব, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা আর যার নাম প্রায় সমার্থক। এখানে তিনি যা লিখেছেন, তার অর্থ মোটামুটি এরকম : ‘স্বাধীনতার লড়াইয়ের স্বাদ আমি জানি, বেলুচিস্তানে নির্যাতনের বাস্তবতাও জানি। আজীবন যেন পাকিস্তানে কাটাতে পারি, এমন দোয়া আমায় যেন কেউ না করে – কারণ ষাট বছর ধরে পাকিস্তানে বেঁচে থাকার কী যন্ত্রণা তা আমি খুব ভালোই জানি।’  

আসলে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রায় বাহাত্তর বছর পরেও আজ সেখানকার বৃহত্তম প্রদেশ বেলুচিস্তানকে সে দেশের সবচেয়ে উপদ্রুত ও অশান্ত এলাকা বলে গণ্য করা হয়। সেখানকার ইতিহাস আদতে সহিংসতা আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক করুণ ইতিহাস। বিশিষ্ট পাকিস্তানি সাংবাদিক নাভিদ হুসেনের কথায়, ‘জাতীয় ও আঞ্চলিক নানা কারণে বেলুচিস্তান আসলে একটা ফুটন্ত কড়াইয়ের মতো, যা যে কোনও সময় উথলে পড়তে পারে।’

বেলুচিস্তানের মানচিত্র

বেলুচিস্তানে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে, তার জন্ম কীভাবে? কেনই বা তা এতো দীর্ঘদিন ধরে চলছে?

ভারতের ক্যাবিনেট সচিবালয়ের সাবেক বিশেষ সচিব ও বর্তমানে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য তিলক দেবেশ্বর সম্প্রতি ‘দ্য বেলুচিস্তান কননড্রাম’ নামে একটি গবেষণাধর্মী বই লিখেছেন। তিনি বলছেন, ‘এই অস্থিরতার সূচনা তো ১৯৪৮ সাল থেকেই। কারণ বেশির ভাগ বালোচ মনে করেছিলেন, যেভাবে জোর করে তাদের পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছিল তা বেআইনি ছিল।’

বেলুচিস্তান কি পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে পারবে? (প্রথম পর্ব)

এই বইতে আরও বলা হয়, ‘দেশভাগের সময় ব্রিটিশরা কিন্তু বেলুচিস্তানকে স্বাধীনতা প্রান্ত হিসেবেই ঘোষণা করেছিল। পাকিস্তানও তা প্রথমে মেনে নিয়েছিল, কিন্তু সাতচল্লিশের অক্টোবরে মহম্মদ আলি জিন্নাহ বেলুচিস্তানকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করতে উঠেপড়ে লাগেন। তখন বেলুচ শাসক আহমেদ ইয়ার খানের ওপর নানা ভাবে চাপ প্রয়োগ করা শুরু হয়। তারপরও কিন্তু বেলুচিস্তানের নিজস্ব পার্লামেন্টের দুটি সভাই পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্তির প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। এরপর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পাঠিয়ে আহমেদ ইয়ার খানকে বেলুচিস্তান থেকে অপহরণ করে করাচি নিয়ে আসা হয়, সেখানে তাকে দিয়ে জোর করে অ্যাকসেসন বা সংযুক্তিকরণের দলিলে সই করানো হয়।’

তবে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সব মাপকাঠিতেই বেলুচিস্তান আজও পাকিস্তানের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা প্রদেশই রয়ে গিয়েছে। সত্তরের দশকে যেখানে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৪.৯ শতাংশ আসত বেলুচিস্তান থেকে, ২০০০ সালে সেটাই কমে দাঁড়ায় মাত্র তিন শতাংশে।

আফগানিস্তানে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও প্রাক্তন কূটনীতিবিদ বিবেক কাটজুর কথায়, ‘আয়তনে বেলুচিস্তান পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় প্রদেশ হলেও জনসংখ্যা তুলনায় অনেক কম। কিন্তু গত কয়েক দশকে যেভাবে সেখানে পাশতুন ও সিন্ধিরা আসতে শুরু করেছে বা পাঞ্জাবিরাও বসতি করছে, তাতে বেলুচরাই নিজভূমিতে পরবাসী হতে শুরু করেছেন।’

‘শিক্ষাতেও বেলুচরা অনেক পিছিয়ে, পাকিস্তানের জাতীয় জীবনেও তাদের অংশগ্রহণ কম। অথচ প্রাকৃতিক সম্পদের বিচারে বেলুচিস্তানের কিন্তু অপার সম্ভাবনা ছিল। হ্যাঁ, ওটা শুষ্ক এলাকা – বৃষ্টিপাতও কম, কিন্তু হর্টিকালচারের জন্য আদর্শ ছিল। প্রাকৃতিক গ্যাসেরও বিপুল সম্ভার রয়েছে বেলুচিস্তানে। সুই গ্যাসফিল্ডের কথা তো সবাই জানি। এই সুই থেকে নেওয়া গ্যাস পাকিস্তানের বড় বড় শহরগুলোকে আলোকিত করেছে, আর বেলুচিস্তান রয়ে গেছে অন্ধকারেই’, বলছেন বিবেক কাটজু।

বেলুচিস্তানের সুই গ্যাসফিল্ড

তবে পাকিস্তানের সাংবাদিকদের মধ্যে অগ্রগণ্য, রহিমুল্লা ইউসুফজাই এ কথা মানতে রাজি নন যে পাকিস্তান সরকার ইচ্ছে করে বেলুচিস্তানকে পশ্চাদপদ করে রেখেছে। তার কথায়, ‘প্রথম থেকেই বেলুচিস্তানে জনবল কম ছিল, অবকাঠামোও ছিল বেশ দুর্বল। অবশ্য এটাও ঠিক, সেখানে যতোটা গুরুত্ব দিয়ে উন্নয়ন করা উচিত ছিল ততোটা সরকার কখনও করেনি। কিন্তু সেটা ইচ্ছাকৃত বলে আমার মনে হয় না। আসলে পাকিস্তানের উন্নয়নের প্যাটার্নটাই ভীষণ অসম – কোথাও কম, কোথাও বেশি – এভাবেই বরাবর চলে এসেছে।’

বেলুচিস্তান যে স্ট্র্যাটেজিক দৃষ্টিকোণেও খুব গুরুত্বপূর্ণ, সেটা উপলব্ধি করেছিল ব্রিটিশরাও।

বেলুচিস্তান কি পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে পারবে? (প্রথম পর্ব)

বস্তুত বেলুচিস্তানের যে ৭৬০ কিলোমিটার লম্বা সমুদ্রতট আছে, তা পাকিস্তানের মোট উপকূলরেখার দুই-তৃতীয়াংশ। এখানকার ১ লক্ষ ৮০ হাজার বর্গ কিলোমিটারের সুবিশাল বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকারও তেমন সদ্ব্যবহার আজও করা যায়নি।

তিলক দেবেশ্বরের কথায়, ‘পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের মধ্যে বেলুচিস্তানের সামরিক গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি। সেটা শুধু আয়তনের কারণেই নয়, এর সমুদ্রতটও বিশাল। গোয়াদর গভীর সমুদ্র বন্দরও এই বেলুচিস্তানেই। প্রাকৃতিক সম্পদেরও ছড়াছড়ি এই প্রদেশে। গ্যাস যেমন আছে – তেমনি আছে তামা, স্বর্ণ, ইউরেনিয়ামের মতো বহু মূল্যবান খনিজ।’

‘পাকিস্তানের ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ কেন্দ্রও এখানেই। এমনকী, আমেরিকা যখন ওয়ার অন টেররে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করেছিল, তখনও তারা ঘাঁটি তৈরি করেছিল এই বেলুচিস্তানেই’, জানাচ্ছেন তিনি।

উল্লেখ্য, বেলুচদের আন্দোলনকে পাকিস্তান অবশ্য বরাবরই দমন করতে চেয়েছে সামরিক শক্তি ব্যবহার করেই। আর সেটার সবচেয়ে কঠোর প্রয়োগ দেখা গিয়েছিল ১৯৫৯ সালে নবাব নওরোজ খানের বিদ্রোহ দমনের মধ্যে দিয়ে।

(চলবে)

/বিএ/
সম্পর্কিত
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
সর্বশেষ খবর
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
বিক্রির জন্য সবজি কিনে ফেরার পথে দুই ব্যবসায়ী নিহত
বিক্রির জন্য সবজি কিনে ফেরার পথে দুই ব্যবসায়ী নিহত
সর্বাধিক পঠিত
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!