X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘বিতর্কের ঢেউ যেন নৌকা ডুবিয়ে না দেয়’

প্রভাষ আমিন
২৯ জানুয়ারি ২০২১, ১৪:৫৫আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০২১, ১৪:৫৫

প্রভাষ আমিন শেখ হাসিনা যখন দেশের গৃহহীন মানুষকে ঘর দিচ্ছেন, তখন তার দলের নেতারা নিজেরা ‘কামড়াকামড়ি’ করে নিজেদের ঘর ভাঙার ব্যবস্থা করছেন। এই টানাপড়েন অবশ্য বহু পুরনো। শেখ হাসিনা নিজেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে নিলেও দল বারবার তাকে পেছনের দিকে টেনে ধরেছে। ছাত্রলীগের কোনও অপকর্মে বা দলের অন্তর্দ্বন্দ্বে বারবার আড়াল হয়ে গেছে শেখ হাসিনার অনেক অর্জন। এটা শেখ হাসিনার দুর্ভাগ্য। দলের আরেকটু সহায়তা পেলে তিনি দল ও দেশকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারতেন।

দেশজুড়ে এখন ধাপে ধাপে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। রহস্যজনক কারণে বিএনপি এসব নির্বাচনের মাঠে আছে, কিন্তু লড়াইয়ে নেই। ‘জয়-পরাজয় নয়, অংশগ্রহণই বড় কথা’- এই মনোভাবে খুব হেলেদুলে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। নির্বাচন শেষে ‘এ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়’ এই ব্রিফিংটাই বিএনপির প্রাপ্তি। সাথে বোনাস হিসেবে কোনও কোনও পৌরসভার চেয়ারম্যান বা কাউন্সিলর পদে দলের প্রার্থীদের কেউ কেউ জিতেও যাচ্ছেন। মাঠে লড়াই আসলে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগই। সর্বশেষ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী পেয়েছেন তিন লাখ ৬৯ হাজার ২৪৮ ভোট। আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন পেয়েছেন ৫২ হাজার ৪৮৯ ভোট। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন কেমন হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরে আমি বলবো, গতানুগতিক, আগের মতোই। গত এক যুগে বাংলাদেশে নির্বাচনের একটা স্টাইল দাঁড়িয়ে গেছে। বিরোধী দলের এজেন্টদের কেন্দ্রে আসতে দেওয়া হবে না বা কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হবে না, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা কেন্দ্রের আশপাশে প্রভাব বিস্তার করবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসন ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে থাকবে, নির্বাচন কমিশনও কানে তুলো দিয়ে বসে থাকবে। চট্টগ্রামেও এই স্টাইলের ব্যতিক্রম হয়নি।

বাংলাদেশের সবাই এখন আওয়ামী লীগ হয়ে গেছেন- এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের কেউ কেউ পুলকিত হতে পারেন। কিন্তু যারা রাজনীতিটা বোঝেন, তাদের বরং শঙ্কিত হওয়ার কথা। এখন যে অবস্থা চলছে সেটা সুখকর নয়। নির্বাচনি লড়াইয়ে বিএনপি ব্যর্থ, রাজনীতির মাঠে বিএনপি নিষ্ক্রিয়– এটা যতটা না বিএনপির ব্যর্থতা, তারচেয়ে বেশি সরকারি দলের দায়। সরকার একের পর এক মামলা-হামলা, গুম-খুনে বিএনপিকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। এখন তারা আসলে হাল ছেড়ে দিয়েছে। নির্বাচনি মাঠে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করলেই এজেন্টদের গ্রেফতার করে তাদের আবার ঘরে ঠেলে দেওয়া হয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা আপনি যতই চাপিয়ে রাখবেন, তা কোনও না কোনোভাবে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করবেই। বিরোধী দল নেই বলে, তারা যেসব কথা বলার কথা বা যেসব অভিযোগ করার কথা; সেসব কথা এবং অভিযোগ এখন সরকারি দলের নেতাদের মুখে। বিএনপি এখন অভিযোগ করছে সরকারি দলের নেতাদের উদ্ধৃতি দিয়ে। বিএনপির কাজটা করে দিচ্ছেন আওয়ামী লগি নেতারাই।

আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। বড় দলে অন্তর্দ্বন্দ্ব থাকেই। আওয়ামী লীগের প্রতিটি ইউনিটেই অন্তর্দ্বন্দ্ব আছে। ক্ষমতায় থাকার কারণে এই দ্বন্দ্ব আরও বেড়েছে। কারণ, এখানে স্বার্থের ব্যাপারও আছে। তবে গত এক মাস ধরে রাজনীতিতে রীতিমত সুনামি তুলে দিয়েছেন আবদুল কাদের মির্জা। বসুরহাট পৌরসভার টানা তিনবারের চেয়ারম্যান কাদের মির্জা যা বলছেন, তাই রাজনীতিতে ঝড় তোলার জন্য যথেষ্ট। তারচেয়ে বড় কথা হলো, তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই। তাই তার কথা সুনামি তুলেছে। তিনি আসলে কাউকেই ছাড়েননি। ভাই-ভাবি, নোয়াখালী ও ফেনীর দুই এমপি একরামুল করিম চৌধুরী, নিজাম হাজারী তো আছেনই; পরে যারা তার সমালোচনা করেছেন তাদের সবাইকেও রীতিমতো ধোলাই করেছেন। তার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাননি মাহবুব উল আলম হানিফ, ফারুক খান, নিক্সন চৌধুরী কেউই। পাল্টাপাল্টি এই কাদা ছোড়াছুড়িতে আওয়ামী লীগ নেতারা একে অপরকে ‘পাগল, উন্মাদ, দায়িত্বজ্ঞানহীন, মাতাল, চরিত্রহীন’ বলে গালি দিচ্ছেন। কাদের মির্জা বলেছেন, শেখ হাসিনা জনগণের ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। তিনি এমনও বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ এমপি পালানোর দরজা খুঁজে পাবেন না।

প্রতিদিন আওয়ামী লীগ নেতাদের কথা শুনে আমার মনে হয় মির্জা ফখরুল আর রিজভীও লজ্জা পাচ্ছেন। তারাও এতটা বিষ নিয়ে আক্রমণ করতে পারেন না। একসময় টিভিতে একটা জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনে একটি লাইন ছিল, ‘ঘরের কথা পরে জানলো ক্যামনে?’ আওয়ামী লীগের নেতারা এখন ঘরের কথা সব ফাঁস করে দিচ্ছেন।

তবে কাদের মির্জা এপিসোডে সবচেয়ে বিষাক্ত তীরটি ছুড়েছেন আওয়ামী লীগের এমপি এবং নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরী। ফেসবুক লাইভে এসে তিনি বলেছেন, ‘আমি কথা বললে তো আর মির্জা কাদেরের বিরুদ্ধে কথা বলবো না। আমি কথা বলবো ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে। একটা রাজাকার পরিবারের লোক এই পর্যায়ে এসেছে, তার ভাইকে শাসন করতে পারে না। এগুলো নিয়ে আমি আগামী কয়েকদিনের মধ্যে কথা বলবো। আমার সঙ্গে যদি জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি না আসে, তাহলে আমি এটা নিয়ে শুরু করবো।’ তার অভিযোগ সুনির্দিষ্ট, তবে তথ্যভিত্তিক নয়। ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে অনেকে অনেক অভিযোগ আনতে পারবেন। অনেকে তাকে অপছন্দও করতে পারেন। কিন্তু তিনি রাজাকার পরিবারের সদস্য, এই অভিযোগ এর আগে কেউ করেনি, এমনকি বিএনপিও নয়। যে দলের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদককে ‘রাজাকার পরিবার’-এর সদস্য বলে অভিযোগ আনেন; সে দলের শৃঙ্খলা নিয়ে শঙ্কিত হওয়া উচিত নয় কি? আর একরামুল করিম চৌধুরীর আসল হুমকিটা কিন্তু শেষ লাইনে- জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি না এলে তিনি শুরু করবেন। তার মানে পছন্দের কমিটি পেয়ে গেলে তিনি আর কথা বলবেন না। এটা এক ধরনের ব্ল্যাকমেইল। একরামুল করিম চৌধুরী পরে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেন, দুঃখও প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এত বড় অভিযোগ আনার পর নিছক দুঃখ প্রকাশে কি আর মানুষের মুখ বন্ধ করা যাবে? এই যে এক মাস ধরে আওয়ামী লীগে কাদা ছোড়াছুড়ি চলছে, কারও বিরুদ্ধে কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগে দ্বন্দ্ব তো বরাবরই ছিল। কিন্তু এখনকার এমন সবাই যার যা ইচ্ছা বলার পরিস্থিতি হয়নি আগে।

সমস্যাগুলো সবাই জানেন, কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমেদ হোসেন সমস্যাটা ভালো করে বুঝেছেন এবং বলেছেনও- ‘আওয়ামী লীগ একটি বিশাল সাগরের মতো। বিতর্কের ঝড় সেখানে ঢেউ তুলবে। তবে সেই যেন ঢেউ যেন নৌকা ডুবিয়ে না দেয়।’ এটা আওয়ামী লীগ নেতারা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন, ততই তাদের জন্য ভালো। তবে সবাই যেভাবে বিতর্কের ঝড়ো হাওয়া দিচ্ছেন, নৌকাটা রক্ষা করবে কে?

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ