X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের যত্ন নেবে কে?

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
১৫ মার্চ ২০২১, ১৬:১৪আপডেট : ১৫ মার্চ ২০২১, ১৬:৩০

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
বাংলাদেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস সাংবাদিকতায় নিযুক্ত রয়েছেন। সম্প্রতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাচীন সরকারি কলেজগুলোতেও ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা চালু হয়েছে। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাস সাংবাদিকের নতুন নতুন সংগঠন গড়ে উঠছে। সাংবাদিকতার পূর্ণ কোনও জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের একজন শিক্ষার্থী সাংবাদিকতার প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা থেকেই ক্যাম্পাস সাংবাদিকতায় যুক্ত হচ্ছেন। তারা ক্যাম্পাসে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়েই হাতে কলমে সাংবাদিকতার পাঠ নিচ্ছেন। প্রথম দিকে সংবাদ সংগ্রহ, নির্বাচন ও লেখায় আনাড়িপনার পরিচয় দিলেও সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে গিয়ে একসময় তারা দেশের খ্যাতনামা সাংবাদিকে পরিণত হন। বাস্তব অবস্থাই তাঁকে এমনভাবে গড়ে তোলে যে ‘আনাড়ি ক্যাম্পাস’ সাংবাদিক একসময় দেশসেরা পরিপক্ব সাংবাদিক হয়ে ওঠেন।

এ দেশে গণমাধ্যমের বিকাশের যুগে তরুণ শিক্ষার্থীদের কাছে ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা খণ্ডকালীন চাকরি হিসেবে আকর্ষণীয় পেশায় পরিণত হচ্ছে। যদিও দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা বাস্তবিকপক্ষে পূর্ণকালীন পেশা। ক্যাম্পাসে ঘটনাগুলো সময় মেপে ঘটে না। ফলে ২৪ ঘণ্টাই ক্যাম্পাস সাংবাদিককে সংবাদ সংগ্রহে ক্যাম্পাসে পূর্ণ নজরদারি করতে হয়। সে বিবেচনায় ক্যাম্পাস সাংবাদিককে দক্ষ ‘গোয়েন্দা’ও বলা যায়। গোয়েন্দাদের মতো তিনি অনেক সময় ঘটনা ঘটার আগে ঘটনার আদ্যোপান্ত জেনে সংবাদ প্রকাশ করে ক্যাম্পাসকে ভয়াবহ অঘটন থেকে রক্ষা করেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রকৃত সত্য উন্মোচন করে দোষীদের শাস্তি ও নিরপরাধের মুক্তি নিশ্চিত করেন। একজন ভালো ক্যাম্পাস সাংবাদিককে অনুসন্ধানমনস্ক হতে হয়। অনুসন্ধানী মনের জানালা সব সময় খোলা রাখতে হয়। ঘটে যাওয়া ঘটনা ও সূত্রগুলোকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করতে হয়। সত্য উন্মোচনে তাঁকে থাকতে হয় সদা তৎপর।

একজন পূর্ণকালীন সাংবাদিকের চেয়ে ক্যাম্পাস সাংবাদিকের দায়িত্ব কম নয়। পূর্ণকালীন সাংবাদিক যেকোনও একটি বিষয়ে দক্ষ হলেও ক্যাম্পাস সাংবাদিককে নানা বিষয়ের পণ্ডিত হতে হয়। শিক্ষক-ছাত্ররাজনীতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট তথা অর্থনীতি, ছাত্রছাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা, পড়ার পরিবেশ, সংগঠন সংবাদসহ নানা ইতিবাচক ও নেতিবাচক সংবাদ সংগ্রহে তিনি থাকেন সদা তৎপর। ফলে পূর্ণকালীন সাংবাদিকের চেয়ে ক্যাম্পাস সাংবাদিককে বেশি সময় সংবাদ সংগ্রহে ব্যয় করতে হয়। যদিও সম্মানী প্রাপ্তির দিক দিয়ে আজও ক্যাম্পাস সাংবাদিক খণ্ডকালীন হিসেবে বিবেচিত হন। অর্থের মানদণ্ডে তাই তাঁরা যৎসামান্যই সম্মানী পান। একটি জেলা প্রতিনিধির চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিযুক্ত থেকেও যুগের পর যুগ ক্যাম্পাস সাংবাদিককে খণ্ডকালীন সম্মানী নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।

শীর্ষস্থানীয় ছাড়া প্রায় বেশিরভাগ গণমাধ্যমই অনেক ক্ষেত্রে ক্যাম্পাস প্রতিনিধির সম্মানী নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে নানা টালবাহানা করে। মাসের পর মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করেও একজন ক্যাম্পাস সাংবাদিক যখন যৎসামান্য সম্মানীও পান না, তখন তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। তবে সাংবাদিকতার প্রতি অসীম ভালোবাসাই তাঁকে চলার পথে শক্তি জোগায়। তাই সম্ভাবনাময় ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার বিকাশে গণমাধ্যমগুলোর উচিত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা, ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের প্রাপ্য সম্মানী ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা।

একজন দক্ষ, সৎ ও সাহসী গণমাধ্যমকর্মী তৈরির প্রাথমিক শিক্ষালয় হিসেবে ক্যাম্পাস সাংবাদিকতাকে বিবেচনা করে এর বিকাশে সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। সম্ভাবনাময় ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার সংকটগুলোও দূর করতে হবে। উপযুক্ত সম্মান ও সম্মানী পেলে ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা আরও আকর্ষণীয় পেশায় পরিণত হবে, এতে কোনও সন্দেহ নেই। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও ছাত্রনেতাদের এগিয়ে আসতে হবে। ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার বিকাশে উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার কোনও নীতিমালা না থাকায় এই পেশাকে নানাজন নানাভাবে বিতর্কিত করছেন। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে হলুদ সাংবাদিকতা চলছে। সংবাদপত্রের আস্থার সুযোগ নিয়ে অনেক সময় দুর্জনেরা ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার নামে মিথ্যা, খণ্ডিত ও বিকৃত সংবাদ প্রকাশ করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের চরিত্র হননে মেতে ওঠে। তাই নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে আরও সতর্ক হতে হবে। নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে অতি উৎসাহী ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের পাঠানো সংবাদ প্রয়োজনে ভিন্ন উৎস থেকেও যাচাই করা যেতে পারে। এভাবে সংবাদের সত্যতা যাচাই করলে ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার মান বজায় থাকবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

ক্যাম্পাস সাংবাদিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হওয়ায় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের পর তাঁর শিক্ষাজীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। ফলে শিক্ষার্থী হিসেবে তাঁর শিক্ষাজীবনের নিশ্চয়তাদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের জন্য স্বতন্ত্র নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে। ওই নীতিমালায় মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য যেমন সাংবাদিকের শাস্তির বিধান থাকবে; তেমনি সত্য ও নির্মোহ সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের জন্য রক্ষাকবচ থাকতে হবে। ইতিবাচক সংবাদ প্রকাশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের মধ্যে বার্ষিক পুরস্কার প্রদান করা হলে ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশের প্রবণতা কমবে বলে আশা করা যায়।

ক্যাম্পাস সম্পর্কিত নানা ধরনের সংবাদ প্রকাশের কারণে একজন ক্যাম্পাস সাংবাদিক অল্প সময়ের মধ্যে ক্যাম্পাসে পরিচিত মুখে পরিণত হন। ফলে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, ডিন, প্রক্টর, রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ প্রশাসনিক দায়িত্বে নিযুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। নিজ বিভাগের শিক্ষক ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এভাবে একজন সৎ ক্যাম্পাস সাংবাদিক সবার প্রিয়পাত্রে পরিণত হন। এক অর্থে তাঁর সমবয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিনি ক্যাম্পাসের নায়ক হয়ে ওঠেন। ছাত্রনেতারা ক্যাম্পাসের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হলেও তাঁরাও তাঁর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন। তবে সুযোগ পেলেই ছাত্রনেতারা সাংবাদিকদের নানাভাবে হয়রানি করেন। এমনকি হামলা-মামলার ঘটনাও ঘটে।

গত কয়েক বছরে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রায় ৩০ জন সাংবাদিক ছাত্রনেতাদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব এর সঙ্গে যোগ করলে তা শতাধিক হবে। এ ছাড়া ক্যাম্পাসে সাংবাদিকরা বিভিন্ন দলমতে বিভক্ত হয়ে পড়ায় অনেক সময় নিজেদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির কার্যক্রম স্থগিত হওয়ার ঘটনাও বিরল নয়। সাংবাদিকদের মধ্যে অনৈক্য অন্য সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণে উৎসাহিত করে। তাই ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের উচিত দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন করা, সাংবাদিকতার পেশাকে রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া। প্রকৃতপক্ষে সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হলে ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার অনেক সংকট দূর হবে।

পরিশেষে ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা হচ্ছে সাংবাদিকতার আঁতুড়ঘর। গণমাধ্যম, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষক ও ছাত্রসংগঠনগুলো আন্তরিক হলে ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা সম্ভাবনাময় পেশা হিসেবে বিকশিত হবে। তবে এ ক্ষেত্রে ক্যাম্পাস সাংবাদিকদেরও দায়িত্ব কম নয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সবার কাছে নিজেদের ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে তাঁদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ‘গ্লাসটির অর্ধেক খালি নয়, অর্ধেক পূর্ণ’—এমন দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁদের প্রতি অন্যদের ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলবে। আর তাঁদের প্রতি অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার অনেক সংকট দূর করার পাশাপাশি একে সম্ভাবনাময় পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
‘শো মাস্ট গো অন’
চিকিৎসা সুরক্ষা আইন জরুরি‘শো মাস্ট গো অন’
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ