X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মিতা হক একজন নিরহংকার শিল্পীর নাম

ড. জেবউননেছা
১১ এপ্রিল ২০২১, ১৮:১৮আপডেট : ১২ এপ্রিল ২০২১, ১৩:৩২

ড. জেবউননেছা ক’দিন আগে বাংলাদেশ ফেডারেল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টের প্রাক্তন মহাসচিব আবদুল জলিল ভূইয়া ভাইকে (চাচাতো ভাই) ফোন দিলাম, তার করোনা সম্পর্কে খবর জানার জন্য। ভাইয়া জানালেন, মিতার করোনা হয়েছে। মিতাকে একটা ফোন দিও। আমি বললাম আচ্ছা। এরপর জানা গেলো, আপা ৭ এপ্রিল, ২০২১ইং তারিখে করোনা নেগেটিভ। শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।

আজ সকাল ৬টা ২০ মিনিটে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মিতা হক (চাচাতো বোন) ছেড়ে গেলেন এই নশ্বর পৃথিবী।

সকাল থেকেই বিষণ্ন মিতা আপাকে হারিয়ে। সামাজিক মাধ্যমে চোখ বুলাই, শত শত মানুষ মিতা আপাকে নিয়ে লিখছেন। কেউ মিতা আপার বন্ধু, কেউ পরিজন, কেউ শিক্ষার্থী, কেউ ভক্ত।

আমি কী লিখবো আপাকে নিয়ে খুঁজে পাই না। কারণ, আপা তো আমার কাছে একজন শুধু একজন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী নন। তিনি আমার বড় বোন। তিনি আমার চাচাতো বোন। দাদির বংশের গর্বিত সন্তান। কিন্তু যখন দেখি মিতা আপাকে নিয়ে সবাই লিখছেন, তখন মনে হলো, মিতা আপা তিনি শুধু আমার বোন নন। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রীয় সম্পদ। বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের এই শোকে সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন। সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন এবং সর্বমহল।

কান্নায় ভেসে ভেসে যখন ক্লান্ত হয়ে যাই, তখনই সামাজিক মাধ্যমে মিতা আপাকে নিয়ে সবার লেখা পড়ি। গর্বে ভাসি, শোকে কাঁদি।

সকালে কেরানিগঞ্জে চাচাদের কাছ থেকে জানতে চাই মিতা আপার শেষ শয়নের ব্যবস্থা কোথায় হবে? জানান, পারিবারিক কবরস্থানে। মিতা আপার বাবা-মায়ের পাশে।

আমি অপারগ হয়ে যাই। সবুজের এক নির্জন গ্রামে গাজীপুরে এসেছিলাম, ভেবেছিলাম স্বস্তির নিশ্বাস গ্রহণ করে কয়টা দিন থাকবো। তা আর হলো কোথায়। মিতা আপা যে আমাকে ফেলে চলে গেলেন, আমি যে ভীষণ রকমের আত্মিক ক্রন্দনের মধ্যে পড়ে রইলাম, আপা কি সেই খবর জানতে পেলেন? শুনতে পেলেন আমাদের ডুকরে ডুকরে কান্নার শব্দ, স্পর্শ কি পেলেন চোখের নোনা জলের?

শুধু জানি লেখাটি যখন লিখছি তখন আপা (মিতা হক) সাড়ে তিন হাত কবরের বাসিন্দা হয়ে গিয়েছেন। সকাল থেকে সবার ক্রন্দন আর আফসোসে মিতা আপাকে নিয়ে পড়তে শুরু করি। পড়তে পড়তে বিস্মিত হই। এই সেই মিতা আপা আমার বোন, যাকে বুঝতেই পারিনি কখনও। প্রশাসনের শিক্ষার্থী ছিলাম, তাই গবেষণা প্রশাসন, মুক্তিযুদ্ধ এসব বিষয় নিয়েই। রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে গবেষণা করিনি বলেই হয়তো রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী মিতা হককে নিয়ে গবেষণা করা হয়নি। আজ নিজেকে অথর্ব মনে হচ্ছে। কেন তিনি বেঁচে থাকতে তার জীবনটি নিয়ে কাজ করার জন্য এগিয়ে গেলাম না। কেন? তিনি তো আমার ঘরের, পরিবারের একজন ছিলেন। অনুতপ্ত হই বারবার। অশ্রুসিক্ত হই। স্মৃতিকাতর হই। লজ্জিত হই।

মিতা আপার সঙ্গে আমার স্মৃতিগুলো বিশেষ ধরনের। একদিন দেখি রাজধানী আগারগাঁওয়ে নবনির্মিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছেন, আমি এগিয়ে গেলাম। আপাকে সালাম দিলাম। আপা জড়িয়ে নিলেন।

কেরানিগঞ্জের আটি ভাওয়াল উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়টি (১৯৫৬) আমাদের পূর্ব পুরুষের দানকৃত বিদ্যালয়। সে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের নিয়োগ বোর্ডে আপাও গেলেন, আমিও গেলাম।

একদিন ভরদুপুরে ছেলেকে মোহাম্মদপুরে কোচিংয়ে দিয়েই গাড়ি নিয়ে ছুটে গেলাম মিতা আপার কেরানিগঞ্জের বাড়িতে। আপা জোর করে নানা পদ দিয়ে ভাত খাওয়ালেন। আমাকে বললেন, ‘আর একদিন সারাদিনের জন্য আসবা। দুই বোন মিলে গল্প করবো।’

এরপর গত বছর জুলাই মাসে কেরানিগঞ্জের আটি ভাওয়াল উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম ফুফাত ভাইয়ের দানকৃত অর্থ পৌঁছে দিতে। বিদ্যালয়ে গিয়েই আপাকে ফোন দিলাম। তিনি বললেন, কিডনি ডায়ালাইসিস করতে ঢাকা আছেন। আমার মনটা খারাপ হলো হবে না এই ভেবে। কিন্তু অবাক করে দিয়ে আর এক চাচাতো ভাই ৭১-এ শহীদ জিয়াউল হক কাকার ছেলে জয় ভাই আমাকে জানালেন, মিতা আপা স্কুল গেটে গাড়িতে অপেক্ষা করছেন আপনার জন্য। আমি ছুটে গেলাম, গিয়ে দেখি আপা পিপিই পরা, মাস্ক পরা। আমাকে বললেন তোমাকে একনজর দেখতে এসেছি। ডায়ালাইসিস করে এলাম। আমি বললাম, আপা আপনার একুশে পদকটি হাতে নিয়ে দেখা হলো না। আপা বললেন, করোনার প্রকোপ বন্ধ হলে বাসায় এসো। তখন দেখাবো। আমার দাদির পরিবারে আর একজন একুশে পদক এবং স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত আছেন। যিনি স্বাধীন বাংলা শিল্পী সংস্থার প্রধান উদ্যোক্তা, বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ওয়াহিদুল হক, তার একুশে পদকটি হাতে নিয়ে দেখা হয়নি। তাই আগ্রহ ছিল ভীষণ। অনেকে মিতা আপাকে বলে থাকেন ওয়াহিদুল হক চাচার কন্যা। আসলে তা নয়। মিতা আপা প্রথিতযশা সাংবাদিক রেজাউল হক বাচ্চু’র মেয়ে। যিনি ওয়াহিদুল হকের ভাই।

ওয়াহিদুল হক চাচার মেয়ে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের অধ্যাপক অপালা ফরহাত নভেদ। তিনি বেশ কয়েক বছর আগে ওপারে চলে গিয়েছেন।

কয়দিন পূর্বে শিক্ষা ও চাকরি ক্যাটাগরি ক্ষেত্রে ঢাকা বিভাগ ‘জয়িতা’ সম্মাননা অর্জনের পর আপাকে কল দিলাম। বললেন, তুমি তো আমাকে ছাড়িয়ে যাবে। তুমি আমাদের বংশের গৌরব। আমি বললাম, শুধু দোয়া করবেন। এর কয়দিন পর একটি ওয়েবনিয়ারের জন্য ফোন দিলাম, একুশ নিয়ে কথা বলার জন্য। আমি বললাম, আপা এই ওয়েবনিয়ারটি একুশ নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে। আপনি একজন একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তি, থাকবেন কবি মু. জালাল উদ্দিন নলুয়া (মিতা আপার চাচা, আমার বাবা), যিনি একুশ নিয়ে প্রথম তথ্যভিত্তিক নাটক রচনা করেছেন, থাকবো আমি, কারণ গ্রন্থটি আমি সম্পাদনা করছি। কিন্তু ওয়েবনিয়ারটি অনিবার্য কারণবশত হবে না বলে ফোন দিতেই আপা বললেন, আমি রেডি হয়ে আছি, আমি বললাম, আপা, আজকে ওয়েবনিয়ারটি হচ্ছে না।

তিনি বললেন, আচ্ছা পরে জানিও। এই ছিল শেষ কথা আপার সঙ্গে।

লেখকের সঙ্গে মিতা হক

মিতা হক ছিলেন শিশুর মতো। একজন নিরহংকার মানুষ। যিনি তার সরলতা দিয়ে আপামর মানুষের সঙ্গে মিশে যেতেন। যা এ যুগে বিরল। এত ভারী একজন গুণী শিল্পী, যিনি ২০০’র বেশি রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেছেন। বের হয়েছে যার ২৪টি অ্যালবাম। ১০টি বাংলাদেশ থেকে, ১৪টি ভারত থেকে। যিনি ছায়ানটের রবীন্দ্রসংগীত বিভাগের প্রধান ছিলেন। যিনি ‘সুরতীর্থ’ নামে একটি সংগীত বিদ্যালয় পরিচালনা করেছেন। যিনি ২০১৬ সালে শিল্পকলা পদক অর্জন করেছেন, বাংলা একাডেমি থেকে অর্জন করেছেন রবীন্দ্র পুরস্কার। অতঃপর অর্জন করেছেন একুশে পদক। তিনি বাংলাদেশ বেতারের সর্বোচ্চ গ্রেডের তালিকাভুক্ত শিল্পী। অথচ মিতা হকের মাঝে অহংকার দেখিনি কোনোদিন। দেখিনি কাউকে কষ্ট দিয়ে কথা বলতে।

এমন একজন সহজ সরল, নিরাভরণ মানুষ এমন করে চলে যাবেন, এমন করে কেউ কি ভেবেছি। তিনি যে একজন যোগ্য শিক্ষক ছিলেন, তার একটি উদাহরণ পাই, তার একজন শিক্ষার্থী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লিখেছেন, ‘মিতা আপা গুরু আমার, আমি তো কাঙাল হয়ে গেলাম’। একজন শিক্ষকের প্রাপ্তি এর চেয়ে বেশি আর কী।

ব্যক্তি মিতা আপার আর একটি ভূমিকা ছিল, সেটি হলো তার অবুঝ ভাই বাবুকে মাতৃস্নেহ, পিতৃস্নেহ দিয়ে লালন পালন করতেন। মাঝে মাঝে বাবু ভাইকে নিয়ে ঘরের কাপড় পরেই সামাজিক মাধ্যমে ছবি আপলোড করতেন।

তিনি ছিলেন স্নেহময়ী মা। একমাত্র কন্যা রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ফারহিন খান জয়িতাকে নিয়ে তার ছিল সুখের স্বর্গ। মেয়েকে নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন।

আমিনা হক ছিলেন ছায়ানটের শিক্ষার্থী এবং নজরুলসংগীত শিল্পী। তিনি আমার চাচি (মিতা আপার মা)। চাচি তার বিয়ের পূর্বে ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ গীতিনাট্য পরিবেশন করতে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন, তার ভাইদের সঙ্গে। মিতা আপার বড় মামা এবং ছোট মামা গানের শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু পিতৃসূত্রে চাচা ওয়াহিদুল হক, সনজিদা খাতুনের পরশে ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী। ১৯৭৪ সালে বার্লিনে ‘সামার ক্যাম্পে’ অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৭ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘গীতবিতান’ অনুষ্ঠানে মিতা হক গান পরিবেশন করেন। এটিই বাংলাদেশ টেলিভিশনে তাঁর অভিষেক। ১২ বছর বয়সে ওস্তাদ মো. হোসেন খানের কাছে উচ্চাঙ্গসংগীত শিখেন।

মিতা আপা অভিনেতা ‘যুবরাজ’ নামে খ্যাত খালেদ খানের একজন যোগ্য জীবনসঙ্গী ছিলেন। তার ঘরের চারদিকে ছবি হয়ে হাসে একটি মানুষ, তিনি খালেদ খান।

এমন হাসি-খুশি নিরাভরণ মানুষটির চিরবিদায়ে আজ স্তব্ধ হয়ে আছে প্রকৃতি। তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন, বাবা-মায়ের মাঝে কেরানিগঞ্জের পারিবারিক কবরস্থানে।

রেখে গেলেন জয়িতাকে তার স্মৃতি হিসেবে। রেখে গেলেন সংগীত। রেখে গেলেন আমাদের। সবাইকে যেতে হবে। কিন্তু মিতা আপা আগেই চলে গেলেন।

সামাজিক মাধ্যম, গণমাধ্যমে মিতা হকের জনপ্রিয়তা দেখে মনে হয়েছে, শুধু স্তব্ধ পরিবারই হয়নি। স্তব্ধ হয়েছে সাংস্কৃতিক অঙ্গন এবং অসংখ্য ভক্ত। কৃতজ্ঞতা জানাই, ভারতীয় গণমাধ্যমকেও। আমাদের পুরো পরিবার কৃতজ্ঞ হয়ে যাই। আমাদের এই শোকে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

মিতা হক একজন সংগীতশিল্পী। যার হারিয়ে যাওয়ায় হারিয়েছে সংগীতের একজন নক্ষত্র।

আমার বোন মিতা আপা এখন দূর আকাশের শূকতারা। যে জ্বলবে সারাদিন। আর আমরা দেখবো।

তাঁর কণ্ঠের কত গান মনে পড়ছে। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে,

‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে

ছুটেছে মন মাটিতে পানে।’

হ্যাঁ, মিতা হক মাটির টানেই মাত্র ৫৯ বছরে চলে গেলেন। পুরাতন প্রাণের টানেই গেলেন বাবা মায়ের কাছে।

মিতা আপা, তুমি শুধু আমার বোন নও। তুমি সবার। তুমি আলোর, তুমি ভালোর। তুমি দূর করেছো সকল কালোর। তাই তো তুমি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলে, রবীন্দ্রনাথের গান তোমাকে ধৈর্য শিখিয়েছে, মানুষের ত্রুটি নয়, সৌন্দর্য খুঁজতে শিখিয়েছে।

৫০ বছর ধরে যে মিতা হক সুর তুলেছেন, সে মিতা হকের হারমোনিয়াম, তবলা, তানপুরা পড়ে আছে সুরের সাক্ষী হয়ে।

মিতা হকরা একবারই আসে পৃথিবীতে।

প্রিয় মিতা আপা,

‘তুমি রবে নীরবে

হৃদয়ে মম’

বিনম্র শ্রদ্ধা তোমাকে আপা। তুমি ঘুমাও চিরশান্তিতে।

 

লেখক: অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
‘হিট ইমারজেন্সি’ জারির আহ্বান সাইফুল হকের
‘হিট ইমারজেন্সি’ জারির আহ্বান সাইফুল হকের
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
শনিবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
শনিবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ