গত ৫ এপ্রিল থেকে লকডাউন চলছে। ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে কঠোর লকডাউন। এই কঠোর লকডাউন আগামী ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। চলমান লকডাউনে যারা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তাদের সহায়তায় বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। নগদ অর্থ, খাবার, টিসিবির মাধ্যমে সাশ্রয়ে নিত্যপণ্য বিক্রি, কৃষকদের সহায়তার মতো বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পরিবারপ্রতি ৫০০ বা ২৫০০ টাকা
করোনায় কর্মহীনদের জন্য ইতোমধ্যে ৫৭২ কোটি ৯ লাখ ২৭ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এখান থেকে লকডাউন চলাকালীন কর্মহীন প্রতিটি পরিবারকে নগদ ৫০০ টাকা হারে সহায়তা দেবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। বরাদ্দকৃত অর্থ এরই মধ্যে প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ ও সিটি কপোরেশনের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে পৌঁছে গেছে। এই কর্মসূচির আওতায় দেশের প্রায় এক কোটি ২৪ লাখ ৪১ হাজার ৯০০ পরিবারকে ভিজিএফ (ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং) কর্মসূচির আওতায় এ আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।
সূত্র জানিয়েছে, পাশাপাশি গতবছরের মতো এ বছরও করোনা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ৩৬ লাখ পরিবারকে আর্থিক সহায়তা বাবদ আড়াই হাজার টাকা করে দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে এমন তথ্য জানানো হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, আসন্ন ঈদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঈদ উপহার হিসেবে ৩৬ লাখ ২৫ হাজার পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেবেন। সহায়তার এ অর্থ গতবছরের মতো এ বছর উপকারভোগী প্রত্যেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হাতে পাবেন।
খাবার
কঠোর লকডাউন মেয়াদ বাড়লে প্রতিটি কর্মহীন পরিবারকে খাবার সহায়তা দেওয়ারও চিন্তাভাবনা চলছে। এর মধ্যে থাকবে ১০ কেজি চাল, এক কেজি তেল, এক কেজি ডাল, পাঁচ কেজি আলু ও এক কেজি লবণ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
কৃষকদের সহায়তা
কয়েকদিন আগে দেশের কয়েকটি এলাকায় হঠাৎ করে আসা ঘূর্ণিঝড় ও কঠিন তাপদাহে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষকের মাঠের বোরো ধান। এমন ক্ষতিগ্রস্ত এক লাখ কৃষকের প্রত্যেককে একাকালীন পাঁচ হাজার টাকা হারে অর্থ সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ জন্য এরই মধ্যে বরাদ্দকৃত ৫০ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ছাড় করা অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পৌঁছেও গেছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কৃষকের হাতে সহায়তা বাবদ প্রতি কৃষকের হাতে পাঁচ হাজার টাকা পৌঁছে দেবেন। অর্থ মন্ত্রণালয ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ওএমএস ও টিসিবি
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, স্বল্প আয়ের মানুষের খাদ্যের মৌলিক চাহিদা পূরণে লকডাউনের মধ্যেও দেশের বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের শহরগুলোতে ন্যায্যমূল্যে খোলা বাজারে (ওপেন মার্কেট সেল বা ওএমএস) চাল ও আটা বিক্রয় কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। সারাদেশে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের শহরগুলোয় ৭১৫ জন ওএমএস ডিলারের মাধ্যমে মোট ৭১৫টি বিক্রয় কেন্দ্রে (১০টি ভ্রাম্যমাণ ট্রাকসহ) ৭৩৩ মেট্রিক টন চাল ও ৭৯৬ মেট্রিক টন আটা বিক্রয় চলমান রয়েছে। শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া সপ্তাহে ছয় দিনই এই কার্যক্রম চলমান থাকবে।
এদিকে লকডাউনের মধ্যেও ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) সাশ্রয়ী দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রয় কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে জানিয়েছেন বাণিজ্য সচিব জাফর উদ্দিন। সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে এ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে বলে জানানো হয়েছে। সারাদেশে টিসিবি প্রতিদিন ৫০০টি ভ্র্যম্যমাণ ট্রাকে ছয়টি পণ্য বিক্রি করছে। ট্রাকে প্রতি কেজি সয়াবিন তেল ১০০ টাকা, চিনি, ছোলা ও মসুর ডাল ৫৫ টাকা কেজি দরে এবং খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। পেঁয়াজের কেজি ২০ টাকা।
কারা পাবেন সহায়তা
জানা গেছে, দেশের ৬৪টি জেলার ৪৯২টি উপজেলার জন্য ৮৭ লাখ ৭৯ হাজার ২০৩টি কার্ড এবং ৩২৮টি পৌরসভার জন্য ১২ লাখ ৩০ হাজার ৭৪৬টি কার্ডসহ মোট এক কোটি ৯ হাজার ৯৪৯টি ভিজিএফ কার্ডের বিপরীতে ৪৫০ কোটি ৪৪ লাখ ৭৭ হাজার ৫০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পরিবারপ্রতি ১০ কেজি চালের সমমূল্য, অর্থাৎ কার্ডপ্রতি ৪৫০ টাকার সঙ্গে ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৫০০ টাকা হারে আর্থিক সহায়তা দিতে উপজেলাগুলোর জন্য ৩৯৫ কোটি ছয় লাখ ৪১ হাজার ৩৫০ টাকা এবং পৌরসভাগুলোর জন্য ৫৫ কোটি ৩৮ লাখ ৩৫ হাজার ৭০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। যা এরইমধ্যে পৌঁছে গেছে।
একইসঙ্গে কোভিড পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় পরিবারকে তাৎক্ষণিকভাবে খাদ্য সহায়তার জন্য ১২১ কোটি ৬৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। ৬৪টি জেলার চার হাজার ৫৬৮টি ইউনিয়নের প্রতিটিতে দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা হারে মোট ১১৪ কোটি ২০ লাখ টাকা মানবিক সহায়তাও দেওয়া হবে। সারাদেশের ৩২৮টি পৌরসভার অনুকূলে মোট পোঁচ কোটি ৬৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর, গাজীপুর ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের জন্য সাত লাখ টাকা হারে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, বরিশাল এবং সিলেট সিটি করপোরেশনের জন্য পাঁচ লাখ টাকা হারে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
একইসঙ্গে দেশের ৬৪টি জেলার জেলাপ্রশাসনের অনুকূলে ‘এ’ ক্যাটাগরির জন্য ২ লাখ টাকা ‘বি’ ক্যাটাগরির জন্য এক লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ‘সি’ ক্যাটাগরির জন্য এক লাখ টাকা হারে মোট এক কোটি ৭৭ লাখ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার সোহাগদল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ জানিয়েছেন, বরাদ্দকৃত অর্থ কিছুটা হাতে পেয়েছি। বাকিটা ২/১দিনের মধ্যেই পাবো। ইতোমধ্যেই ইউনিয়নের কমহীন মানুষ যারা এই এলাকার বাইরে দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলায় কাজ করে তাদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তাদের কাছে মোবাইলের মাধ্যমে সহায়তার টাকা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক জটিলতা সৃষ্টি না হলে দ্রুতই উপকারভোগীরা এ সহায়তা পাবেন।
এদিকে নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলার বালুভরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শেখ আয়েন উদ্দিন জানিয়েছেন, জাতীয় পরিপত্র অনুযায়ী এক এলাকার মানুষের অন্য এলাকায় গিয়ে সরকারি কোনও সহায়তা পাওয়ার সুযোগ নাই। এখানকার মানুষ যেখানেই কর্মহীন হোক না কেনও তাকে এখন থেকেই তালিকাভুক্ত হতে হবে এবং সহায়তা নিতে হবে।
তিনি জানান, করোনাকালে সরকারের সহায়তা বাবদ বরাদ্দ আসতে শুরু করেছে। আগেই এখানকার কর্মহীন মানুষের তালিকা করা হয়েছে। বরাদ্দ পাওয়া মাত্র তা উপকারভোগীর হাতে পৌঁছে দেওয়া হবে। এই ইউনিয়নের কর্মহীন পরিবার যেখানেই থাকুক না কেনও সরকারি সহায়তা সময়মতো পেয়ে যাবেন বলেও জানান তিনি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান জানিয়েছেন, ‘কঠিন লকডাউনের কথা বিবেচনা করেই সরকার এরই মধ্যে ৫৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে, যা ইতোমধ্যেই পৌঁছে গেছে। এই বরাদ্দ থেকে প্রতিটি কর্মহীন পরিবার নগদ ৫০০ টাকা পেয়ে যাবেন। তবে করোনা সংক্রামণ রোধ পরিস্থিতি উন্নত না হলে লকডাউন দীর্ঘায়িত হলে সরকারের তরফ থেকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হবে আগের মতোই।’