X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাবা নূর ।। আহমদ নাদিম কাসমি

উর্দু থেকে অনুবাদ : অজিত দাশ
০৪ মে ২০২১, ১৫:০০আপডেট : ০৪ মে ২০২১, ১৫:০০

[আহমদ নাদিম কাসমি (১৯১৬-২০০৬) উর্দু ভাষার কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যতাত্ত্বিক। নাট্যকার ও ছোটগল্প লেখক। সব মিলিয়ে ৫০টি বই লিখেছেন। সমকালীন উর্দু সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর কবিতা মানবতাবাদে ভাস্বর। ছোটল্পে গ্রামীণ জীবন ফুটিয়ে তোলায় মুনশি প্রেমচন্দের পরেই তাঁর দক্ষতা। প্রায় পঞ্চাশ বছর নিজের প্রভাবশালী পত্রিকা ‘ফুনুন’ সম্পাদনা করেছেন। প্রগতিশীল লেখক সংঘ পাকিস্তানের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।]


‘কই যাও বাবা নূর?’ ছোট এক বাচ্চা জিজ্ঞেস করল।

‘এই তো, ডাকখানায় যাই।’ বাবা নূর দায়িত্বসহ জবাব দিয়ে সামনে এগুতেই বাচ্চারা খিলখিলিয়ে হাসতে লাগল।

দূর থেকে চুপ করে দাঁড়িয়ে মৌলবী কুদরতুল্লাহ ঘটনাটি দেখল। তারপর বাচ্চাদের ডেকে বলল, ‘বাচ্চারা, এমনভাবে হাসতে নেই। আল্লাহ-তাআলার যা মর্জি।’

বাচ্চারা তৎক্ষণাত হাসি থামিয়ে দিলেও যেই মৌলভী কুদরতুল্লাহ চলে গেল তারপর আবার খিলখিলিয়ে হাসতে লাগল। বাবা নূর হাঁটতে হাঁটতে মসজিদের কাছে গিয়ে থামলেন। জুতা খুলে, খালি পায়ে মসজিদের খিলানে চুমু খেলেন, দুই চোখ খিলানে স্পর্শ করালেন তারপর মসজিদ থেকে বের হয়ে আবার হাঁটা শুরু করলেন।

আশপাশের গলি থেকে বাচ্চারা লুকিয়ে লুকিয়ে এমনভাবে বাবা নূরকে দেখতে লাগল যেন তারা লজ্জা পাচ্ছে।

বাবা নূরের পরনে ছিল সাদা ময়লা পাঞ্জাবি। মাথায় টুপি। টুপির নিচ থেকে লম্বা সাদা চুল ঘাড়ের নিচ পর্যন্ত দেখা যায়। মুখের লম্বা সাদা দাড়ি কাঁধ অতিক্রম করে শৃঙ্খলিত হয়ে বুক পর্যন্ত পড়ে থাকত। ফরসা রং, সাদা পাঞ্জাবি পরা, ছয়ফুট লম্বা বাবা নূরের ছোট ছোট দুই চোখের মণি এত কালো ছিল যে, লম্বা সাদা চুলের মাঝে দুই কালো চোখে বাবা নূরকে এক অন্যরকম মানুষ মনে হতো। বাবা নূরের চেহারায় শিশুর মতো এক সারল্য বজায় থাকত সবসময়। ঘর থেকে বের হয়ে ইতিমধ্যে বাজার থেকে মসজিদের খিলান পর্যন্ত কাঁধে রাখা সাদা চাদরটা প্রায় তিন-চার বার দুই কাঁধে বদল হয়েছে।

‘ডাকখানায় যাচ্ছেন, বাবা নূর?’ দোকানের পাশ দিয়ে যেতেই দরজায় দাঁড়ানো এক যুবক জিজ্ঞস করল।

‘হ্যাঁ, বাবা। বেঁচে থাকো।’ বাবা নূর জবাব দিলেন।

পাশেই দাঁড়ানো এক বাচ্চা জোরে হাসি দিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল, বাবা নূর ডাকখানায় যায়, বাবা নূর ডাকখানায় যায়।’

‘ভাগ এখান থেকে।’ এই বলে এক যুবক বাচ্চাদের তাড়িয়ে দিল। এর মধ্যে বাবা নূর যতটুকু সামনে এগিয়েছিল, সেখান থেকে একটু থেমে পেছন তাকিয়ে সেই যুবককে বললেন, ‘আহা, বকেছ কেন বাচ্চাদের। ঠিকই তো বলেছে তারা। ডাকখানায় যাই।’ দূর থেকে দৌড়ে দৌড়ে বাবা নূরের পেছনে মিছিলের মতো জড়ো হওয়া বাচ্চারা খিলখিলিয়ে হাসতে লাগল। আশপাশে থাকা যুবকরা ধমক দিয়ে বাচ্চাদের গলির দিকে তাড়িয়ে দিল।

বাবা নূর গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে খেতের মধ্যে ঢুকে গেল। গমখেতের উঁচুনিচু সরু পথ ধরে যাওয়ার সময় বাবা নূরের হাঁটার গতি অনেকটা কমে আসে। তিনি গমখেতের আইল ধরে অনেক সাবধানে হাত-পা বাঁচিয়ে হাঁটতেন যেন বেখেয়ালে তাঁর গায়ে লেগে গমের কচি ডগা অথবা পাতা না ছিঁড়ে যায়। যদি কোনো পথিকের বেখেয়ালে ভেঙে পড়া গমের ডগা আইলপথে ছিঁড়ে পড়ে থাকতে নজরে আসত বাবা নূর সেটাকে তুলে আরেকটি শস্যের গায়ে জুড়ে দিতেন, অথবা যে শস্যের ডগা ছিঁড়েছে সেই শস্যটিকে এমনভাবে ছুঁতেন দেখলে যেকারো মনে হবে তিনি সেটিকে আদর করছেন।

চার কৃষক খেতের আইল ধারে বসে হুকা টানছিল। পাশেই গমখেতে একটা যুবতী মেয়ে দুই হাত চালিয়ে দ্রুত ছোট ছোট আগাছা টেনে তুলছিল। বাবা নূর একটু থেমে এই দৃশ্য দেখতে লাগলেন। এত দ্রুত আগাছা তুলে একটা যুবতী মেয়ে পিঠে বাঁধা ঝুড়িতে ফেলছিল যে বাবা নূরকে বেশ আকর্ষিত করছিল। ‘বাহ! দারুণ!’ বাব নূর দূর থেকে যুবতী কৃষানির প্রতি ইঙ্গিত করে বলতে লাগলেন, ‘এই মেয়ে তো বেশ জাদুকরি। এত দ্রুত হাত চালাতে পারে। কোনায় কোনায় গমের চারা অথচ সেগুলো স্পর্শ না করেই আগাছা তুলে যাচ্ছে। এটা কার মেয়ে?’

‘তুমি কার মেয়েগো?’ বাবা নূর মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন। পেছন ফিরে তাকাতেই এক কৃষকের জবাব এল, ‘আমার মেয়ে, বাবা।’

‘তোর মেয়ে?’ বাবা নূর কৃষকদের দিকে এগুতে লাগলেন। ‘বড় সেয়ানা মেয়েতো, অনেক ভালো কৃষাণি। খোদা দীর্ঘায়ু করুক।’ 

‘আজ কোথায় যাচ্ছেন, বাবা নূর?’ কৃষাণির বাবা জিজ্ঞেস করল।

সেখানে উপস্থিত আরেক কৃষক বলে উঠল, ‘ডাকখানায়।’

বাবা নূর কৃষকদের সামনে একটু থেমে জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ। জিজ্ঞেস করে আসি কোনো চিঠি-টিঠি এসেছে কিনা।’ চার কৃষক স্তব্ধ হয়ে গেল। তারা রাস্তা ছেড়ে দিয়ে দাঁড়ালো আর বাবা নূর সামনে এগুতে লাগল। সবে খেতের শেষপ্রান্তে পৌঁছুতে না পৌঁছুতে মেয়েটি পেছন থেকে ডাক দিয়ে বাবা নূরকে জিজ্ঞেস করল, ‘লাসসি খাবে, বাবা নূর?’

বাবা নূর পেছনে ফিরে তাকালেন এবং গ্রাম থেকে বের হওয়ার পর এই প্রথম হাসি দিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা খাব’ তারপর একটু থেমে আবার বললেন, ‘কিন্তু দেখ মা, একটু তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়। ডাকের মুন্সি হাওয়ার ঘোড়ায় চলে, আবার গিয়ে যদি তাকে না পাই।’

মেয়েটি কাঁধ থেকে আগাছার ঝুড়িটি খেতের মধ্যেই ফেলে এক দৌড়ে খেতের সামনে একটি উঁচু ঢিবিতে রাখা মাটির ঘরা থেকে এলমুনিয়ামের গ্লাসে লাসসি ঢেলে বাবা নূরের কাছে নিয়ে গেল। বাবা নূর একটানে লাসসির গ্লাস খালি করে রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে আশীর্বাদ দিলেন, ‘তোর কপাল লাসসির মতো সাফ-সুন্দর হোক।’ তারপর আবার হাঁটা শুরু করে দিলেন।

 

এদিকে মাদরাসার বারান্দায় বসে ডাকখানার মুন্সি ফর্ম পূরণ করতে করতে গ্রামের কয়েকজন লোকের সঙ্গে গল্প করছিল, ‘আমার শালা করাচিতে চাপরাশির কাজ করত। ওর মৃত্যুর পর ফাতিহা পড়ার জন্য আমাকে করাচি যেতে হয়েছিল। আমি বলব, বন্ধুরা তোমরা একবার হলেও করাচি অবশ্যই ঘুরে এসো, যদিও সেখানে গাঁধা গাড়িতে চড়তে হয়। ওখানে যত মোটরকার, আমাদের গ্রামে মনে হয় তত পাখিও নেই। একেকটা মোটরকারে এত সুন্দরী মেয়েরা বসেছিল যেন আল্লাহর নিজের হাতে বানানো। মানুষের সঙ্গে এই পরিদের কিসের লেনাদেনা! আল্লাহর কুদরতের কথা ভেবে নামাজ পড়ার ইচ্ছে হয়। সেদিন এক বড়লোক বলছিল, আরেকটা যুদ্ধ যদি বেঁধে যায় তাহলে করাচি বিলায়েতের মতো হয়ে যাবে। কতবার যুদ্ধ লাগবে লাগবে বলে, থেমে গেছে। কেউ না কেউ মাঝে বাঁধা দিয়ে ফেলে। শুনছি যুদ্ধ লাগলে মানুষ মারা যাবে। আবার কেউ কেউ বলে যুদ্ধ না লাগলেও তো মানুষ মরবে। যুদ্ধে গুলিতে মরব, নাহলে ক্ষুধায় মরব। ঠিক না।’

‘ঠিকই তো বলেছ’, আরেক গ্রামবাসী জবাব দিল। তারপর একজন জিজ্ঞেস করল, ‘মুন্সিজি, আচ্ছা তাহলে খামগুলো কখন একত্রিত করব?’ মুন্সিজি তার কথা শুনতে শুনতে সামনের দিকে তাকাতেই তার দৃষ্টি কোনো নির্দিষ্ট অক্ষরে আটকে যাওয়ার মতো স্থির হয়ে গেল, সমস্ত মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, আর অনেকটা স্তিমিত কণ্ঠে বলল, ‘বাবা নূর আসছে।’ সবাই পেছন ফিরে তাকাতেই তাদের চেহারাও কেমন জানি কুঁচকে গেল। বাচ্চারা মাদরাসার দরজায় জড়ো হয়ে ‘বাবা নূর, বাবা নূর’ বলে হইহল্লা শুরু করে দিলো। মুন্সিজি তাদেরকে বকা দিয়ে যার যার জায়গায় বসতে বলল। সাদা বোরাকের মতো দেখতে বাবা নূর যতই মাদরাসার দিকে আগাচ্ছিল সবার মুখে কেমন জানি একটা প্রচ্ছন্ন ভীতি তৈরি হচ্ছিল। বারান্দায় এসে বাবা নূর মুন্সিজিকে জিজ্ঞেস করলেন,

—‘কোনো চিঠি এসেছে, মুন্সিজি?’

—‘সকাল সকাল এসে পড়েছেন বাবা’ মুন্সি জি উত্তর দিলো।

—‘কিন্তু আমার ছেলের তো কোনো চিঠি এলো না।’

—‘না’ মুন্সিজি আবার জবাব দিলো।

বাবা নূর চুপচাপ চলে গেল। দূর থেকে যতক্ষণ বাবা নূরের সাদা পাঞ্জাবি, আর চুল দেখা যাচ্ছিল লোকজন স্তব্ধ হয়ে তাকিয়েছিল। তারপর মুন্সি বলতে লাগল, ‘বিগত দশ বছর ধরে প্রতিদিন সকালে বাবা নূর ডাকখানায় আসে। এই একই প্রশ্ন আমাকে জিজ্ঞেস করে, আর একই জবাব নিয়ে চলে যায়। লোকটার একটুও মনে নেই সরকার থেকে পাঠানো সেই চিঠি আমি নিজেই তাকে পড়ে শুনিয়েছিলাম—তার ছেলে বার্মায় বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয়েছিল। যখন থেকে সে পাগল হলো, খোদার কসম বন্ধুরা আজকের পর যদি আর একদিন বাবা নূর এসে আমাকে এই একই প্রশ্ন জিজ্ঞস করতে আসে তাহলে আমিও পাগল হয়ে যাব।’

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!