X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কয়রায় কেন এত দুঃখ?

আমীন আল রশীদ
৩০ মে ২০২১, ১৫:২৩আপডেট : ৩০ মে ২০২১, ১৫:২৩

আমীন আল রশীদ ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে উচ্চ জোয়ারে খুলনার কয়রা উপজেলার ৪টি ইউনিয়নে অন্তত ১০টি স্থানে ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ মেরামতের যেসব ছবি গণমাধ্যমে এসেছে, সেগুলো প্রান্তিক মানুষের টিকে থাকার লড়াইয়ের বড় উদাহরণ। এই লড়াই ও সংগ্রাম আমাদের আরও কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।

স্মরণ করা যেতে পারে, ঠিক এক বছর আগে গত বছরের মে মাসেও এই কয়রা উপজেলার বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে গেলে সেই পানির ওপরে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ পড়েছিলেন স্থানীয়রা; যে ছবি সারা দেশে তোলপাড় তুলেছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিটা ভাইরাল হয়। কারণ, পানির ওপরে দাঁড়িয়ে এমন অভূতপূর্ব ঈদের নামাজের দৃশ্য দেশের মানুষ এর আগে দেখেনি।

এবারও ঈদের কয়েক দিন পরে সেই কয়রার মানুষকেই বেড়িবাঁধ সংস্কারে ধর্ম-দল-মত-পেশা ও বয়স নির্বিশেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাঁধ সংস্কারে নেমে পড়তে হয়। প্রশ্ন হলো, প্রতি বছরই কেন এই এলাকার মানুষকে এমন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়? চারদিকে এত উন্নয়নের জোয়ার, অথচ এই এলাকার মানুষকে কেন প্রতি বছর এমন জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যেতে হয়? কেন এখানে টেকসই বাঁধ নির্মাণ হয় না? এই এলাকার জনপ্রতিনিধিরা কী করেন? সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা কি এখানে পৌঁছায় না? এত দাতা সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী’- তাদের কারও চোখে কি এই কয়রার বিপন্ন মানুষের ছবি ধরা পড়ে না?
গণমাধ্যমের খবর বলছে, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে কয়রার পবনা এলাকার বাঁধটি ভেঙে যায় গত বুধবার। এতে মহারাজপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড পুরোপুরি এবং ১ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের আংশিক সাগরের নোনা পানিতে তলিয়ে যায়। বৃহস্পতিবার সকালে ওই বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন স্থানীয়রা। এ কারণে শুক্রবার অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ একযোগে বাঁধ মেরামতের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার আগের দিন মাইকিং করে বলা হয়, ‘আগামীকাল সকালে মহারাজপুর ইউনিয়নের পবনা এলাকার ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামত করা হবে। আপনারা সবাই ভোরে সেখানে চলে আসুন। মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ান।’ সেই ডাকে সাড়া দিয়ে শুক্রবার ভোর থেকে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হন বাঁধের ভাঙা স্থানে। কেউ বস্তায় মাটি ভরেন, কেউ মাটির বস্তা নিয়ে ফেলেন ভাঙা বাঁধের স্থানে। এই টিকে থাকার সংগ্রামে শামিল হন নারীরাও।

সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কাজ করার পরে জোয়ারের পানি আসার আগেই বাঁধ মেরামত করে ফেলেন স্থানীয়রা। এই শ্রমের কোনও বিনিময় হয় না। কারণ, লড়াইটা সবার। বেড়িবাঁধ ভেঙে গেলে সচ্ছল কৃষকের ফসলের জমি যেমন তলিয়ে যায়, তেমনি আশ্রয়হীন হতে হয় দিনমজুরকেও। সুতরাং ‘কমিউনিটি ফিলিং’ এখানের মানুষের মধ্যে সব সময়ই কাজ করে। যে ‘ফিলিং’-এর কারণে তারা হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ পড়েছিলেন। তখন কেউ কেউ অবশ্য এখানে রাজনীতি ও ষড়যন্ত্রের গন্ধও খুঁজেছিলেন। কিন্তু মানুষের জীবন যেখানে বিপন্ন, সেখানে রাজনীতি বা ষড়যন্ত্র যে হালে পানি পায় না, তা নিয়মিত বিরতিতে যে কয়রার মানুষকে পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়, তাদের চেয়ে ভালো আর কে জানে! প্রশ্ন হলো, যে দেশকে বলা হয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার রোলমডেল, সেই দেশে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে পানির ওপরে সেজদা দেওয়ার দৃশ্যটি বড়ই বেমানান নয় কি?

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০৯ সালের মে মাসেই বৃহত্তর খুলনাকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’। তার দেড় বছর আগেই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ও এই অঞ্চলের অসংখ্য মানুষের জীবন-জীবিকা ধ্বংস করে। অথচ ওই দুটি ভয়াবহ দুর্যোগের পরে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো টেকসই করার দাবি পূরণ হয়নি প্রায় এক যুগেও। হয়নি বলেই রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে যখন হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প চলছে, তখনও সেই হতভাগা বঞ্চিত মানুষগুলোকে পানিতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে হয়।

উন্নয়ন মানে নির্দিষ্ট কোনও এলাকার বা নির্দিষ্ট কোনও একটি জনগোষ্ঠীর জীবন মানের ইতিবাচক পরিবর্তন নয়। বরং উন্নয়ন মানে যেখানে সবাই ভালো থাকে। ফলে প্রশ্ন হলো— উপকূলের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষের জানমাল রক্ষায় সরকারের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা কি যথেষ্ট নয়? এই খাতে সরকারের বরাদ্দ কি যথেষ্ট নয়? এই এলাকার জনপ্রতিনিধিরা এতদিন কী করেছেন?

এখনও প্রতি বছরের ১৫ নভেম্বর সিডর এবং ২৫ মে আইলা দিবসে গণমাধ্যমে একই রকম সংবাদ প্রকাশিত ও প্রচারিত হয় যে, এখনও ঝুঁকিতে উপকূলের লাখো মানুষ। কেন এই ঝুঁকি? কারণ, অনেক জায়গায় বেড়িবাঁধ নেই। যেখানে ছিল, ভেঙে গেছে। অনেক বাঁধ দুর্বল হয়ে গেছে। অনেক সময় স্থানীয়দের অদূরদর্শিতা, বিশেষ করে মাছ চাষের জন্য বাঁধ কেটে বা ছিদ্র করে পানি ঢোকানোর মতো ঘটনায়ও বাঁধ দুর্বল ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যে কারণে জলোচ্ছ্বাস হলে ওইসব জায়গা থেকে গলগলিয়ে পানি ঢোকে। কিন্তু, বাঁধ যেভাবে সংস্কার করা হলে টেকসই হয়, অনেক সময় সেভাবে কাজ হয় না। হাওরে বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের কারণে সেখানে ফসলের কী বিশাল ক্ষতি হয়েছিল,তা দেশবাসীর অজানা নয়।

গত বছরের আম্পানে কয়রা উপজেলায় ১১৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে সাড়ে চার কিলোমিটার পুরোপুরি ভেঙে যায়। ৩৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আংশিক ভেঙে যায়। উপজেলার ৪৭টি গ্রামের দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। তখনও গ্রামবাসী স্বেচ্ছাশ্রমে বেড়িবাঁধ মেরামত করেছেন। এছাড়া দাকোপ, পাইকগাছা, বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়া উপজেলায় প্রায় ৮০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৪০-৫০ মিটার পুরোপুরি ভেঙে যায়। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। প্রশ্ন হলো, গত বছর বাঁধের যেসব অংশ ভেঙে গিয়েছিল সেগুলো কি ঠিকমতো মেরামত করা হয়েছিল? যদি হয়ে থাকে তাহলে এবার ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে কেন সেই একই দুর্ভোগের পুনরাবৃত্তি হলো?

আইলার সঙ্গে ধেয়ে আসা জলোচ্ছ্বাসে খুলনা ও সাতক্ষীরার চারটি উপজেলার ৬০০ কিলোমিটারেরও বেশি বেড়িবাঁধ ধসে যায়। টানা তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষ লোনাপানিতে আবদ্ধ থাকে। অনেকে এখনও ঘরে ফিরতে পারেননি। ১০ বছরেও উন্নয়ন হয়নি কয়রার ১২১ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধের। পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনা ও সাতক্ষীরার মধ্যে সীমানা জটিলতার কারণে এই দুর্ভোগ বলে স্থানীয়রা মনে করেন। অভিযোগ আছে, বাঁধ মেরামতে গত ১০ বছরে যে বরাদ্দ হয়েছে, তার সিংহভাগই লুটপাট হয়েছে।

২০০৭ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর ও তার পরবর্তী পরিস্থিতির ওপর একটানা প্রায় তিন সপ্তাহ সরেজমিন রিপোর্ট করার সুযোগ হয়েছিল। তখন দেখেছি বেড়িবাঁধ ভেঙে গেলে মানুষের কী দুর্ভোগ হয়। ওই সময় দক্ষিণের জেলা ঝালকাঠির যেসব এলাকায় বেড়িবাঁধ না থাকা বা দুর্বল বেড়িবাঁধের কারণে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে বলে তথ্য পেয়েছিলাম, গত বছরের আম্পানেও দেখা গেল সেসব এলাকায় ক্ষতি হয়েছে। কারণ, সিডর ও আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত সুগন্ধা নদীর তীরবর্তী নলছিটির বারইকরণ এলাকার সাত কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সংস্কারের বাইরে জেলার কোথাও সেভাবে কাজ হয়নি। ঝালকাঠি সদর থেকে কাঁঠালিয়া উপজেলার বিষখালী নদীর ৪৮ কিলোমিটার এখনও অরক্ষিত। কোনও বেড়িবাঁধ নেই। অথচ ২০০৭ সালেও এই কথা লিখেছিলাম। সঙ্গত কারণেই ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতেও কাঁঠালিয়া উপজেলার অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। তার মানে ১৩ বছরেও ওই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি।

সিডর আঘাত হানার পরে এই প্রতিবেদকের একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল: ‘ত্রাণ নয়, টেকসই বাঁধ চান উপকূলবাসী’। এই ঘটনার ১৩ বছর পরে অতি সম্প্রতি খুলনার কয়রা উপজেলার মানুষেরা সেই একই রকম স্লোগান বুকে লিখেছেন—যে ছবিও গণমাধ্যমে এসেছে। সুতরাং গত ১৩ বছরে উপকূলের মানুষের জানমাল রক্ষায় আসলে কী কাজ হয়েছে, কতটুকু হয়েছে, সে প্রশ্ন তোলা অন্যায় নয়।

সরকার যে বদ্বীপ বা ডেলটা প্ল্যান ঘোষণা করেছে, সেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উপকূলীয় এলাকার জন্য এক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে টেকসই বাঁধও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ডেল্টা পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, উপকূলীয় অঞ্চলের বিদ্যমান পোল্ডারের কার্যকর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ঝড়বৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস ও লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ মোকাবিলা করা হবে; পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বন্যার ঝুঁকি হ্রাস করা হবে ইত্যাদি।

প্রশ্ন হলো, বরাদ্দ থাকলেই কি তার সঠিক ব্যবহার হয়? বেড়িবাঁধসহ এ রকম অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারি বরাদ্দের কত শতাংশ খরচ হয় তা নিয়ে যেমন প্রশ্ন আছে, তেমনি সেই খরচে যে কাজ হয়, তার মান নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। ২০১৬ সালের ৪ নভেম্বর কার্যকর হয় প্যারিস জলবায়ু পরিবর্তন চুক্তি। এর ৪ বছর পূর্তি উপলক্ষে গত বছরের ৫ নভেম্বর দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন টিআইবি তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গৃহীত সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি কমেনি। বরং দুর্নীতির উদ্দেশ্যে অর্থায়ন, প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের প্রবণতা চলমান। প্রকল্প বাস্তবায়ন নীতি লঙ্ঘন করলেও অভিযুক্ত সংস্থাকে জবাবদিহির আওতায় আনা হয়নি।

সবশেষ খবর হলো, ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান আশ্বাস দিয়েছেন, খুলনার কয়রা এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলো দ্রুত মেরামত করা হবে। প্রশ্ন হলো, এই আশ্বাস কতদিনে বাস্তবায়িত হবে? বাঁধ মেরামত আর সংস্কারের ঘেরাটোপেই কি বন্দি থাকবেন উপকূলের লাখো মানুষ? স্থানীয়রা যে টেকসই বাঁধের দাবি জানিয়ে আসছেন, যে বাঁধ পানির চাপে ভেঙে যাবে না, যে বাঁধ বাঁচাবে তাদের জীবন, ফসলের জমি ও ঘেরের মাছ—সেরকম বাঁধ হবে তো? নাকি কয়েক বছর পরেও এই এলাকার মানুষকে আবারও বলতে হবে, ‘ত্রাণ নয়, টেকসই বাঁধ চাই!’

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
‘শো মাস্ট গো অন’
চিকিৎসা সুরক্ষা আইন জরুরি‘শো মাস্ট গো অন’
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ