X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কতদিন বন্ধ থাকবে?

আমীন আল রশীদ
১৮ জুন ২০২১, ১৭:২৭আপডেট : ১৮ জুন ২০২১, ১৭:২৭

আমীন আল রশীদ আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি বাড়ানোর ঘোষণার পরদিনই শিক্ষার্থীদের কলকাকলিতে মুখরিত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। করোনা পরিস্থিতির কারণে যেসব পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছিল, সেসব পরীক্ষা নেওয়া শুরু হয় গত রবিবার (১৩ জুন)। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নুরুল করিম চৌধুরী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বিভিন্ন ব্যাচের দুটি করে সেমিস্টারের ক্লাস অনলাইনে হলেও ফাইনাল ও মিডটার্ম পরীক্ষা স্বাস্থ্যবিধি মেনে সশরীরে নেওয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রমও স্বাভাবিকভাবে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত চলবে বলে জানান তিনি।

গত ২৬ শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানিয়েছিলেন, ১৩ জুন থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের করোনার টিকার আওতায় আনার ওপর। ওইদিন এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনের শেষ পর্যায়ে শিক্ষামন্ত্রী সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘১২ জুন পর্যন্ত স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকছে—এমন স্ক্রল আপনারা টিভিতে সম্প্রচার করছেন। এটি না করে আপনারা বলুন, ১৩ জুন থেকে স্কুল-কলেজগুলো খুলে দেওয়া হচ্ছে।’ যদিও ১৫ জুন তিনি কেরানীগঞ্জ জাজিরা মোহাম্মদিয়া আলিম মাদ্রাসায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি উদ্বোধনকালে বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিগগিরই খুলে দেওয়া হচ্ছে না। করোনা সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘সংক্রমণের যে ঊর্ধ্বগতি, আপনারাই বলেন কীভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব!’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কবে খুলে দেওয়া যাবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা সম্ভব নয় বলেও তিনি জানান।

বাস্তবতা হলো, যেসব সমস্যা বা বাস্তবতার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হচ্ছে, তা যে শিগগিরই সমাধান হয়ে যাবে, তার কোনও সম্ভাবনা নেই। কারণ, ১৭ কোটি লোকের দেশে অর্ধেক মানুষের টিকা নিশ্চিত করতেও অনেক সময় লাগবে। তাছাড়া পর্যাপ্ত টিকা প্রাপ্তির বিষয়ে এখনও অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। ফলে প্রশ্ন হলো, কিছু দিন পরপরই যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে, তা কতদিন চলতে থাকবে—তা কেউই জানে না।

করোনাভাইরাসের কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। এরপর দফায় দফায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ানো হয়েছে। সশরীরে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকলেও অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে। যদিও এ প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই যে, অনলাইন ক্লাস আসলে কতটা কার্যকর? অপেক্ষাকৃত বড় ক্লাসের এবং শহুরে শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসে অভ্যস্ত হলেও শিশু এবং গ্রামীণ এলাকার শিক্ষার্থী—যাদের অধিকাংশেরই ভালো ডিভাইস এবং তাতে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযুক্ত নেই, তাদের জন্য অনলাইন ক্লাস আসলে একটি পরিহাসের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের হার যে কম, তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বেশ কিছু বিভাগের অনলাইন জরিপের ফলাফলেও উঠে এসেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগের প্রায় ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন। কারণ হিসেবে তারা স্মার্টফোন না থাকা, গ্রামাঞ্চলের ধীরগতির ইন্টারনেট সেবা ও করোনার কারণে মানসিক দুশ্চিন্তা ও সাময়িক আর্থিক অসচ্ছলতার কথা উল্লেখ করেছেন (প্রথম আলো ৮ জুলাই ২০২০)। যদিও ১৭ জুন জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে শিক্ষামন্ত্রী জানান, সারা বছর অনলাইনে শ্রেণিপাঠ দেওয়ার জন্য একটি ডেডিকেটেড টিভি চ্যানেল চালুর চিন্তা-ভাবনা চলছে। এ সময় তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার পর সরাসরি উপস্থিতিতে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা হলো, যখনই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হোক, চলতি বছরের পাশাপাশি আগামী বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচিতে নেওয়া হবে। এজন্য দুই বছরের জন্যই আলাদা সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচিও প্রণয়ন করা হয়েছে। এরমধ্যে এ বছর সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে ৬০ দিন ক্লাস করিয়ে এসএসসি এবং ৮৪ দিন ক্লাস করিয়ে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া হবে। আর আগামী বছরের (২০২২) এসএসসি পরীক্ষার জন্য ১৫০ দিন এবং এইচএসসি পরীক্ষার জন্য ১৮০ কর্মদিবসের ক্লাসের হিসাব করে এ পাঠ্যসূচি করা হয়েছে। এছাড়া একটি অংশ অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমেও মূল্যায়ন করা হবে। তার মানে শর্টকাট পদ্ধতিতে পাস এবং পরবর্তী ক্লাসে উঠিয়ে দেওয়া হবে। এতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ভেতরেই যথেষ্ট ঘাটতি থেকে যাবে। যে শিশুটি নার্সারির পড়াই ঠিকমতো শেষ করতে পারেনি, তাকে করোনাকালীন বিশেষ সুবিধা দিয়ে পরবর্তী ক্লাসে, অর্থাৎ কেজিতে উঠিয়ে দেওয়ার মানেই হলো তাকে নার্সারির বোঝাও বইতে হবে। এই বাস্তবতা সবার ক্ষেত্রেই। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও যারা গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিতে না পেরে স্থবির হয়ে আছেন, তাদের জীবন থেকে মূল্যবান সময় চলে যাচ্ছে, তা কোনোভাবেই পোষানো যাবে না। বলা হয়, জীবন আগে না শিক্ষা? মূলত এই বিতর্কেই ঘুরপাক খাচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা না খোলার বিষয়টি।

প্রশ্ন হলো, আমাদের যাপিত জীবনের কোন জিনিসগুলো বন্ধ আছে? রাস্তাঘাট, বাজার, শপিং মল কোথাও কি মানুষের চলাচল বন্ধ আছে? আমার ছয় বছরের মেয়ের প্রতিদিনকার প্রশ্ন, বাবা তোমার অফিস খোলা? বলি হ্যাঁ। তার পাল্টা প্রশ্ন, তাহলে আমাদের স্কুল বন্ধ কেন? তাকে জবাব দিয়ে সন্তুষ্ট করা কঠিন। এই প্রশ্ন সব শিশুর মনে। যদিও এই শিশুদেরও জীবন থেমে নেই। তারা নানা বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছে। শপিং মলে যাচ্ছে। রাস্তায় হাঁটছে। কিন্তু বন্ধ শুধু স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা। যে কারণে জনমনেও এই প্রশ্ন প্রবল হচ্ছে যে, সবকিছুই যেখানে খোলা, সেখানে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে কী লাভ হচ্ছে? করোনা শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ছড়াবে? অনলাইনকে যে বিকল্প বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেটি যে খুব কার্যকর কোনও বিকল্প না, ভুক্তভোগীরাই তা ভালো জানে।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমার মেয়ে নার্সারিতে পড়তো। কিন্তু গত বছরের পুরে সময়টাই ক্লাস বন্ধ ছিল। অনলাইনে ক্লাস হয়েছে বটে। সেখানে সে আদৌ মনোযোগী ছিল না। বাসায়ও তাকে খুব একটা পড়ানো যায়নি। তার ওপর করোনার কারণে বাইরে যাওয়া সীমিত হয়ে পড়ায় সে মানসিকভাবেও খুব স্বাভাবিক ছিল না। এ রকম বাস্তবতার ভেতরেই তাকে কেজিতে ভর্তি করতে হয়েছে। প্রশ্ন হলো, আগের ক্লাসের সব পড়াই যেখানে সে শেষ করতে পারেনি, নতুন ক্লাসে গিয়ে কী শিখবে, কী পড়বে? এটা নিশ্চিত যে, সে নার্সারি ও কেজির সব পড়া শেষ না করেই ওয়ানে উঠে যাবে। অর্থাৎ তাকে ওয়ানে উঠিয়ে দেওয়া যাবে। এই ঘাটতি কি সে সারা জীবনেও পূরণ করতে পারবে?

আবার এও ঠিক যে, করোনা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসার আগে শিশুদের স্কুল খুলে দিলে যদি পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়, সে দায়ও কেউ নেবে না। ফলে একটা অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে। কিন্তু বিকল্প ভাবার সময় এসেছে। তবে সেই বিকল্প কোনোভাবেই অনলাইন ক্লাস নয়। অন্তত শিশুদের জন্য তো নয়ই। তাহলে কি ক্লাসরুমে শারীরিক দূরত্ব এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করা যায়? শিশুরা কি ক্লাসরুমে মাস্ক পরে থাকতে এবং কিছুক্ষণ পর পর হাত স্যানিটাইনজড করতে পারবে বা রাজি হবে? এসব প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার যেমন সুযোগ নেই, তেমনি করোনার কারণে বা অজুহাতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করে রাখারও যুক্তি নেই।

গত বছরের মার্চ থেকে শিক্ষক-কর্মচারীরা অনলাইনে কিছু ক্লাস বাদ দিলে মোটামুটি ছুটির আমেজেই রয়েছেন। সুতরাং এখন একটু বাড়তি কষ্ট যদি তারা করেন, তাহলে এই সোয়া এক বছরের ক্ষতি অনেকটাই পোষানো সম্ভব। যেমন, একসঙ্গে ক্লাসের সব শিক্ষার্থীকে হাজির না করে দুই বা তিনটি শিফটে, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে ক্লাস চালু করা যায়। এভাবে আগামী কয়েকটি মাস শিক্ষক-কর্মচারীরা একটু বেশি শ্রম ও সময় দিলে ক্লাস পরীক্ষা চালু করা যায়।

দ্বিতীয়ত, সব ক্লাসের নির্ধারিত ক্লাসের সংখ্যা কমিয়ে আনা যায়। ধরা যাক, কেজিতে যদি প্রতিদিন ৫টি ক্লাস থাকে, তাহলে সেটি দুই বা তিনটিতে নামিয়ে আনা যায়। এতে অন্তত শিশুদের কিছুটা উপকার হবে। তারা যেখানে বাসায় বসে মোটেও পড়ালেখা করতে চায় না, সেখানে সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন যদি দশটা ক্লাসও করে, তাতেও বড় কাজ হবে। কিন্তু চ্যালেঞ্জ হলো, শিশুদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি নিশ্চিত করা। আবার শিশুরা সংক্রমিত হয়ে অসুস্থ না হলেও তাদের মাধ্যমে বাসায় থাকা বয়স্ক মানুষেরা সংক্রমিত হবে কি না—তাও বলা যায় না। ফলে একটা চ্যালেঞ্জ রয়েই যাবে। ফলে এখনই শিশুদের স্কুল খুলে দেওয়া সম্ভব না হলেও বড়দের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা পুরোপুরি খুলে দেওয়া উচিত। আর শিশুদের স্কুলও অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখার কোনও মানে নেই। কোনও একটা বুদ্ধি বের করতেই হবে। কিন্তু সেই বুদ্ধি অনলাইননির্ভর শিক্ষা নয়। এখানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অভিভাবকরাই। আমার মেয়ে যে স্কুলে পড়ে, সেই স্কুলের অভিভাবকদের ফেসবুক গ্রুপে দেখছি স্কুল না খোলার পক্ষেই মতামত বেশি। সরকার হয়তো এটিও মাথায় রাখছে। গত ২৯ মে জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রয়াত আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরুর স্মরণসভায় অংশ নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীও বলেছেন, ‘আমার কাছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার থেকে বন্ধ থাকার মেসেজ বেশি আছে।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো, সবকিছুই যেখানে চলছে, শিশুদের জীবনও যেখানে স্বাভাবিক হয়ে আসছে, সেখানে করোনার ভয়ে আর কতদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে?

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ