X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আমার প্রিয়-অপ্রিয়

হাসান মুস্তাফিজ
২১ জুন ২০২১, ১১:৫০আপডেট : ২১ জুন ২০২১, ১৭:৩৮

নির্মলেন্দু গুণ বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের একটি জনপ্রিয় এবং বহুল পরিচিত নাম। গত কয়েক দশক ধরে ওনাকে চেনে না এমন কেউ নাই। এই যুগে এসেও কোনো আধুনিক ছেলে যখন তার রিলেশন ভাঙে, সে স্ট্যাস্টাস দেয়—আগামীকাল সকাল হবে ভালোবাসার, নাশতা করেই তোমাকে আমি দেখতে যাব।
এইসব ছেলেমেয়েদের কোনো দ্বায়িত্বশীলতা আছে কিনা কে জানে! এরা স্কুল লাইফে কবিতাকে অস্বীকার করে, অবশ্য এখন সৃজনশীল প্রশ্নের যুগে তারা কবিতাবিষয়ক প্রশ্নের ভালো জবাব দিয়ে ভালো মার্কস পায়। কিন্তু কলেজে উঠে তারা ক্রমাগত ব্যর্থতার মধ্যদিয়ে জীবনকে বুঝতে শিখতে শুরু করে, তখন তারা নির্মলেন্দু গুণের কবিতার কাছে ফিরে যায়। নির্মলেন্দু গুণ তখন তাদের অভিভাবক হয়ে ওঠেন।
কিন্তু জনপ্রিয়তা দিয়ে কথা। হ্যাঁ, উনি সেখানেও জনপ্রিয় যেটা আবুল হাসান হতে পারেননি।
আমি যখন ওনার ‘প্রেমের কবিতা’ বইটা কিনি আমি ততদিনে জীবনানন্দ দাশও পড়িনি। কিন্তু সত্যি বলতে বইটা আমার ভালো লেগেছিল। কিছু কিছু কবিতার লাইন ছিল আমেরিকার বিরুদ্ধে ভিয়েতনাম যেরকম যুদ্ধ করেছিল, সেইরকম অপ্রতিরোধ্য। ওনার সময় কবিতাটা আমার মনে পড়ে। সেকেন্ড প্যারায় ছিল—

তুমি দিয়েছিনু স্তনবন্ধন খুলে,
আমি দিয়েছিনু তাতে দুগ্ধ;
তোমার চকিত গোপন ঊর্ধ্বচাপে
শুক্তি আমার মুক্তির স্বাদে মুগ্ধ।

প্রচণ্ডভাবে আঘাত করেছিল লাইনগুলো। বলতে গেলে উনিই তখন হয়ে উঠলেন আমার দেখা লাগামহীন কবি। আমি ভাবতেই পারিনি এইভাবে কেউ কখনো লিখতে পারে।
পরে আমি যত সিনিয়র, জুনিয়র, সমবয়সী ছেলেদের এই কবিতার লাইনগুলি দেখিয়ে জানতে চেয়েছি কেমন লেগেছে, তারা অশ্লীল বলে নাকচ করে দিয়েছে। এমনকি, আমি মতিঝিলের যেই কলোনিতে থাকি, সেখানে আমার প্রিয় একজন বড়ভাই থাকতেন। কবিতা কিছু পড়তেন, পরে ধর্মের দিকে ঝুঁকে আর বই পড়েন না। যাকগে, তার ডাক্তার বাবা যখন এই বইটি শেলফে পায় এবং সময় কবিতাটা পড়েন, উনি এই বই ছুড়ে ফেলে দেন।
আর মেয়েদের ওপর এই বই কেমন প্রভাব ফেলেছিল সেটা অনেকটা ঠাট্টার দিকে চলে যায়। আমি কোনো কটু উদ্দেশ্য ছাড়া তাদেরকে ফেসবুকে এই কবিতা দিয়েছিলাম পড়তে। আমি ব্লক কম খাইনি।
এরা হচ্ছে হালের প্রজন্ম। অথচ এদের চোখেই কবি নির্মলেন্দু গুণ অশ্লীল। উনি স্তনবন্ধন খুলে দিতে চেয়েছেন। কী মহা অশ্লীল উনি।

যতদিন পার হয়েছে, সেই ‘প্রেমের কবিতা’ বইটায় আমি আর ওত আবেদন পাইনি। আমাকে টানেনি। বরং ওনার সমসাময়িক কবিদের প্রেমের কবিতার চেয়ে ওনার এসব কবিতা সবচেয়ে বেশি দুর্বল লেগেছে। তবে ওনার এসব কবিতার সবচেয়ে বড় বিষয় হলো এডপ্টেশন। বহু কবিতার লাইন উনি নিজের কবিতায় সামান্য টুইস্ট দিয়ে এনেছেন যেটা এলিয়েট করেছিল। আবার সেই সময়ে কবিতায় ইংরেজি লাইন ইউজ করা কম এক্সেপেরিমেন্টাল না।
তবে দুর্বল লাগলেও বইটিতে কিছু কবিতা ভালো লেগেছে। ‘দোল-পূর্ণিমার চাঁদ’ কবিতায় লিখেছেন—
তা হলে কি চাঁদ দেখিয়াছি দূরে, অস্ট্রেলিয়ায়?
সিডনি বা মেলবোর্নের আকাশে চ্যানেল নাইন-এর
নাকি তাকে কলকাতায়, বেহুলার আকাশে দেখেছি?
কোথায় দেখেছি এই চাঁদ? কোথায় দেখেছি তারে?

কবিতাটা খুবই উপযুক্ত। দেখিয়াছি শব্দটা গুরুত্ব দিতেই হবে। আমার দেখা যেসব কবি এভাবে এসব ক্রিয়াপদ ইউজ করে, তারা প্রাচ্যের আবির্ভাব আনার জন্য এরকম করেন বলে শুনেছি। কিন্তু নির্মলেন্দু গুণ সেই তকমা থেকে নিজেকে বের করে এনেছেন এভাবে। এসব প্রশংসার যোগ্য।
ওনার প্রথম তিন বইয়ের কালেকশন আমি যেদিন সংগ্রহ করি ততদিনে আমার বিনয় মজুমদার, শামসুর রাহমান, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ্, আবুল হাসান পড়া হয়ে গেছে। আবুল হাসান, শামসুর রাহমানের পাগলা ফ্যান বলতে গেলে। সেই টাইমে যখন ওনার কবিতার বই কিনলাম, আন্দাজ করাই যায় এসব কবিতা কোনো বিশেষ প্রভাব ফেলেনি আমার ওপর। তবে ‘হুলিয়া’ কবিতাটার কথা তো বলতেই হবে। আবার ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ বইটি থেকে জেমস জয়েসের নাম জানতে পারি।
কিন্তু ওনার কবিতার চিত্রকর্ম, কাটআপ ভাবনা আমাকে স্বীকার করতেই হবে। এতই ব্যর্থ উনি নন। ঐরকম এক দশকে উনি যখন কবিতার নাম দেন ‘ইথার নির্মিত পিয়ন’ বুঝতে হবে বিজ্ঞান নিয়ে ওনার আকাঙ্ক্ষা কতখানি। এখনও তথাকথিত নিরীক্ষাধর্মী কবিরা তাদের কবিতায় ইথার শব্দ ইউজ করে যেটা আমার বিন্দুমাত্র সহ্য হয় না। কিন্তু এই কবিতায় ইথার শব্দটা যথেষ্ট উপযুক্ত এবং প্রশংসার যোগ্য। আবার এই যুগের অতিরিক্ত নিরীক্ষাধর্মী কবিরা নিজেদের ম্যাজিক রিয়ালিজমের কবি বলে খুব গর্বিত হন এবং তারা নির্মলেন্দুর গুণের নাম নিয়ে সমালোচনা করে যে উনি এসব লিখেননি। তাদেরকেও বলব আপনারা ‘ইথার নির্মিত পিয়ন’ পড়ুন। আপনাদের এসব ম্যাজিক রিয়ালিজমের ভাবনা নিয়ে তখন লজ্জিত হবেন। আরে ভাই, উনি যখন এসব বই লিখেছেন, তখন Magic Realism Bloom-ই ঠিকমতো বাংলাদেশে আসেননি। উনি কী লিখবেন সেখানে। বাংলা সাহিত্যের সার্থকতা কোথায় থাকে তাহলে। আবার আপনার নিরীক্ষাধর্মী কবি, আপনারা তো ইংলিশ ছাড়া অন্য কোনো ভাষার false friend রূপ আনতে পারেননি। আরে অন্য ভাষা বেশি দায় হয়ে যায়, ইংলিশেরই কতখানি এনেছেন? আমি এমন কবিও চিনি যে গর্ব নিয়ে তারা ইংলিশ পড়তে পারে না, Hart Crane-এর নামই শুনেনি। আপনাদের এসব ম্যাজিক রিয়ালিজমে তথাকথিত কনসেপ্ট। একটাও লেখাও বিজ্ঞানধর্মী না, সোজা ভাষায় বলতে গেলে ‘প্রেমে ব্যর্থ, সুইসাইড করব’ এসব লিখেই আপনারা খ্যামা দেন। আপনারা নির্মলেন্দু গুণকে সমালোচনা করার কে?
এরপরে ইনসমনিয়া, কথাবলা কলাকৌশল কবিতা তো আছেই। ধরে ধরে এভাবে আলোচনার মানে হয় না। নিজ দায়িত্বে পড়ে নেবেন।

এখন আমার সততার পালা।
আমার দৃষ্টিতে নির্মলেন্দু গুণ জনপ্রিয় কবি। কিন্তু কালজয়ী নন। এখানে প্রথমেই বলতে হবে যে ওনাকে দশক ধরে এখন আর কেউ ওভাবে চেনে না। এখন দাবি করা যায় যে সময়ের ওপর ওনার প্রভাব এত বেশি যে ওনার ফ্যানরা সময়ে অস্বীকার করেছে।
এটা চাতুরি কথা। উনি কোন সময়ের সেটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
সময় ধরলে আবুল হাসানের তুলনায় উনি তেমন আহামরি কিছু না। ওনার ভাগ্য ভালো এদিক দিয়ে আসলে। অনেক ভালো ভালো কবি কম সময়ে মারা গেছেন।

এইবার আসি করোনা নিয়ে। গত বছর করোনার সময়ে উনি করোনার সাথে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা দিয়ে ফেসবুকে কবিতা লিখেছিলেন। পরেরদিনই সেটা প্রথম আলোর সাহিত্যপাতায় চলে আসে। পুরা কবিতাটা দিচ্ছি—

হে পাষাণ, হে দৈত্যাসুর, হে নিষ্ঠুর করোনা, আমি তোমার বিরুদ্ধে
একটি কবিতা লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
তোমার বিরুদ্ধে আজ ‘একটি মোক্ষম কবিতা লেখা হবে।’
ওই কবিতার ভেতরে, ছত্রে ছত্রে, শব্দে শব্দে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবে তোমার মরণবীজ।
এখনো আমি একটু দ্বিধার ভেতরে আছি।

কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মাথার ভেতরে।
তুমি কি প্রকৃতিসম্ভূত?

পড়েছ আকাশ থেকে?
নাকি চাপা পড়ে ছিলে
‘অনন্ত বরফবীথি’ তলে?

এখন বরফ গলেছে বলে,
মুক্তি-পাওয়া দৈত্যবৎ
তুমি ছড়িয়ে পড়েছ বিশ্বে?
হানা দিচ্ছ দেশে দেশে
মানুষের রক্তে, ফুসফুসে?

নাকি তুমি মনুষ্যসৃষ্ট?
দূরপাল্লার Virus Missile?
অভিশপ্ত উহানের লেভেল-ফোর
গবেষণাগারেই কি জন্ম তোমার?
তোমার জন্মের প্রয়োজনে
তুমি চীনকেই বেছে নিলে কেন?
কিছু মনে করিস না, তোর সংক্রমণে নিহত
লক্ষ লক্ষ মানব-মানবীর শবের ওপরে তোর ছন্দমুদ্রাহীন ভূতনৃত্য দেখে
অক্ষম ক্রোধে ও ঘৃণায় আমি নেমে আসছি ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’য়ে।
এই পৃথিবীতে এসে তুই যা করেছিস—
তুই তো অবশ্যই জাহান্নামে যাবি, করোনা,
তোর জন্য অপেক্ষা করছে রৌরব নরক,
The Hell is waiting for you.
মানুষের অন্তহীন ঘৃণা ও বীভৎস ভর্ৎসনাই জুটবে তোর ভাগ্যে চিরদিন, চিরকাল।
হে ঘৃণ্য, অদৃশ্য ঘাতক, হে মহাপাতক;
তোর রক্ষা নেই, তোর ফাঁসি তো হবেই।
মনুষ্য-আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনে আমি জানি অবশ্যই, অচিরেই অক্কা পাবি তুই।
আমার কথা শোন, ফাঁসির মঞ্চে যাবার আগে তুই পৃথিবীকে বলে দিয়ে যা—
Who made you?
Who are the masterminds?
তুই কোন ইতরের তৈরি?

নির্মলেন্দু গুণ এখন যতটা না কবিতার জন্য জনপ্রিয় তারচেয়ে বেশি জনপ্রিয় তার কীর্তির জন্য। পুরোদমে পাবলিসিস্ট হয়ে গেছেন তিনি। পুরস্কার ওনাকে দিতেই হবে।
আফসোসের ব্যাপার, আমার প্রজন্ম ওনার মুখে দাড়ি আছে কিনা সেটা না জানলেও এইসব ভালোমতো জানে। নির্মলেন্দু গুণের কবিতার প্রভাব এখন এত নিম্ন পর্যায়ের। বাংলাদেশে বর্তমানে দুই ধরনের পাঠক আছে। সিরিয়াস পাঠক আর বিনোদনের পাঠক। দ্বিতীয়টাই বেশি, ফলে নির্মলেন্দু গুণ জনপ্রিয়। কিন্তু সেইদিন আসতে বাকি নেই যখন মানুষ পুরোপুরি কোট-আনকোট করে বলবে, প্যারাফ্রেজ করেও বলবে না, যে—নির্মলেন্দু গুণ ভালো কবি ছিলেন না।

এখন আমার একটা ব্যক্তিগত মতামত দেই। আমরা অতি সম্প্রতি শঙ্খ ঘোষকে হারিয়েছি। আমাদের জন্য এটা মেনে নেওয়া কঠিন। কিন্তু এখানেও নির্মলেন্দু গুণ সস্তামি ছাড়েননি। কে যেন তার এক লেখায় লিখেছিল শঙ্খ ঘোষ বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি। ব্যস, গুণ সাহেব যান কই। আশ্চর্যের বিষয়, বর্তমানের ভিন্নধারার লেখা ওনার কাছে বা ওনার কবিতা লাইব্রেরিতে যায় না, কিন্তু পপুলারিটির সবকিছু তার কাছে পৌঁছায়।
নিজেকে প্রধান কবি প্রতিষ্ঠা করার জন্য ওনার যুক্তি হলো, শঙ্খ ঘোষের চেয়ে তার কবিতা বেশি।
এখানকার যুগে কিছু নির্লজ্জ প্রকাশনীর ইতর কবিরা চার্লস বুকওস্কি, লিওনার্দো কোহেনের কবিতা অনুবাদ করছে। তাদের অনুবাদ এমন—

আর ভিতর বাস করে এক ব্লুবার্ড
আই তারে কই তুই ঐখানেই থাক
আই তোরে বের হইবার দিমু না

এইসব লোকজন এখন লিওনার্দো কোহেনের কবিতা অনুবাদ করছে।
গুণ সাহেবের কোনো কথা নেই। উনি চান সবাই বলুক তিনি বাংলাদেশের বর্তমানের প্রধান কবি। অথচ ওনার কোনো স্ট্যান্স নেই কোনো বিষয়ে। আর যুগের সাথে তাল মিলিয়ে তিনি যে নিজেকে যাচাই করার ক্ষেত্রে সর্বদা ব্যর্থ সেটা সবাই জানে।

কবি নির্মলেন্দু গুণের জন্মদিন সামনে, কবিকে শুভেচ্ছা জানাই।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চারতলা ভবনের ছাদ থেকে পড়ে মাদ্রাসাছাত্রীর মৃত্যু
চারতলা ভবনের ছাদ থেকে পড়ে মাদ্রাসাছাত্রীর মৃত্যু
বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে থাইল্যান্ডের বিনিয়োগ চান প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে থাইল্যান্ডের বিনিয়োগ চান প্রধানমন্ত্রী
এবার ঘুমটা ভালো হবে ডু প্লেসির
এবার ঘুমটা ভালো হবে ডু প্লেসির
সৎ মাকে বটি দিয়ে কোপালো কিশোর, ঢামেকে মৃত্যু
সৎ মাকে বটি দিয়ে কোপালো কিশোর, ঢামেকে মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী