দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের করোনা ভাইরাস রোধক টিকা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলেও কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা কবে টিকা পাবেন, এ নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। আর টিকা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ায় কবে থেকে ক্লাস শুরু হবে, তাও জানতে পারছেন না মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। কোনও কোনও শীর্ষ পর্যায়ের দায়িত্বশীল আলেমরা টিকা গ্রহণ করলেও শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত, তা এখনও ঠিক করতে পারেননি তারা।
কওমি মাদ্রাসার কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষক ও একাধিক মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে সমন্বিত কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রে বেফাক ও অন্যান্য আঞ্চলিক বোর্ডগুলোসহ কওমি মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সরকারি বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান ‘আল-হাইআতুল উলয়া লি-জামিআতিল কওমিয়্যাহ’ও এ বিষয়ে কোনও আলোচনা শুরু করেনি।
ঢাকার জামিয়া ইসলামিয়া মাখজানুল উলুম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও হেফাজতের মহাসচিব মাওলানা নুরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাদ্রাসার ছাত্ররা টিকা নেবে কিনা, সেটা মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষ ও আল হাইআতুল উলয়া ঠিক করবে। ভ্যাকসিন কী জিনিস, আমি বুঝি না। এ বিষয়ে আমার কোনও অভিজ্ঞতা নেই।’
ঢাকার একটি মাদ্রাসার মেশকাত জামাতের (স্নাতক চূড়ান্ত) একজন শিক্ষার্থী রবিবার বিকালে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে টিকা নেওয়ার ব্যাপারে কোনও কিছুই জানানো হয়নি। আর মাদ্রাসাও কবে নাগাদ খোলা হবে, তা অনিশ্চিত।
সরকারিভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ পর্যায়ে টিকা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রক্রিয়া শুরু করেছে। টিকা কার্যক্রম গুছিয়ে এনেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও। এরইমধ্যে টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বয়স ১৮ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়া শেষ হলেই প্রতিষ্ঠান খুলবে, সরকারের পক্ষ থেকে এমন সম্ভাবনার কথা জানানো হয়েছে।
কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাক) একাধিক দায়িত্বশীল আলেম জানান, মাদ্রাসার ছাত্রদের টিকা দেওয়ার বিষয়ে কোনও রোডম্যাপ হয়নি। ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষার্থীদের স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করে টিকা দেওয়ার বিষয়ে উৎসাহ দেওয়া হলেও প্রাতিষ্ঠানিক কোনও নির্দেশনা নেই।
ঢাকার একটি মাদ্রাসার শিক্ষক বলেন, টিকা নেওয়ার বিষয়ে শুরুতে বিভ্রান্তি থাকলেও এখন টিকা নেওয়ার পক্ষে সবাই। সুস্থ থাকতে টিকার বিকল্প নেই, এ কথাটিও ছাত্রদের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে বিভিন্ন উপায়ে। যদিও মাদ্রাসা বন্ধ থাকায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী টিকার ব্যাপারে অন্ধকারে আছে।
জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম নতুনবাগ, রামপুরা মাদ্রাসার হাদিসের শিক্ষক মাওলানা ইমরানুল বারী সিরাজী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের বেফাক বা হাইআ বা কোনও বোর্ড থেকেই কিছু জানানো হয়নি। কোনও ঘোষণাও আসেনি টিকার বিষয়ে। এখনও মাদ্রাসা বন্ধ থাকায় বোর্ডই ঠিক করবে করণীয়।’
ইমরানুল বারী জানান, মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা টিকাগ্রহণে ইতিবাচক। তবে, কী প্রক্রিয়ায় টিকা দেওয়া হবে সেজন্য অপেক্ষা করছে সবাই।
জানতে চাইলে বেফাক ও আল-হাইআতুল উলয়া লি-জামিআতিল কওমিয়্যাহ’র সদস্য মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন রাজু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা, শিক্ষকরা কীভাবে টিকা পাবেন, এ নিয়ে বোর্ডগুলো এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। হাইআতুল উলয়ার দায়িত্বশীলরা এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছেন। তবে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।’
আল হাইআতুল উলয়া’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ও জাতীয় দ্বীনী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সহসভাপতি মাওলানা ইয়াহইয়া মাহমূদ বলেন, ‘টিকার বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে আমরা একটা গাইডলাইন করছি, চেষ্টা করছি। আমরা নিজেরা পরামর্শ করে গাইডলাইন তৈরি করেছি।’
সরকারের কাছে কোনও প্রস্তাব দেওয়া হবে কিনা, এমন প্রশ্নে ইয়াহইয়া মাহমূদ বলেন, ‘এটা হাইয়ার মুরুব্বিরা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবেন। আমরা আমাদের মতো চেষ্টা করছি।’
টিকা নিয়েছেন হাইআতুল উলয়ার চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান
সাধারণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত না হলেও কওমি মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সরকারি বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান ‘আল-হাইআতুল উলয়া লি-জামিআতিল কওমিয়্যাহ’ চেয়ারম্যান মাওলানা মাহমুদুল হাসান টিকা নিয়েছেন। আল-হাইআতুল উলয়া’র একজন কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে এ কথা জানান।
এই কর্মকর্তা আরও জানান, সিনিয়র আলেমদের মধ্যে অনেকেই নিবন্ধন করেছেন। তারা নিজ উদ্যোগে টিকা নিচ্ছেন।
মাদ্রাসা খুলবে কবে?
কওমি মাদ্রাসা কবে নাগাদ ক্লাস শুরু করতে পারবে, এ নিয়ে এখনও অন্ধকারে বোর্ড ও দায়িত্বশীল আলেমরা। শিক্ষার্থীরাও বলছেন, তারা মাদ্রাসা খোলা বা ক্লাস শুরু হওয়া নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত জানতে পারছেন না।
সিলেটের একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন রাজু বলেন, ‘মুরুব্বিরা চেষ্টা করছেন আগে মক্তব বিভাগ ও হেফজ বিভাগ (কোরআন শিক্ষা কার্যক্রম) চালু করতে। এরপর সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে অন্য ক্লাসগুলো শুরু হবে।’
দায়িত্বশীল একাধিক আলেম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নয়, বরং সরকারের ক্ষোভের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে।
তারা জানান, হেফাজত ইস্যুতে সরকার মাদ্রাসাগুলোকে বন্ধ রেখেছে। কওমি মাদ্রাসার সংশ্লিষ্ট হেফাজত নেতাদের মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনবিরোধী অবস্থানের কারণে মাদ্রাসার প্রতি বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছে সরকারের। আর এই ক্ষোভ উপশমে চেষ্টা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন কোনও কোনও আলেম। এই অংশের অনেকেই মনে করেন, মাদ্রাসার ছাত্র- শিক্ষকদের বর্তমান পরিস্থিতিতে ভ্যাকসিন দেওয়া প্রয়োজন।
মাওলানা ইয়াহইয়া মাহমূদ বলেন, ‘ক্ষোভটা তো সকলেরই জানা। করোনা ভাইরাসজনিত ও লকডাউন পরিস্থিতিতে কওমি মাদ্রাসা বন্ধ ছিল। কিন্তু এবার প্রজ্ঞাপন দিয়ে কওমি মাদ্রাসা বন্ধ করা হয়েছে। কেন বন্ধ হলো, সেটা সকলের জানা। কওমি মাদ্রাসাগুলোকে সরাসরি প্রজ্ঞাপন দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে বিশেষ কারণে। কারণ আর উল্লেখ করার দরকার নাই। এই ক্ষোভ আমরা চাচ্ছি প্রশমন করতে। সরকারকে আস্থায় নিয়ে মাদ্রাসা খোলা দরকার।’
জানতে চাইলে হেফাজতের মহাসচিব ও ঢাকার একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘ এখনও তো লকডাউন চলছে। এই মুহূর্তে মাদ্রাসা খোলা সম্ভব না। লকডাউন শেষ হলে পরিস্থিতি বুঝে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
আরও পড়ুন: