X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হেপাটাইটিস: অপেক্ষার সময় নেই

ডা. এ এইচ এম রওশন
২৮ জুলাই ২০২১, ১৩:৫৭আপডেট : ২৮ জুলাই ২০২১, ১৩:৫৭

ডা. এ এইচ এম রওশন ‘হেপাটাইটিস চিকিৎসায় আর বিলম্ব নয়। করোনার সন্ধিক্ষণেও প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একজন করে মানুষ হেপাটাইটিস জটিলতায় মারা যাচ্ছেন।’ হেপাটাইটিস বা লিভারের-ইনফেকশন অনেক কারণেই হয়ে থাকে। স্বল্পকালীন হেপাটাইটিস (যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হেপাটাইটিস-এ, হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, হেপাটাইটিস-ডি, বা হেপাটাইটিস-ই দিয়ে হয়) সাধারণত কয়েক সপ্তাহ বা মাসের মধ্যেই ভালো হয়ে যায় কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদী বা ক্রনিক হেপাটাইটিস (যা সাধারণত হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি দিয়ে হয়) থেকে লিভারের সিরোসিস ও ক্যানসার নামক দুটি মারাত্মক অবস্থায় হতে পারে।

ক্রনিক হেপাটাইটিস এই দুটি ভাইরাস ছাড়াও ফ্যাটি লিভার, উইলসনস-ডিজিজ সহ আরও কিছু কারণে হতে পারে। সিরোসিস, লিভারের ক্রনিক হেপাটাইটিসের অপরিবর্তনীয় চূড়ান্ত অবস্থা। সারা পৃথিবীতে ২০১০ সালে ১০ লাখের বেশি মানুষ লিভার সিরোসিসে মৃত্যুবরণ করছে যা সময়ের সাথে বাড়ছে। অন্যদিকে লিভারের ক্যানসার সাধারণত সিরোসিসের পরে হয়, তবে সরাসরি হেপাটাইটিস থেকেও হতে পারে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীর সকল মৃত্যুর মধ্যে কারণ হিসেবে লিভার ক্যানসারের অবস্থান তৃতীয়। ২০১৭ সালে সারা পৃথিবীতে ৯,৫০,০০০ নতুন মানুষ লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে এবং একই সময়ে ৮০০,০০০ মানুষ এই রোগে মারা গেছে যা ক্রমাগত বাড়ছে এবং এই সংখ্যা ১৯৯০ সাল থেকে দ্বিগুণ হয়েছে। লিভারের এই রোগসমূহের প্রধানতম কারণ হলো হেপাটাইটিস-‘বি’, বা ‘সি’ ভাইরাস সংক্রমিত হেপাটাইটিস।

বাংলাদেশেও এই রোগ এবং সংক্রমণ কম নয়। ২০১৮ সালের ওয়ার্ল্ড হেলথ প্রোফাইল অনুযায়ী বাংলাদেশে লিভার রোগে মৃত্যু বরণ করেছে মোট ২৩,১৪৫ জন যা মোট মৃত্যুর শতকরা ২.৯৮ ভাগ। অন্য গবেষণায় দেখা গেছে, এ দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে ৫.৪% এর শরীরে হেপাটাইটিস-‘বি’ এবং ০.২-১% এর শরীরে হেপাটাইটিস-‘সি’ ভাইরাস আছে। এ দেশে হেপাটাইটিস-‘বি’, লিভারের সিরোসিস ও ক্যানসার রোগের প্রধান কারণ (যথাক্রমে ৬০% ও ৬৫%)। হেপাটাইটিস-‘সি’ ও বাংলাদেশ লিভার সিরোসিস (৩০%) ও লিভার ক্যানসারের (১৭%) অন্যতম কারণ।

এ ভাইরাস দুটি সাধারণত ভাইরাস বহনকারী বা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত, রক্তরস অথবা অন্য যে কোনও ধরনের শারীরিক রসের মাধ্যমে একজনের শরীর থেকে অন্যজনে ছড়ায়। এছাড়া অপারেশনে ব্যবহৃত সকল প্রকার যন্ত্রপাতি, ইনজেকশনের সিরিঞ্জ, যৌন মিলনে, বিশেষ করে সমকামিতায় এবং একই ক্ষুর বা ব্লেড ব্যবহার করা, সেলুনের মাধ্যমেও এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। গর্ভবতী মায়ের শরীরে হেপাটাইটিস-‘বি’ ভাইরাস থাকলে প্রসবকালীন সময়ে সন্তানের শরীরে সংক্রমণ হতে পারে।

নিরাময় ও চিকিৎসা: স্বল্পকালীন হেপাটাইটিস সাধারণত লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসায় ভালো হয়ে যায়। তবে, হেপাটাইটিস ‘এ’- এর কার্যকরী টিকা আছে যার দুটি ডোজ দিয়ে ২০ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদী হেপাটাইটিস প্রতিরোধ করতে রক্ত বা রক্তের যে কোনও উপাদান সংবহনের পূর্বে তাতে ভাইরাস আছে কিনা পরীক্ষা করে নিতে হবে। সব রকমের অপারেশন সহ রোগ নির্ণায়ক ও চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত সকল যন্ত্রপাতি ব্যবহারের আগে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। ইঞ্জেকশনের জন্য একবার ব্যবহার করা হয় এমন সিরিঞ্জ ব্যবহার করতে হবে এবং নিরাপদ যৌন আচরণ করতে এবং অবশ্যই সমকামিতা পরিহার করতে হবে এবং যতটা সম্ভব অনিরাপদ সেলুন ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। এসব ব্যবস্থা অবলম্বন করে হেপাটাইটিস ভাইরাসের সংক্রমণ কমানো সম্ভব।

যেহেতু দুটি ভাইরাসই সংক্রমিত হওয়ার পর লিভারের অপরিবর্তনীয় অবস্থা তথা লিভার সিরোসিস বা ক্যানসার হতে অনেক সময় লাগে, তাই কোনোরকম লক্ষণ না থাকলেও যে কেউ শরীরে হেপাটাইটিস-বি এর উপস্থিতি অগ্রিম পরীক্ষা করে শনাক্ত হলে চিকিৎসা নিয়ে ভাইরাসের মারাত্মক পরিণতি থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতে পারে। অপর দিকে হেপাটাইটিস-সি পাওয়া গেলে অবশ্যই চিকিৎসা নিতে হবে। কারণ, হেপাটাইটিস-সি নিরাময়ে বর্তমানে ব্যবহৃত ওষুধ শতকরা ৯৫ থেকে ৯৯ ভাগ কার্যকরী।

হেপাটাইটিস-বি প্রতিরোধে কার্যকরী টিকা আছে, যার তিনটি ডোজ সঠিক ভাবে নিয়ে এই ভাইরাস সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। এই টিকা জন্মের সময় থেকে যে কোনও বয়সেই নেওয়া যায়। তবে নেওয়ার আগে নিশ্চিত হতে হবে যে শরীরে কখনও হেপাটাইটিস-বি সংক্রমিত হয় নাই।

এমনিভাবে যে কোনও ব্যক্তি শারীরিক কোনও লক্ষণ না থাকলেও রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এই ভাইরাস দুটির উপস্থিতি জেনে চিকিৎসা অথবা টিকা নিয়ে এই ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট হেপাটাইটিস রোগ এবং তা থেকে উৎপন্ন লিভারের সিরোসিস বা ক্যানসার হওয়া থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে।

আর সন্তান জন্মের সময়ে এই ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিহত করতে প্রত্যেক গর্ভবতী মহিলার রক্তে এই ভাইরাস আছে কিনা পরীক্ষা করতে হবে। হেপাটাইটিস পাওয়া গেলে অবস্থা বিশেষে চিকিৎসা দিয়ে এবং না পাওয়া গেলে অন্তস্বত্তা মহিলাকে নির্ধারিত সময়ে দুটি টিকা দিয়ে এই ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা কমানো যায়। মনে রাখতে হবে, এসব ক্ষেত্রে প্রসবকালীন সময়ে সাধারণ জীবাণুমুক্তকরণ ছাড়াও কিছু অতিরিক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে যেন মায়ের রক্ত বাচ্চার শরীরে না যায়। আর মা হেপাটাইটিস-বি পজেটিভ হলে জন্মের সময়েই নবজাতককে হেপাটাইটিস-বি টিকার প্রথম ডোজ এবং একই দিনে অন্য হাত বা পায়ের মাংস পেশীতে হেপাটাইটিস-বি এর অ্যান্টিবডি ইনজেকশন দিয়ে প্রসবকালীন সংক্রমণ কমানো যায়।

তাই আসুন ২০২১ সালের ‘বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসে’ আমরা রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে হেপাটাইটিস-‘বি’ এবং ‘সি’, এর অবস্থা জানি।

হেপাটাইটিস-‘বি’ না থাকলে টিকা নেই। হেপাটাইটিস-‘বি’ বা ‘সি’, যে কোনোটি পাওয়া গেলে যথাযথ চিকিৎসা নেই। ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করি। গর্ভবতী মায়ের হেপাটাইটিস পরীক্ষা করি এবং সংক্রমণ প্রতিহত করণের সব ব্যবস্থা নেই। সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে হেপাটাইটিস নিরাময়ে সম্পৃক্ত করি।

লেখক: অধ্যাপক, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল হেপাটোবিলিয়ারি অ্যান্ড প্যানক্রিয়াটিক ডিসঅর্ডারস (জিএইচপিডি) বিভাগ, বারডেম, ঢাকা।

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ