X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কুল্লাপাথরে শায়িতদের জাতীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা হোক

মোস্তফা হোসেইন
০২ আগস্ট ২০২১, ১৭:৫৬আপডেট : ০২ আগস্ট ২০২১, ১৭:৫৬

মোস্তফা হোসেইন যুদ্ধশেষের যুদ্ধে জড়িয়ে আছেন অনেক মুক্তিযোদ্ধা। তাদের যুদ্ধটা মূলত মহান এই লড়াইয়ের বীরত্বকে প্রজন্মান্তরে তুলে ধরা এবং বীরদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। তেমনি এক যোদ্ধা ছিলেন আব্দুল করিম। সীমান্তবর্তী কসবা উপজেলার কুল্লাপাথরে পিতার দেওয়া একটি টিলার ওপর শায়িত ৫২ শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে আগলে রেখেছিলেন অর্ধশতাব্দীকাল। বাঁশের খুঁটি দিয়ে চিহ্নিত করা কবরগুলো ধীরে ধীরে পাকা হলো। কবরস্থান সীমানা দেয়ালে ঘেরা হলো। হলো আরও কিছু স্থাপনা। কিন্তু একটা অতৃপ্তিবোধ ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিমের মনে। শুধু বলতেন, কী করলে এই বীরদের প্রতি যথাযথ সম্মান জানানো হবে। মাঝে মাঝেই ফোন দিতেন। প্রস্তাব করতেন এবং প্রস্তাব চাইতেন। কী করা যায় সেখানে। মাস দুয়েক আগেও ফোন করে বললেন, আরও কিছু করা দরকার।  

জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী করতে চান করিম ভাই?

বললেন, বাংলাদেশের বৃহত্তম মুক্তিযোদ্ধা কবরস্থান এখানে। এটাকে কেন্দ্র করে এখানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর হোক। বললেন, আমাদের এই অঞ্চলে অনেক মুক্তিযোদ্ধার কবর কাছে, অনেক যুদ্ধস্মারক অযত্নে পড়ে আছে। সেগুলো যদি বৈজ্ঞানিক উপায়ে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করা যেতো তাহলে অনেক যুদ্ধস্মারক ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা পেতো। জাদুঘর প্রতিষ্ঠার জন্য অবকাঠামোগত ব্যয় খুব বেশি হবে না। বর্তমান গেস্ট হাউজকে বর্ধিত করে সেটা করা সম্ভব। আমারও মনে হয়েছিল, ঠিকই তো। এখানে গবেষণা কেন্দ্র হতে পারে একটা। প্রয়োজনে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তত্ত্বাবধান করতে পারে।

বলেছিলেন করিম ভাই, করোনা পরিস্থিতি একটু ভালো হলে তিনি ঢাকা আসবেন। আমি যেন তাকে সহযোগিতা করি। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হলো। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী এই বীরও পরাজিত হলেন করোনার কাছে। ২২/২৩ জুলাই করিম ভাই’র ছেলে মাহবুব করিম ফোন করে জানালো ওর বাবাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ২৭ তারিখ বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল জামিল ডি আহসান বীর প্রতীক বললেন, করিম সাহেবের অবস্থা ভালো না। তাকে ডিএনসিসি হাসপাতালে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে। মধ্যরাতে খবর পেলাম তিনি পরপারে চলে গেছেন।

তার মৃত্যু সংবাদটা কাঁটার মতো বিঁধলো মনে। একই হাসপাতালে মাত্র ৪ দিন আগে আমার মেঝ ভাইও চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।

তাঁর মৃত্যুতে দেশব্যাপী কোনও নাড়া পড়েনি। প্রতিষ্ঠিত ও সমাজের উঁচুস্তরের মানুষের মৃত্যুর পর যেমন শোকবার্তা কিংবা সংবাদ হয়, তেমনও হয়নি। কিন্তু যখন তাঁর ও তাঁর বাবা আব্দুল মান্নানের অবদানের কথা মনে হয়, তখন ভাবি- এসব মানুষকে মূল্যায়ন আমরা করতে পারিনি, করার কোনও সংস্কৃতিও নেই। সেই অপারগতা যে জাতি হিসেবে আমাদের দায়বদ্ধ করে বলতে দ্বিধা হওয়ার কথা নয়। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে অরক্ষিত আছে অসংখ্য গণকবর। কত ভয়াবহ যুদ্ধস্মৃতি হারিয়ে যাচ্ছে সংরক্ষণের অভাবে। আর আব্দুল মান্নান আর তার ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিমের ঐকান্তিক চেষ্টায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কবরস্থান সংরক্ষণ হয়ে আসছিল এতদিন। এর কি মূল্যায়ন হয়েছে?  

কিছুটা বোঝা যাবে কুল্লাপাথরে মুক্তিযোদ্ধা কবরস্থানের ইতিহাসের দিকে তাকালে।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধ প্রস্তুতি এবং যুদ্ধ সংগঠিত করার পাশাপাশি কিছু অতি প্রয়োজনীয় বিষয়ের দিকে নজর দিতে হয় মুক্তিযুদ্ধের পরিচালকদের। কুল্লাপাথর ছিল সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের এলাকা।  ওই শহীদদের ভারতীয় এলাকায় দাফন করা হচ্ছে। এটা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। কিন্তু নিরাপদ জায়গাও পাওয়া যাচ্ছিল না। সেই সুবাদে ক্যাপ্টেন এটিএম হায়দার কথা বলেন আব্দুল করিমের বাবা আব্দুল মান্নানের সঙ্গে। তারপর মান্নান সাহেব খালেদ মোশাররফের সঙ্গেও কথা বলেন। আর সেই কাজটিকে দ্রুততর করে এক মহান শহীদের শেষ চাওয়া পূরণ করতে গিয়ে। তিনি বীর শহীদ প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম। যুদ্ধে গুরুতর  আহত হওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, তাঁর মৃত্যু হলে যেন বাংলাদেশের মাটিতে দাফন করা হয়। সেই কাজটিই করা হলো একাত্তরে। কবরস্থানের জায়গা হিসেবে খালেদ মোশাররফ কুল্লাপাথরের তিনটি পাহাড়ের পশ্চিমের অংশকে পছন্দ করেন। জায়গাটা নোম্যান্স ল্যান্ড-সংলগ্ন হওয়ার পরও নিরঙ্কুশ নিরাপদ ছিল এমনটা নয়। তবে তুলনামূলক নিরাপদ তো অবশ্যই। কুল্লাপাথর থেকে মাত্র দেড় দুই কিলোমিটার পশ্চিমে সালদানদী রেলস্টেশন। ওখানে পাকিস্তানিদের শক্তিশালী ঘাঁটি। ওখান থেকে পাকিস্তানিরা মুক্তিবাহিনীকে লক্ষ্য করে সারাক্ষণ মর্টার নিক্ষেপ করে, পূর্বদিকে ভারতীয় সীমান্ত লক্ষ্য করে। আবার মুক্তিবাহিনী পাল্টা গুলি করে ভারতীয় সীমান্ত থেকে। মাঝখানেই বলা যায় কুল্লাপাথরের করিম সাহেবদের বাড়িটিকে। তারপরও বাংলাদেশ এলাকায় এর চেয়ে ভালো জায়গা খুঁজে পাননি খালেদ মোশাররফ। সেখানেই শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের দাফন শুরু হয়।

এই গুরুদায়িত্বটি গ্রহণ করেন আব্দুল মান্নান। সঙ্গী হিসেবে পান গ্রামের দুয়েকজনকে। প্রত্যেক শহীদকে ইসলামি বিধান অনুযায়ী দাফন করা হয় সেখানে। দুয়েকজনের দাফনকালে আব্দুল করিমও সহযোগিতা করেন বাবাকে। কিন্তু নিজে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কারণে যুদ্ধকালে সেখানে থাকতে পারেননি তিনি।

বিজয়ের পর একসময় আব্দুল করিম স্থানীয় একটি হাইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত হলেন। ওই সময় ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে চাকরি নিয়ে চলে যাওয়ার চিন্তা করতে পারেননি তিনি অনেকটা এই কবরস্থানের কারণেও। এক ধরনের আকর্ষণ তাকে পেয়ে বসে। এরমধ্যে তাঁর বাবা আব্দুল মান্নান ইন্তেকাল করেন। সেই থেকে পুরো কবরস্থানের দেখভালের দায়িত্ব পড়ে আব্দুল করিমের ওপর। তিনি ভাবতে থাকেন এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কবরগুলোর সৌধ নির্মাণ করা জাতি হিসেবে আমাদের দায়িত্বভুক্ত। দৌড়াদৌড়ি করতে থাকেন বিভিন্ন বিভাগ ও দফতরে। সবশেষে সরকারি সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত হয়। পাহাড়ের ওপর কবরগুলোকে পাকা করা হয়। পাহাড়ে ওঠার জন্য সিঁড়ি তৈরি হয় পাকা। কবরস্থানের উত্তর-পশ্চিম কোণে বেদি তৈরি হয়, যেখানে এপিটাফ কিংবা ম্যুরাল তৈরির সুযোগ রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশের বৃহত্তম মুক্তিযোদ্ধা কবরস্থানকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য স্থির করে সরকার একসময় সালদানদী থেকে কুল্লাপাথর পর্যন্ত রাস্তা পাকা করে। যদিও অনেকেই মনে করছেন, এই রাস্তার কাজটি গতিশীল করে দিয়েছে সেখানকার গ্যাসফিল্ড। উন্নয়নমূলক কাজ হিসেবে সেখানে তৈরি হয়েছে মসজিদ, গেস্টহাউজ ও পাকাঘাট।

তিনটি পাহাড়ের একটিতে বাস আব্দুল করিমের পরিবারের। মাঝখানে ছোট এক চিলতে সমতলভূমি। ওখানে গাছ লাগিয়ে সৌন্দর্যবৃদ্ধি করা হয়েছে।

দুর্ভাগ্যজনক সংবাদ পাওয়া গেছে সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিষয়ে। সীমান্তঘেঁষা এলাকা হওয়ায় সেখানে অহিতকর নানাকাজ হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যা বন্ধে স্থানীয় প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে শহীদদের কবরস্থানের পবিত্রতা নষ্ট হয় এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিমের মৃত্যুর পর বারবার মনে হচ্ছে– এভাবে প্রতিটি শহীদকে সহোদর ভাববেন কি অন্য কেউ? কবরস্থানকে পরিত্যক্ত না ভেবে এখান থেকে আমাদের আগামী প্রজন্মকে দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ করতে এগিয়ে আসবে কি কেউ?

জাতীয় বীরদের স্থায়ী ঠিকানা জাতীয়ভাবেই সংরক্ষণ হওয়ার কথা। যতটা জেনেছি, এই কবরস্থানের দায়িত্ব পালন করছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিষদ। এ নিয়ে আব্দুল করিমেরও বক্তব্য ছিল। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় কিংবা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এর দায়িত্ব নেওয়া উচিত। আর অত্যন্ত মনোরম পরিবেশের কুল্লাপাথরে গবেষণা কেন্দ্র এবং সরকারিভাবে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠাও প্রয়োজন বলে মনে করি। সবশেষে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিমের যুদ্ধশেষের যুদ্ধ যেন সফল হয়, সেটাই কামনা করছি।

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ