X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মাস্ক, করোনা পরীক্ষা ও টিকা

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
০৪ আগস্ট ২০২১, ১৬:০৯আপডেট : ০৪ আগস্ট ২০২১, ১৬:১৪
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সরকারি ভাষায় বিধিনিষেধ, মিডিয়ার ভাষায় ‘লকডাউন কাল থেকে আবার বাড়ছে’। বাংলা ছোটগল্প সম্পর্কে বলা হয়, এমন কাহিনি যেন পাঠকের মনে হবে গল্পটা শেষ হয়েও হলো না। আমাদের এবারের লকডাউনটিকে বলা যায় শেষের আগেই শেষ হয়ে গেলো।

নিজের ভাষায় যা ছিল ‘কঠোর’ তাকে কোমল নয় শুধু, যেন হঠাৎ করে ভেঙে ফেললো সরকার নিজেই পোশাক কারখানার মালিকদের দাবি মেনে নিয়ে। একদিন আগেও কর্তাব্যক্তিরা বলেছেন, কোনোভাবেই ৫ আগস্টের আগে লকডাউন শিথিল হবে না, কোনও কারখানা খুলবে না। কিন্তু তারাই আবার ৩০ জুলাই বলে দিলো ১ আগস্ট থেকে কারখানা খোলা থাকবে। যা হওয়ার তাই হলো। লক্ষ লক্ষ মানুষ যার যার বাড়ি থেকে ছুটলো কারখানার দিকে। রাস্তায়, লঞ্চঘাটে, ফেরিঘাটে শুধু মানুষ আর মানুষ।

করোনা থেকে বাঁচতে প্রথম কথা– মুখে মাস্ক পরতে হবে এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কিন্তু আমরা যেন ভিড়ের মধ্যেই করোনাকে পরাস্ত করার জ্ঞান খুঁজে পেয়েছি।

সরকার পোশাক কারখানা মালিকদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলছে, এখন রফতানির পিক সিজন। কিন্তু জানতে ইচ্ছে করে এটা কি করোনাভাইরাস সংক্রমণেরও পিক সিজন নয়? বিধিনিষেধ চলার মাঝপথে একটি ব্যবসার কাছে এই নতি স্বীকার বেশ কিছু ভুল সংকেত দেয়:

১. পোশাক কারখানা খোলা এবং শ্রমিকদের সঙ্গে এই আচরণ মানুষকে ধারণা দেয়, দেশে মহামারি বলে কিছু নেই।  

২. সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সেটা মানতে বলার নৈতিক শক্তি আর থাকে না।

৩. চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা ১৭ মাস ধরে জীবন বাজি রেখে যে যুদ্ধটা করছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে পরিশ্রম করছেন– তাদের কাজের আর স্বীকৃতি থাকছে না।

৪. মানুষ ধারণা করতে পারে– সরকারের যেকোনও সিদ্ধান্ত বদলে দেওয়ার ক্ষমতা আছে ব্যবসায়ীরা তাদের নিজেদের স্বার্থে।

আমরা দেখেছি, ৩০ তারিখ সরকার-বিজিএমইএ সমঝোতার পরপরই  বিধিনিষেধ ভেঙে পড়ে। দোকানপাট খুলতে শুরু করে, গণপরিবহন না থাকলেও রাস্তায় বাড়তে থাকে যানবাহনের সংখ্যা। মোড়ে মোড়ে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। অনেকটা শিথিল হয়ে পড়েছে পুলিশের চেকপোস্টগুলো। তল্লাশি বা কাউকে বাসা থেকে বের হওয়ার কারণ জানতে চাওয়া হচ্ছে না। সাধারণ নাগরিকরা যেন বিধিনিষেধ বলে যে কিছু একটা ছিল সেটাই এবার মনে করতে পারছে না। অর্থনীতি গোষ্ঠীস্বার্থের যে মনোভাবকে পুষ্ট করতে চায়, করোনা অতিমারিতে সেটাই আরও একবার আমাদের সামনে নিয়ে এলো। তবে এ কথাও ঠিক যে, স্বার্থপরতার এই পরিমণ্ডলের মধ্যেও কিছু মানুষ করোনায় বিপদগ্রস্ত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স, অক্সিজেন সিলিন্ডার বা ওষুধ নিয়ে দৌড়ে বেড়ায়।

লকডাউন কাল থেকে আরও পাঁচদিনের জন্য বাড়ানো হয়েছে অর্থাৎ চলবে ১০ আগস্ট পর্যন্ত। এরপর কোনও বিধিনিষেধ আর কার্যকর করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না। ১১ আগস্ট থেকে লকডাউন পর্বের ইতি টানতে হবে বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু করোনা শেষ হবে না। প্রতিদিন ২০০’র ওপর মৃত্যু, সংক্রমণের হার ৩০ শতাংশ থেকে নামার কোনও লক্ষণ নেই। তবু প্রমাণ করার চেষ্টা করছি আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী। অতিমারি মোকাবিলায় সরকারের ভূমিকা পদে পদে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। শুরুর দিন থেকে দূরত্ববিধির কথা বলে আসছে, অন্যদিকে মানুষের ভিড়কে বিভিন্ন উৎসব ছুটির সময় অনুমোদন দিয়েছে। যারা করোনা সুরক্ষাবিধির কথা বলে, তারাই বিধি ভাঙার দৃষ্টান্ত তৈরি করছে।

ভারতের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দাপটে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বলতে গেলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। হাসপাতালে আর সিট নেই, আইসিইউ বা অক্সিজেন ফ্লো-তো অনেক দূরের কথা। বিধিনিষেধ যেহেতু সরকার নিজেই কার্যকর করতে পারছে না, তাহলে করণীয় কী সেটাই এখন ভাবার বিষয়। সরকার টিকার ওপর জোর দিচ্ছে এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন এটা করতেই হবে। জনস্বাস্থ্যের বিধিগুলো গোল্লায় যেহেতু গেছে, একটা কৌশল তো ঠিক করতেই হবে বিপদের মুখে করোনাবিধি মেনে চলার বিষয়টি কীভাবে নিশ্চিত করা যায় সেটা নিয়ে।

সবাই বলছে মানুষ করোনাবিধি মানছে না। কিন্তু মানুষ কেন করোনাবিধি অগ্রাহ্য করছে, তার সম্ভাব্য কারণ কী হতে পারে তা ভেবে দেখা দরকার। একটা কথা কিন্তু মানতেই হবে, গত ১৭ মাস ধরে এই ভাইরাস বাংলাদেশে আছে এবং গ্রাম-শহর নির্বিশেষে দেশের বেশিরভাগ মানুষ কোভিড-১৯-এর সুরক্ষাবিধি ও সাধারণ উপসর্গগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। এই রোগটি যে একটি সংক্রামক রোগ এবং মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়, তাও বেশিরভাগ মানুষ জানেন। কিন্তু তারপরও করোনা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে মানুষের অনীহা থেকে এটা স্পষ্ট যে, শুধু রোগের উপসর্গ বা সুরক্ষাবিধি সম্পর্কে মানুষের ধারণাই যথেষ্ট নয়। মানুষ তথ্য জানে, কিন্তু ঠিক বার্তাটি পায়নি। করোনা মোকাবিলায় সরকারি প্রচেষ্টার বিশ্বাসযোগ্যতা কার্যত গড়েই ওঠেনি। বিভিন্ন উদ্ভট কাণ্ডকারখানা থেকে মানুষ তার নিজের মতো করে করোনার বিপদ সম্পর্কে, তার থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার উপায় সম্পর্কে ধারণা করে নিয়েছে, যেখানে সবার কোনও স্থান নেই, অন্যের বিপদ সম্পর্কে কোনও ভাবনা নেই। বেঁচে থাকার দৈনন্দিন লড়াই ব্যক্তিগতভাবে চালাতে গিয়ে সবার কথা ভাববার চিন্তা দুর্বল হয়ে পড়েছে।

প্রতিদিন শত শত মানুষের মৃত্যু সংবাদ পাচ্ছে মানুষ। করোনা উপসর্গে মারা যাচ্ছে তার চেয়েও বেশি। কিন্তু খুব ভাবনার বিষয় এই যে, অতিমারি বা মহামারির কথা বললে আমাদের মাথায় সাধারণভাবে যে ভয়াবহতার চিত্র আসে, করোনা সেই ভয়াবহতা তৈরি করেনি। একটা কারণ হলো, এই রোগে উপসর্গহীন রোগীর সংখ্যা বেশি। সংক্রমিত মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বুঝতেই পারে না তার ভেতর অসুখটা আছে। ফলে সেই রোগটাকে মানুষ খুব বিপজ্জনক বলে মেনে নেবেন, এমনটা স্বাভাবিক নয়।

মানুষের এই মনোভাব, বিধিনিষেধ ঠিকভাবে বাস্তবায়নে সরকারের ব্যর্থতা, সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল। সরকার বললেই মানুষ সুরক্ষাবিধি মেনে চলবে না। তাকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এবং সেটার সময় আসলে অনেকটাই চলে গেছে। তবে দেরিতে হলেও শুরু করা যায় আমাদের বিশাল স্থানীয় সরকার কাঠামোকে যুক্ত করে। এখন একটা মালা গাঁথতে হবেই এবং সেটি  হলো: মাস্ক -করোনা পরীক্ষা-টিকা। সবাইকে মাস্ক পরাতে হবে, বেশি করে পরীক্ষা করতে হবে এবং দ্রুততম সময়ে গণটিকা কার্যক্রম শুরু করতে হবে।


লেখক: সাংবাদিক
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
দেশের জন্য কাজ করতে আ.লীগ নেতাকর্মীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
দেশের জন্য কাজ করতে আ.লীগ নেতাকর্মীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
নির্মোহ মূল্যায়নের খোঁজে জাসদ
নির্মোহ মূল্যায়নের খোঁজে জাসদ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ