X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৮ বৈশাখ ১৪৩১

লকডাউন লকডাউন খেলা

প্রভাষ আমিন
০৬ আগস্ট ২০২১, ১৪:৪৭আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০২১, ১৪:৪৭

প্রভাষ আমিন রাখাল বালকের গল্পটা আপনাদের সবার জানা। রাখাল গরু চড়াতে মাঠে যায়। হঠাৎ বালক চিৎকার করলো, বাঘ, বাঘ। শুনে গ্রামবাসী ছুটে গেলো। গিয়ে দেখলো বাঘ আসেনি। তারা ফিরে গেলো। কিন্তু রাখাল বালক বিষয়টিতে মজা পেলো। প্রায়ই সে ‘বাঘ বাঘ’ বলে চিৎকার করতো, গ্রাসবাসীও ছুটে আসতো। একদিন সত্যি সত্যি বাঘ এলো। কিন্তু সেদিন রাখাল বালকের ডাকে আর কেউ সাড়া দিলো না, সবাই ভাবলো আগের মতো মজা করছে। আমাদের এখন লকডাউন নিয়ে হয়েছে সেই দশা। লকডাউন, শিথিল লকডাউন, কঠোর লকডাউন, কঠোরতম লকডাউন কোনও কিছুতেই আর কাজ হচ্ছে না। মানুষ তার মতোই আচরণ করছে, সরকার কী বললো না বললো তাতে পাত্তাই দিচ্ছে না কেউ।

নীতিনির্ধারকদের মুখে এবং গণমাধ্যমের পাতায় ‘লকডাউন’ শব্দটি থাকলেও সরকারি কেতাবে নেই। প্রজ্ঞাপনে বিধিনিষেধ বা কঠোর বিধিনিষেধের কথা বলা আছে, গত বছর যা ছিল সাধারণ ছুটি।

তবে যাহা বাহান্ন তাহাই তেপ্পান্ন; যাহা সাধারণ ছুটি, তাহাই বিধিনিষেধ, তাহাই লকডাউন। কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা যদি সরকারের নির্দেশনা না মানি, লকডাউন হোক আর বিধিনিষেধ; কোনও কিছুতেই কাজ হবে না। সমস্যা হলো আমাদের বিপুল জনসংখ্যা। সারাদেশের কথা বাদ দিন, ঢাকায় যদি ৯০ ভাগ মানুষও সরকারের নির্দেশনা মানেন, তাহলেও তাকে বেশ সফল বলা যাবে। কিন্তু ঢাকার দুই কোটি জনসংখ্যার ১০ ভাগ মানে ২০ লাখ লোক যদি লকডাউন না মেনে রাস্তায় নামে, তাহলেও তো পরিস্থিতি জটিলই থেকে যাবে। ৯০ ভাগ বাদ দেন, যদি ৯৯ ভাগ মানুষও লকডাউন মানে, তাহলেও কিন্তু ২ লাখ মানুষ রাস্তায় থাকবে। বিশ্বের অনেক দেশের মোট জনসংখ্যা এরচেয়ে কম। তাই বাংলাদেশে লকডাউন কার্যকর করা বেশ কঠিন। আর সরকার কখনোই লকডাউন পুরোপুরি কার্যকর করতে পারেনি। নানামুখী চাপের কাছে তাদের নতি স্বীকার করতে হয়। ঈদের আগে উচ্চমুখী সংক্রমণের হারের মুখে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা যখন লকডাউনকে আরও কঠোর করে শাটডাউন বা কারফিউ জারির পরামর্শ দিচ্ছিল, তখন সরকারকে লকডাউন শিথিল করতে হয়েছে। সরকারকে এটা করতে হয়েছে অতীত অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে। ঈদের সময় যত বিধিনিষেধই থাকুক, মানুষ যেকোনও মূল্যে বাড়ি যেতে চায়, তাতে স্বাস্থ্যবিধির কোনও বালাই থাকে না। সরকারের অবস্থা হয়েছে চিড়েচ্যাপ্টা। পা ঢাকতে গেলে মাথা উদোম হয়ে যায়, মাথা ঢাকতে গেলে পা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কথা শুনলে অর্থনীতি ভেঙে পড়ে, গরিব মানুষের ঘরে হাঁড়ি চড়ে না। আর অর্থনীতির কথা চিন্তা করলে করোনা বেপরোয়া হয়ে যায়।

ঈদের পর দুই সপ্তাহের কঠোর লকডাউন ৫ আগস্ট পর্যন্ত চলার কথা থাকলেও ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে হুট করে ১ আগস্ট থেকে রফতানিমুখী গার্মেন্ট কারখানা খুলে দিয়েছে। তাতে সারাদেশ থেকে গার্মেন্ট শ্রমিকরা দলে দলে ঢাকায় ফিরে, তাতে পরিস্থিতি আবার হ-য-ব-র-ল হয়ে যায়।

লকডাউনের অবস্থা হয়েছে তৈলাক্ত বাঁশে চড়ার মতো। মোটামুটি লকডাউনে পরিস্থিতির যতটুকু উন্নতি হয়, ঈদ বা শ্রমিকদের ঢাকায় ফেরার মতো পরিস্থিতিতে তা আবার নেমে যায়।

বিশ্বের অনেক দেশ এরইমধ্যে করোনাকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশে পরিস্থিতি আরও অবনতি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা সামনে আরও খারাপ দিনের আশঙ্কা করছেন। করোনার যে ভয়াবহতা, লকডাউন দিয়ে তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। সরকার লকডাউন দেয় আসলে হাসপাতালে চাপ কমিয়ে রাখার জন্য। তারপরও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতালে এখন ঠাই নাই ঠাই নাই পরিস্থিতি। কেউ একজন মারা গেলেই শুধু অপেক্ষমাণ কেউ আইসিইউ পাচ্ছেন।

সরকার আপাতত ১০ আগস্ট পর্যন্ত চলমান কঠোর বিধিনিষেধ বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১১ আগস্ট থেকে ধাপে ধাপে সব খুলে দেওয়া হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ব্যাপারেও চাপ প্রবল হচ্ছে। সরকার এখন টিকা এবং স্বাস্থ্যবিধির দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। আসলে এই মুহূর্তে এছাড়া কোনও বিকল্পও নেই। জীবন আর জীবিকার লড়াইটা চলতেই থাকবে। ৩ আগস্ট আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ১১ আগস্টের পর ১৮ বছরের বেশি বয়সী কেউ টিকা নেওয়া ছাড়া রাস্তায় বেরুতে পারবেন না, বেরুলে শাস্তি পেতে হবে।

আদর্শ পরিস্থিতি বিবেচনা করলে, এই সিদ্ধান্তকে সঠিকই মনে হবে। কিন্তু বাস্তবতা এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে না। কারণ, এখনও টিকা গ্রহণের সর্বনিম্ন বয়স ২৫, ১৮ বছর বয়সীদের টিকা দেওয়া শুরুই হয়নি। তাছাড়া এখন পর্যন্ত মোটামুটি এক কোটি লোক টিকা নিয়েছেন।

৭ থেকে ১২ আগস্ট সরকার আরও এক কোটি লোককে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। এই সিদ্ধান্তেও পরিবর্তন এসেছে। এখন সর্বশেষ জানানো হয়েছে, ৭ আগস্ট থেকে পরবর্তী পাঁচদিনে সারাদেশে ক্যাম্পেইন চালিয়ে ৩২ লাখ মানুষকে করোনা ভাইরাসে টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হবে।

যদি গণটিকা দেওয়াও শুরু হয়ও তবু বিপুলসংখ্যক লোক টিকার বাইরে রয়ে যাবে। অবশ্য রাতেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, টিকা ছাড়া বাইরে বেরুলে শাস্তির সিদ্ধান্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নয়। বিভিন্ন উৎস থেকে সরকার টিকা সংগ্রহের চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বারবার বলেছেন, যত টাকা লাগুক, সব মানুষের জন্য টিকার ব্যবস্থা করা হবে। এখন পর্যন্ত ২১ কোটি টিকার আশ্বাস মিলেছে। সময় মতো সব ভ্যাকসিন এলে, টিকা কার্যক্রম ছড়িয়ে দিতে পারলেই শুধু পরিস্থিতির উন্নতি আশা করা যায়।

তবে যতদিন সবাইকে টিকার আওতায় আনা না যাবে, ততদিন মাস্ক আর স্বাস্থ্যবিধিই আমাদের টিকা। লকডাউন থাকুক আর না থাকুক, স্বাস্থ্যবিধি এবং মাস্ক পরা যেন বাধ্যতামূলক হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ১১ আগস্টের পর টিকা দেওয়া ছাড়াও হয়তো বাইরে বেরুনো যাবে, তবে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে শাস্তির ব্যবস্থা হচ্ছে। এ জন্য প্রয়োজনে অধ্যাদেশ জারি করা হবে। এছাড়া কোনও উপায় নেই।

তবে মুখে বললেই স্বাস্থ্যবিধি মানানো বা মাস্ক পরানো যাবে না। অনেক ঘোষণা দিয়েও কোরবানির পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি মানানো যায়নি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চালু বা দোকানপাট খোলার কথা বলা হলেও খোলার পর আর তা মানা হয় না। তাই সরকারকে অনুরোধ করছি ১১ আগস্টের পর যেন স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং মাস্ক পরার ব্যাপারে সর্বোচ্চ কঠোরতা অবলম্বন করা হয়। আমরা যদি নিজেরা সচেতন না হই, স্বাস্থ্যবিধি না মানি, মাস্ক না পরি; তাতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী যেমনটি বলেছেন, সারা ঢাকা শহরকে হাসপাতাল বানালেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না। তেমন দিন যেন আমাদের দেখতে না হয়।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঘরের মাঠে পিএসজিকে হারিয়ে এগিয়ে থাকলো ডর্টমুন্ড
চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনালঘরের মাঠে পিএসজিকে হারিয়ে এগিয়ে থাকলো ডর্টমুন্ড
ইজিবাইক ছিনতাইয়ের সময় স্থানীয়দের পিটুনিতে একজনের মৃত্যু
ইজিবাইক ছিনতাইয়ের সময় স্থানীয়দের পিটুনিতে একজনের মৃত্যু
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে শ্রমিকরাও অংশীদার হবে: এমপি কামাল
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে শ্রমিকরাও অংশীদার হবে: এমপি কামাল
মোস্তাফিজের শেষ ম্যাচে চেন্নাইয়ের হার
মোস্তাফিজের শেষ ম্যাচে চেন্নাইয়ের হার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ