X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই, তবে...’

প্রভাষ আমিন
১৯ আগস্ট ২০২১, ১৫:৩৩আপডেট : ১৯ আগস্ট ২০২১, ১৬:২৫

প্রভাষ আমিন কাবুলের পতন অনিবার্যই ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন তাদের দীর্ঘতম যুদ্ধে লজ্জাজনক পরাজয় নিয়ে লেজ গুটিয়ে পালালো, তখনই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল আফগানিস্তান আবার তালেবানদের দখলে যাচ্ছে, ফিরে যাচ্ছে গভীর অন্ধকার যুগে। মার্কিন দখলদারিত্বের দুই দশক যে আফগানিস্তান খুব আলোকোজ্জ্বল ছিল, তেমনটি নয়, তবে এতদিন যদি অন্ধকারে থাকে, তবে এখন যাচ্ছে গভীরতম অন্ধকারে। তবে সেটা যে এত তাড়াতাড়ি হবে অনেকেই ভাবেননি।

কাবুলের পতনের পর ঝড় বয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, করোনা আর ডেঙ্গু হটিয়ে মূলধারার গণমাধ্যমেরও অনেকটাই দখল করে নিয়েছে আফগানিস্তান। ভৌগোলিক নৈকট্য তো আছেই, ধর্মীয় কারণেও আফগানিস্তানের ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের প্রবল আগ্রহ। আর বিশ্বের যে প্রান্তেই হোক, যে ধর্মেরই হোক; কোনও সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী যখন একটি দেশের ক্ষমতা দখল করে; তখন বিশ্বের সব বিবেকবান মানুষই উদ্বিগ্ন হবেন।

বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আফগানিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে বহুমুখী মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিরাজ করছে। একপক্ষ সরাসরি তালেবানদের বিপক্ষে, আরেক পক্ষ সরাসরি তালেবানদের পক্ষে। আরেকটি পক্ষ তালেবানদের দখলে উৎফুল্ল হয়ে বাংলাদেশেও তালেবান স্টাইলে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছেন। তবে বিপজ্জনক আরেকটি পক্ষ কৌশলে ইনিয়ে-বিনিয়ে তালেবানদের পক্ষে বলার চেষ্টা করছেন। সরাসরি তালেবানদের পক্ষ নিলে তাদের সুশীল আবরণ খসে পড়তে পারে, হয়তো এ ভাবনা থেকেই তারা একটু কৌশলী।

একটি পক্ষ তালেবানদের দখলকে ইসলামের ‘বিজয়’ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় পরিচয় ইসলাম। তাই সত্যি সত্যি কোথাও ইসলামের জয় হলে সেটা নিয়ে মুসলমানদের উৎফুল্ল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার, ধর্মীয় পরিচয়ে তালেবানরা মুসলমান হলেও তাদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ইসলামের কোনও সম্পর্ক নেই। তালেবানদের আফগান দখলের সঙ্গে ইসলামের কোনও সম্পর্ক নেই। বিশ্ব আফগানিস্তানে তালেবান শাসন দেখেছে। তালেবানরা হলো আফগানিস্তানের শত্রু, বিশ্বের শত্রু, প্রগতির শত্রু, সর্বোপরি ইসলামের শত্রু। এই তালেবান, আল কায়েদা, আইএস’র সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে শান্তির ধর্ম ইসলামকে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসের ধর্ম হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়। পশ্চিমা বিশ্ব এই সন্ত্রাসীদের সঙ্গে ইসলামকে গুলিয়ে ফেলে বারবার ইসলামকে হেয় করার চেষ্টা করে। তাই একজন সত্যিকারের মুসলমান অবশ্যই তালেবানের উত্থানে শঙ্কিত হবেন।

আফগানিস্তানে তালেবানদের অন্ধকার শাসন যেন বিশ্বজুড়ে ইসলামকে হেয় করতে না পারে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে সব মুসলমানকেই। ইসলাম ভালোবাসায় বিশ্বাস করে, শান্তিতে বিশ্বাস করে; গায়ের জোরে দখলে নয়।

আর বাংলাদেশের শান্তিকামী মানুষ তালেবানদের উত্থানে শঙ্কিত। কারণ, নব্বইয়ের দশকে এই তালেবানদের হাত ধরেই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের যাত্রা শুরু। আর এই জঙ্গিরা কী করতে পারে, সেটা বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে এবং প্রত্যাখ্যান করেছে। তালেবানদের পুনরুত্থানে আপাতত গর্তে লুকিয়ে থাকা বাংলাদেশের জঙ্গিরা নতুন করে গা-ঝাড়া দিতে পারে। এরইমধ্যে অনেকে আফগানিস্তানে গিয়ে তালেবানদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বলেও খবর মিলেছে। শঙ্কার কথাটা বলেছেন পুলিশ কর্তারাও। 

বাংলাদেশের অনেকেই বর্তমান সরকারের পতন চান। এই চাওয়াতে কোনও অন্যায় নেই। গণতান্ত্রিকভাবে সরকারের পতন চাওয়ার অধিকার সবারই আছে। অনেক সমালোচনার কাজ সরকার করেছেও। নির্বাচনি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়া, মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত করা, দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার, সুশাসনের অনুপস্থিতির মতো অনেক ইস্যু আছে সরকারের বিরোধিতা করার মতো। কিন্তু আফগানিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি মিলিয়ে যারা সুখস্বপ্নে বিভোর, তাদের অবস্থানটা সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং।

তারা বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চান, কিন্তু আফগানিস্তানে গায়ের জোরে ক্ষমতা দখলকে সমর্থন করছেন। এটা স্পষ্টতই স্ববিরোধিতা। অনেকেই দাবি করছেন, তালেবানরা আফগান জনগণের সমর্থন নিয়েই ক্ষমতা দখল করেছে। কিন্তু এই দাবির কোনও ভিত্তি নেই। সে দেশে কোনও নির্বাচন হয়নি। আর তালেবানরা কাবুল দখলের পর থেকে যেভাবে মানুষ প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটছে, যে যেভাবে পারে পালাচ্ছে, নারীরা নিজেদের পরিচয় গোপন করে বোরকার দোকানে ভিড় করছে; তাতে তালেবানদের প্রতি সমর্থন বা ভালোবাসার কোনও চিহ্ন নেই। সবার মধ্যেই ভয় আর আতঙ্ক। বরং তালেবানদের এই প্রবল উত্থানের মধ্যেও সে দেশে তাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে।

তালেবানদের গুলিতে তিন জন মারাও গেছেন। কাবুল বিমানবন্দরে দেশ ছাড়তে চাওয়া হাজারো মানুষের ভিড়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে কেউ কেউ সরকার পতন হলে বাংলাদেশের বিমানবন্দরেও একই দৃশ্যের অবতারণা হবে বলে স্বপ্ন দেখছেন। আসলে তারা মুখে গণতন্ত্রের কথা বিশ্বাস করলেও অন্তরে বিকল্প উপায়ে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখেন।

তালেবানরা তাদের সেই স্বপ্নের পোলাওয়ে আরেকটু ঘি ঢেলেছে মাত্র। তবে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি আর বাংলাদেশের পরিস্থিতি মোটেই এক নয়। অতি উৎসাহী কেউ কেউ তালেবান জঙ্গিদের ‘যোদ্ধা’ হিসেবে অভিহিত করছেন। এমনকি কেউ কেউ তাদের বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গেও তুলনা করছেন। তারা বুঝতে পারছেন না, এটা করে তারা বাংলাদেশের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধকেই অবমাননা করছেন। 

তবে ইনিয়ে বিনিয়ে তালেবানদের পক্ষ নেওয়া পক্ষটিই সবচেয়ে বিপজ্জনক। তারা আফগানিস্তানকে আফগানদের হাতেই ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। খুব ভালো পরামর্শ। কখনও রাশিয়া, কখনও আমেরিকা আফগানিস্তানকে তাদের রাজনীতির খেলার মাঠ বানিয়েছে। কিন্তু তালেবান মানেই তো আফগান জনগণ নয়। তারা গায়ের জোরে দখল করেছে। এখানে আফগান জনগণের মতামত প্রতিফলিত হয়নি। আর তালেবানরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা গণতান্ত্রিক পন্থায় দেশ চালাবে না।

এই পক্ষটি বলছেন, আগের তালেবান আর এখনকার তালেবান এক নয়। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান দখলদার তালেবানরা মুখে নানা মিষ্টি কথা বলছে বটে, আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য তারা কিছুটা উদার আচরণও হয়তো করবে; তবে তারা স্পষ্ট বলে দিয়েছে, আদর্শিকভাবে তারা নিজেদের অবস্থান থেকে একচুলও নড়বেন না। জঙ্গিরা সব সময় জঙ্গি।

এই পক্ষটি, আফগানিস্তান নিয়ে না ভেবে নিজেদের দেশের সমস্যা নিয়ে ভাবার পরামর্শ দিয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যমান সব সমস্যা নিয়ে অবশ্যই আমাদের কথা বলতে হবে। গণতন্ত্রহীনতা, মানবাধিকারহীনতা, দুর্নীতি, সুশাসনের অভাব নিয়ে আমাদের প্রতিবাদ করতে হবে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি বহাল রাখতে হবে। কিন্তু তার মানে তো এই নয়, বাংলাদেশে সমস্যা আছে বলেই বিশ্বের অন্য কোনও দেশের সমস্যা নিয়ে কথা বলা যাবে না। তালেবানদের উত্থান শুধু আফগানিস্তানের সমস্যা নয়। তালেবানদের প্রশ্রয়ে আল কায়েদা, আইএস আবার শক্তিশালী হতে পারে। আফগানিস্তানকে কেন্দ্রে রেখে বিশ্ব জঙ্গিবাদ নতুন করে মাথাচাড়া দিতে পারে। তালেবানদের দখল শুধু আফগানিস্তানকেই অস্থিতিশীল করবে না; এশিয়া এমনকি বিশ্বকেই অস্থির করে তুলতে পারে। তাই সারা বিশ্বের প্রগতিশীল, শান্তিকামী মানুষ এর প্রতিবাদ করবে।

তালেবানদের বিরোধিতা করলে বাংলাদেশের সরকারের বিরোধিতা করা যাবে না, এমন তো কোনও কথা নেই।

এই ইনিয়ে বিনিয়ে তালেবানদের পক্ষ নেওয়া দেখে আমার একটা পুরনো কথা মনে পড়ে গেছে। বাংলাদেশে যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধীদের বিচার শুরু হলো, তখন সারাদেশের মানুষ এর পক্ষে বিপুল সমর্থন দেয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল জনরায় পেয়েছিল। সে নির্বাচনের আগে তাদের অঙ্গীকার ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। তাই স্বাধীনতাবিরোধী অংশটিও প্রথমে সরাসরি এই বিচারের বিরোধিতা করতে পারেনি। তখন স্বাধীনতা বিরোধীদের বুদ্ধিবৃত্তিক অংশটি বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র নিয়ে মাঠে নামে। তখন তাদের মুখে শোনা যেত, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমরাও চাই, তবে...। এই ‘তবে’ দিয়ে তারা নানান ছল করতো। বিচার আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে, অভিযুক্তদের আইনি সুরক্ষা দিতে হবে। এতদিন পর বিচার করে জাতিকে বিভক্ত করা হচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু দেশি-বিদেশি চক্রের শত ষড়যন্ত্র, ‘যদি-কিন্তু’র ঢল বইয়েও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আটকাতে পারেনি। 

তেমনভাবে কৌশলে এই মহলটি এখন তালেবানদের পক্ষ নিচ্ছে। কিন্তু বিশ্বের শত্রু, প্রগতির শত্রু, ইসলামের শত্রু তালেবানদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে বাংলাদেশে তো বটেই, বিশ্বের সবাইকেও।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
‘শো মাস্ট গো অন’
চিকিৎসা সুরক্ষা আইন জরুরি‘শো মাস্ট গো অন’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ