X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

আহারে, ছাত্র রাজনীতি!

মো. রবিউল ইসলাম
১২ ডিসেম্বর ২০২১, ১৬:২০আপডেট : ১২ ডিসেম্বর ২০২১, ১৮:০৯

মো. রবিউল ইসলাম আবরার হত্যা মামলায় সাজা হয়েছে অপরাধীদের। এই হত্যা ঘটনার পর বুয়েট প্রশাসন সিদ্ধান্ত দিয়েছে যে ৭৫,০০০ টাকা করে মাসিক পারিতোষিক দেওয়া হবে আগামী ১২ বছর আবরারের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে। এমনকি মামলা পরিচালনার এবং মামলা চলাকালীন যাবতীয় খরচ বহন করছে বুয়েট কর্তৃপক্ষ। আপাতদৃষ্টে,  এই সিদ্ধান্ত যথেষ্ট মানবিক আর প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু আবরারের পরিবারের মতো ভাগ্য সহায় হয়নি ২০০৮  সালে বুয়েটে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের দুইপক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত সাবেকুন নাহার সনির পরিবারের বা ২০১৩-এর এপ্রিল মাসে হেফাজত কর্মীর হামলায় নিহত বুয়েট ছাত্র আরিফ রায়হান দ্বীপের পরিবারের।

সে সময় সনি ও দ্বীপের পরিবারের কারোরই জোটেনি বুয়েট প্রশাসন থেকে কোনও আর্থিক সাহায্য বা উল্লেখযোগ্য কোনও সহযোগিতা। যদিও এক্ষেত্রে বুয়েট প্রশাসন দাবি করতে পারে যে অতীতের চেয়ে বর্তমানে অনেক বেশি মানবিক কর্তৃপক্ষ বুয়েট পরিচালনা করছে, তাই তাঁরা আবরারের পরিবারের  জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। তবে, বুয়েট কর্তৃপক্ষ যে যুক্তিই এখানে দেখাক না কেন, আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘restorative justice’ বা ‘প্রতিদানের বিচার’-এর ব্যবস্থা করা।

অর্থাৎ যে ক্ষতি হয়েছে, তাকে অর্থ বা অন্য কোনও কিছুর বিনিময়ে লাঘব করার চেষ্টা মাত্র। আর সেটা বুয়েট করতে বাধ্য সব ঘটনাতেই; কারণ বুয়েটের আবাসিক শিক্ষার্থী কিছু দুষ্কৃতকারীদের আক্রমণে এবং প্রশাসনের শক্ত নজরদারির অভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। আবাসিক সুবিধা অবশ্যই নিরাপত্তাকে অন্তর্ভুক্ত করে। তবে, নিয়ম সবার জন্য সমান হওয়া উচিত ছিল।

এবার আসা যাক মূল প্রসঙ্গে। একটি মেধাবী শিক্ষার্থীকে নির্মমভাবে হত্যার কারণে, ২৫টি তাজা মেধাবী মুখ দৃষ্টান্তমূলক সাজা পেলো। কারণ, এরা প্রত্যক্ষ আসামি। তাই প্রমাণ সাপেক্ষে, তাদের এমন সাজা জুটেছে। কিন্তু ঘটনাটা কি এতটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ, নাকি অন্যদিকটাও বিশ্লেষণের দাবি রাখে? স্বীকার করতে অসুবিধা নেই, যে বাংলাদেশের যাবতীয় যুগপৎ আন্দোলনগুলোর মূল কুশীলব ছিল ছাত্ররা আর তাদের ছাত্র সংগঠনগুলো। এদের বলিষ্ঠ ভূমিকায় আর ত্যাগের বিনিময়ে, এ দেশ পেয়েছিল ভাষা, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচনি ব্যবস্থা আরও কত কী। এমনকি একবিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত বর্ষীয়ান রাজনীতিকরা ছিলেন ক্যারিয়ার পলিটিসিয়ান, অর্থাৎ ছাত্র রাজনীতি থেকে ধীরে ধীরে তাদের অবস্থান তৈরি হয়েছে মূল ধারার রাজনীতিতে। আর তার ফলশ্রুতিতেই তাদের অনেকে হয়েছেন এমপি, মন্ত্রী বা রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারক। যদিও হালজামানায়, এই নিয়মে রাজনীতিবিদ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কমে গেছে। এখন উড়ে এসে জুড়ে বসাদের যুগ। একই সঙ্গে ছাত্র-রাজনীতির এক ভয়াবহ দুরবস্থা চলছে। যেমন, ছাত্র অবস্থায় রাজনীতির আড়ালে চলছে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, তদবির বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, র‍্যাগিং, হল দখল, ডাইনিং-এর ‘ম্যানেজার গিরি’ ইত্যাদি। এমনকি শোনা যায়, ভিসি প্রভিসি ‘বানাতে’ও নাকি তারা ভূমিকা রাখে! কী ‘ক্ষমতাশীল’ এরা! এগুলোর থেকে উপলব্ধি হয়, যেসব চমৎকার গুণ নিয়ে ছাত্রজীবন বিকশিত হওয়া উচিত ছিল, সেখানে ছাত্র-রাজনীতি এখন উল্টো প্রভাব বিস্তার করছে।

বছর দুয়েক আগে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের সর্বোচ্চ দুই নেতাকে দুর্নীতির দায়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কী মর্মান্তিক ব্যাপার! দুর্নীতি করার মতো কোনও অফিসিয়াল পোস্টে না থেকেও, তারা দুর্নীতির সঙ্গে আজ জড়িত। এক অদৃশ্য ক্ষমতা তাদের যেন, ক্ষমতার চূড়ান্তে নিয়ে গেছে। এই বাড়াবাড়ির পরিণতিতে কুয়েটের কিছু ছাত্রনেতাকেও সদ্য ক্যাম্পাস থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, শিক্ষক মৃত্যুতে পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতার কারণে।

আচ্ছা নষ্ট ছাত্র রাজনীতির বলি যেসব ছাত্ররা, এরা যখন অপরাধ করে সাজা পায়, এই সাজাটুকুই কি প্রতিরোধক বা প্রতিষেধকের উপায় হতে পারছে? নাকি, আমরা আসলে রোগ বাদ দিয়ে শুধু রোগের উপসর্গের চিকিৎসার দিকে নজর দিয়ে আছি? খুব সহজে বললে, অধঃপতনের ছাত্র রাজনীতির যারা সুবিধাভোগী তাদের বিচার করবে কে? কারা ভয়ের রাজনীতি ছাড়ানো ছাত্রনেতাদের সোনার ছেলে হিসেবে আখ্যা দেয়? কারা শিক্ষাঙ্গনগুলোকে রাজনৈতিক সাম্রাজ্যের চারণভূমি বানিয়ে রাখে? কারা নিজেদের সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়ে গরিব বাবা-মার সন্তানদের ছাত্র রাজনীতির নামে দলীয় এজেন্টে পরিণত করে? এর উত্তরগুলো খুঁজলে পাওয়া যাবে, প্রয়োজন ছাড়াই মূল ধারার, বিকল্প ধারার বা ধর্মীয় ধারার সব রাজনীতিকরা নিজেদের ক্ষমতার ভাগ নিশ্চিত করার জন্য, ছাত্র সংগঠন তৈরি করে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। দলীয়ভাবে ব্যবহৃত হতে হতে, এসব রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা হারিয়েছে জাতীয় স্বার্থের প্রতি এদের সংবেদনশীলতা। সাধারণ ছাত্ররা তাই আজ যেকোনও অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামে; আর সচেতনভাবে চেষ্টা করে প্রতিষ্ঠিত ছাত্র সংগঠনের ব্যানারগুলো থেকে আন্দোলনগুলো মুক্ত রাখতে। সাধারণ মানুষ আজ সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলনের প্রতি যতটা সমর্থন বা সংহতি জানায়, দলীয় ছাত্র সংগঠনের ক্ষেত্রে তার কিয়দংশও দেখায় না।

ছাত্র আন্দোলনের আর এক সুবিধাভোগী কিছু অতিমাত্রার ‘রাজনৈতিক শিক্ষকরা’। এরা বিভিন্ন দলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের হাত করে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তি হয়ে আমলাতান্ত্রিক সুবিধা ভোগ করতে চায়। মুখে যতই নীতি বাক্য ফুটুক না কেন, দিন শেষে এসব শিক্ষকদের মধ্যে একটা করে ‘আমলা’ বাস করে।

কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগের সেতু হিসেবে এরা দলীয় ছাত্রনেতাদের ব্যবহার করে। ছাত্রনেতারাও কিছু সুবিধা নিয়ে তাদের আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করে। এদের মধ্যে তখন আর ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্ক থাকে না; বরং সম্পর্কটা টার্ন নেয় ‘প্রিন্সিপাল’ আর ‘এজেন্টে’র। এই অবস্থা কীভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুস্থ ছাত্র রাজনীতির চর্চা ঘটাবে?

কী আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন নিয়ে বুয়েটে পড়তে এসেছিল আবরার আর তাকে হত্যায় দণ্ডপ্রাপ্ত মেধাবী ২৫ জন ছাত্র! আজ তারা কারা প্রকোষ্ঠে। রাষ্ট্রের কী মারাত্মক ক্ষতি! সাজাপ্রাপ্ত আসামি না হলেও, দুর্ভাগ্যের পরিণতি ভোগ করতে হয় অনেক ছাত্র নেতাকর্মীকেই। গুটি কয়েক ছাত্রনেতারা হয়তো ছাত্র রাজনীতি করে ভাগ্য বদলিয়েছে, কিন্তু অধিকাংশরই কপাল এতটা সুপ্রসন্ন হয়নি।

তাই তো, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা অনেক ছাত্র নেতাদের দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরই একটা দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির চাকরির জন্য ঘুরতে। যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময়ের সার্ভিস দিয়েছে সংগঠনকে, কিন্তু জীবনে হয়েছে বঞ্চিত। অথচ তাদের পৃষ্ঠপোষকরা সব সময়ই আছে বহাল তবিয়তে। এহেন অসামঞ্জস্যমূলক পরিণতি দেখলে প্রশ্ন আসে, কারা ছাত্র রাজনীতি চালু রেখে এমন সব নিদারুণ পরিস্থিতি তৈরি করতে দিলো? কীসের জন্য আর কাদের জন্য এমন রাজনীতি চালু রাখা আছে? ছাত্র-রাজনীতি দিনশেষে কার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে? লাভ ক্ষতির হিসাব মিলিয়ে দেখার বোধও আমরা হারিয়েছি। ঐতিহ্যের ছাত্র রাজনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পাঠিয়ে, আর যাবতীয় অনিয়ম-অনাচার চালু রেখে দেশ ও জাতির কি কল্যাণ করা হচ্ছে? এর উত্তর সময় দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু স্বার্থের রাজনীতির কাছে সে শিক্ষা পাত্তা পায় না কিছুতেই।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও পিএইচডি গবেষক (হংকং)।

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ব্রাজিলে বৃষ্টিপাতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৭৮, এখনও নিখোঁজ অনেকে
ব্রাজিলে বৃষ্টিপাতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৭৮, এখনও নিখোঁজ অনেকে
হারিয়ে গেছে প্রাণ, নদীর বুকে বুনছে ধান
হারিয়ে গেছে প্রাণ, নদীর বুকে বুনছে ধান
টিভিতে আজকের খেলা (৬ মে, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (৬ মে, ২০২৪)
নারায়ণগঞ্জে চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ, আহত ৩
নারায়ণগঞ্জে চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ, আহত ৩
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ