গানের শিল্পী, গ্রামোফোন, ক্যাসেট ও অন্যান্য: পর্ব নয়

দৃষ্টি হারিয়েও সেই যুগের শ্রেষ্ঠ গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে

কুমিল্লায় বিশাল আয়োজন। আয়োজনে সহযোগিতা করছেন শচীন দেব বর্মণ। কলকাতা থেকে শিল্পী আনার কাজটি উনিই করছেন। একটি মাত্র গান না গেয়েও শচীনকর্তা কুমিল্লাবাসীর কাছে সেদিন হিরো ছিলেন। শুধু একটি কারণে, সে সময়ের প্রখ্যাত গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে কুমিল্লায় গান গাইতে আসেন, তাকে আনার ব্যবস্থা করেছিলেন শচীনকর্তা। এই ঘটনায় বোঝা যায় কৃষ্ণচন্দ্রের জনপ্রিয়তা কেমন ছিল।

‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে
কত প্রাণ হলো বলিদান
লেখা আছে অশ্রুজলে’

দেশাত্মবোধক এই গান গাওয়ার পরপরই বাঙালির ঘরে ঘরে ঠাঁই করে নিয়েছিল। আবার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় একই গান বাংলাদেশের মানুষের প্রেরণার গান, উদ্দীপনার গানে পরিণত হয়েছিল। এই গান এখনও জনপ্রিয়তার তালিকায় ওপরের দিকেই আছে।

মোহনী চৌধুরীর লেখায় কৃষ্ণচন্দ্র এই গানের সুর করেছেন ও গেয়েছেন। রেকর্ড করার অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন সভা সমাবেশে কৃষ্ণচন্দ্র এই গান গাইতেন। সেখান থেকেই গানটির জনপ্রিয়তা শুরু। রেকর্ডে প্রকাশিত হওয়ার পর জনপ্রিয়তা দ্রুত শীর্ষে পৌঁছায়।
 
গায়ক হিসাবে তো তখন কৃষ্ণচন্দ্রের তুলনা শুধু কৃষ্ণচন্দ্রই। সুরকার হিসেবে তিনি কতো উন্নত ছিলেন, এই গানটি শুনলে কিঞ্চিৎ অনুধাবন করা যায়। 

ছোটবেলায় ছাদে ঘুড়ি উড়িয়ে নেমে এলেন কৃষ্ণচন্দ্র। মাকে বললেন চোখ জ্বালা করছে। ডাক্তার দেখানো হলো। চোখ ভালো হলো না। আস্তে আস্তে তিনি দৃষ্টি শক্তি হারান। তখন তার বয়স মাত্র ১৩। মা তার ছেলের ভবিষ্যৎ ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়েন। কিন্তু কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ছেলের সামনে সহজ স্বাভাবিক থাকলেও আড়ালে আড়ালে চোখের  জল ফেলা এবং আশীর্বাদ করাই উনার প্রধান কাজ হয়ে ওঠে। কৃষ্ণচন্দ্রের জন্ম ১৮৯৩ মতান্তরে ১৮৯৪ ।

সেই সময় সাহায্যপ্রার্থীরা সাহায্য চাইতে এসে গানও শোনাতেন। তারা চলে যাওয়ার পর, কৃষ্ণচন্দ্র সেই একবার শোনা গান হুবহু গাইতেন। গানের কথা ও সুরে কোনও ভুল হতো না। মায়ের নজরে ব্যাপারটি আসার পর তিনি ছেলেকে গান শেখানোর ব্যাপারে ভাবলেন।
 
তার মনে হলো গানের চেয়ে ভালো বন্ধু আর কে হতে পারে। এই গান অবলম্বন করেই তো কৃষ্ণচন্দ্র সুন্দর করে জীবন কাটাতে পারে। কিন্তু গান শেখার জন্য তো টাকা লাগবে। কৃষ্ণচন্দ্রের বাবা গত হয়েছেন। টাকার অভাব তো আছেই। কৃষ্ণচন্দ্রের মা সহজ পথ ধরলেন।
 
জোড়াসাঁকোর কাছে থাকেন হরেন্দ্রনাথ শীল। শাস্ত্রীয় সংগীতের একজন নামকরা পৃষ্ঠপোষক। বাড়িতে প্রায় সারা দিন গান-বাজনা হয়। কৃষ্ণের মা প্রতিদিন কৃষ্ণকে ওই বাড়িতে বসিয়ে দিয়ে আসতেন। পরে গিয়ে আবার নিয়ে আসতেন। কৃষ্ণ ওই বাড়িতে যে গানগুলো শুনতেন, বাসায় এসে তা অবিকল গাইতেন।
 
হরেন্দ্রনাথ শীল নিজে খুব ভালো সুরবাহার বাজাতেন। তিনি একসময় কৃষ্ণকে নিজ বাড়িতে রেখে শাস্ত্রীয় সংগীত শিক্ষা দিতে শুরু করলেন। বিভিন্ন ওস্তাদ শিক্ষাদানে ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি তালিম নেন খেয়ালিয়া শশীভূষণ দে’র কাছে। টপ্পার শিক্ষা নেন সতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। তালিম নেন প্রখ্যাত পণ্ডিত খলিফা বাদল খাঁর কাছে। এছাড়া কেরামতুল্লা খান, দবির খান, জমিরউদ্দিন খান, মহেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়সহ সেই সময়ের প্রায় সব গুণী ওস্তাদের কাছেই তিনি তালিম নিয়েছিলেন।

গ্রামোফোন কোম্পানির ভগবতীচরণ ভট্টাচার্য তার গান শুনেছিলেন, হরেণ শীলের বাড়িতে। তিনি কৃষ্ণচন্দ্রের গান রেকর্ড করার ব্যবস্থা করেন। এইচ এম ভি থেকে তার রেকর্ড প্রকাশ হয়। বয়স তখন মাত্র ১৮। রেকর্ডের গান দুটি ছিল- ‘আর চলে না চলে না মাগো’ এবং ‘মা তোর মুখ দেখে কি’।
 
গান দুটি তেমন একটা জনপ্রিয় হয়নি। পরের রেকর্ডকৃত গান ছিল নিজের লেখা ‘দীন তারিণী তারা’। এই দ্বিতীয় রেকর্ডটিও প্রকাশ করে এইচ এম ভি। এই রেকর্ড প্রকাশের সাথে সাথে চারদিকে হৈচৈ পড়ে যায়। এবং তিনি গ্রামোফোন কোম্পানিতে স্থায়ী শিল্পী হিসেবে নিয়োগ পান। প্রতিমাসে নিয়মিত তার রেকর্ড প্রকাশ হতে থাকে। 

কৃষ্ণচন্দ্র দেগাওয়ার বাইরে তিনি প্রচুর নাটকেও অভিনয় করেছেন। সংগীত পরিচালনা করেছেন। সিনেমার জন্য গান করেছেন। সুর করেছেন। পঞ্চকবির গান গেয়েছেন একই সঙ্গে সেই সময়ের প্রতিভাবান গীতিকবিদের গানও করেছেন। গীতিকবিদের মধ্যে ছিলেন- হেমেন্দ্রকুমার রায়, বাণীকুমার, চণ্ডীদাস, অজয় ভট্টাচার্য, শৈলেন রায়, প্রণব রায় প্রমুখ।
 
অন্যদের মধ্য সুরকার হিসেবে পংকজ কুমার মল্লিক ও রাইচাঁদ বড়ালও ছিলেন, যাদের সুর ও সংগীত পরিচালনায় তিনি কাজ করেছেন। রেকর্ড, নাটক, সিনেমা থেকে কৃষ্ণচন্দ্র বেশ ভালোই আয় করতেন। এই আয়ের একটা বড় অংশ আবার উনি সংগীত শিক্ষার পেছনেই খরচ করতেন। 

শচীন দেব  বর্মণের প্রথম শিক্ষাগুরু ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে। প্রথম শিক্ষাগুরু সম্পর্কে শচীন কর্তা বলেছেন, ‘কেষ্ঠবাবুর শিক্ষাদানের পদ্ধতি ছিল নতুনত্বে ভরপুর। তিনি রেওয়াজের ওপর গুরুত্ব দিতেন। কণ্ঠ নিয়ে বাড়াবাড়ি করা পছন্দ করতেন না। আসলে এই বিষয়ে উনি আমাকে নিষেধই করেছিলেন। বন্ধুদের তিনি আমার নামে বলতেন, ভবিষ্যতে আমি সফল হবোই।’

সন্দেহ নাই শচীনকর্তার কণ্ঠ ও সুরে বাংলা গান তো বটেই, হিন্দি গানও নতুন আলোয় টইটুম্বুর হয়েছে। 

রাগ সংগীত ও আধুনিক গান, দুটোতেই  কৃষ্ণচন্দ্র দে নতুনত্ব এনেছিলেন। পংকজ মল্লিক যথার্থই বলেছেন, ‘সেই যুগের শ্রেষ্ঠ গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে।’ 

চলবে …

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গীতিকবি

তথ্যসূত্র:
‘জীবনের জলসা ঘরে’ মান্না দে
Special article about singer Krishna Chandra Dey.www.anandabazar.com
‘মহাসিন্ধুর ওপার থেকে’ শৌণিক গুপ্ত
‘Incomparable Sachin Dev Burman’ HQ Chowdhury

প্রথম পর্ব: অ্যাঞ্জেলিনা ইয়ার্ড থেকে সুপার স্টার গওহর জান হয়ে ওঠার ইতিহাস

দ্বিতীয় পর্ব: শিল্পীদের আয়ের বিজ্ঞানসম্মত পথ খুলে দেয় গ্রামোফোন

তৃতীয় পর্ব: গান-বাণিজ্যে গওহর জান নায়িকা হলে, লালচাঁদ বড়াল নায়ক

চতুর্থ পর্ব: ‘সেকালের কলকাতার লোকেরা ছিলেন সংগীত-ছুট’

পঞ্চম পর্ব: রেকর্ডিং কোম্পানিগুলোর কাছে যোগ্য সম্মানি পাননি কে. মল্লিক

ষষ্ঠ পর্ব: অমলা দাশের কারণেই অনেক প্রতিভাবান শিল্পী এসেছিলেন

সপ্তম পর্ব: প্রথম রেকর্ড হাতে পেয়ে ইন্দুবালা নিজেই ভেঙে ফেলেন!

অষ্টম পর্ব: টাইটানিক থেকে ঢাকা, রেডিওর গপ্পো