X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১
গানের শিল্পী, গ্রামোফোন, ক্যাসেট ও অন্যান্য: পর্ব আট

টাইটানিক থেকে ঢাকা, রেডিওর গপ্পো 

শহীদ মাহমুদ জঙ্গী
০৪ জুলাই ২০২২, ১৫:২৮আপডেট : ০৪ জুলাই ২০২২, ১৯:৪০

১৯১২ সালে একটি জাহাজ দুর্ঘটনায় প্রায় ১৫০০ যাত্রী মারা যান। ৭০০-এর অধিক যাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। জাহাজের নাম ছিল টাইটানিক। দুর্ঘটনার ৪ দিন পর উদ্ধারকারী জাহাজ তাদের নিয়ে নিউ ইয়র্ক বন্দরে পৌঁছে।

সেদিন গুগলিয়েলমো মার্কোনি প্রবর্তিত রেডিও ব্যবস্থার মাধ্যমে বিপদ বার্তা শুনতে পেয়ে উদ্ধারকারী জাহাজ কার্পেথিয়া ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিল বলেই যাত্রীদের একটি অংশ জীবিত ফিরতে পেরেছিলেন। 

এই রেডিও ব্যবস্থা জাহাজে স্থাপন করেছিলেন প্রকৌশলী জনরুজ স্টেপলটন। তিনি শিক্ষাজীবন শেষ করে ১৯০৩ সালে মার্কোনি কোম্পানিতে কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। তখনকার দিনে জাহাজগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থার কাজ করতো মার্কোনি। ততদিনে মর্স কোডের সাংকেতিক বার্তার পরিবর্তে মানুষের কণ্ঠস্বর সম্প্রচার সক্ষমতা অর্জন করেছে বেতার তরঙ্গ। ১৯২০’র দশক থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রেডিও স্টেশন স্থাপন শুরু হয়েছিল।

মার্কোনি
 
১৯১২ সাল থেকেই কলকাতায় মার্কোনি কোম্পানির অফিস ছিল। ১৯১৮ সালের দিকে ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটের ‘টেম্পল চেম্বার্স’-এ তারা বড় পরিসরে নিজেদের অফিস স্থানান্তরিত করেন। জন স্টেপেলটন মার্কোনি কোম্পানির নতুন কর্মকর্তা হয়ে কলকাতায় আসেন। একই বাড়ির অন্য একটা অংশে স্টেপলটনের পরিবারের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। এবং উনার কণ্ঠে বেতার তরঙ্গে প্রথম সংগীত সম্প্রচারিত হয়। 

১৯২৩ সালে স্টেপলটনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বেঙ্গল রেডিও ক্লাব’। এই সংস্থা সরকারের অস্থায়ী অনুমোদন লাভ করে। এবং মার্কোনি কোম্পানির ছোট একটি ফাইভ এএফ ট্রান্সমিটার ব্যবহার করে ১৯২৩ সালের নভেম্বর মাসে সম্প্রচার শুরু করে ‘বেঙ্গল রেডিও ক্লাব’র সঙ্গে যুক্ত হন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী শিশিরকুমার মিত্র। 

‘আজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও’ কিংবা ‘আমার আঁধার ঘরের প্রদীপ’র মতো জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা গীতিকার, সুরকার, গায়ক ছিলেন হীরেন্দ্রনাথ বসু। তিনি ‘বেঙ্গল রেডিও ক্লাব’র শুরু থেকেই অনুষ্ঠান পরিচালনা ও নির্দেশনার সঙ্গে  যুক্ত ছিলেন। সেই সময় পর্যন্ত বেতার নিয়ে যা কিছু কাজ হয়েছে, বাণিজ্যিক লাভের কথা চিন্তা না করেই হয়েছে। 

বাণিজ্যিকভাবে বেতার ভারতে কতটুকু সম্ভাবনাময় তা খতিয়ে দেখার জন্য ১৯২৬ সালে বিবিসি’র পক্ষ থেকে সি সি ওয়ালিককে কলকাতায় পাঠানো হয়। স্টেপেল চেম্বার্সে বিবিসি’র স্টুডিও প্রতিষ্ঠিত হয়। সার্বিক সহযোগিতায় ছিলেন স্টেপলটন সাহেব। 

১৯২৭ সালে এই স্টুডিওটি ১নং গাস্টির্ন প্লেসে স্থানান্তরিত হয়। এবং ব্যক্তি মালিকানার ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি এটাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেয়। সরকারের সাথে চুক্তি অনুযায়ী বোম্বে ও কলকাতায় দুটি বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারের অধিকার পেয়েছিল এই কোম্পানি।

বোম্বের কেন্দ্র থেকে সম্প্রচার শুরু হয় ২৩ জুলাই ১৯২৭ সালে। সম্প্রচার উদ্বোধন করেন ভারতের সেই সময়ের ভাইসরয় লর্ড আরউইন। ১৯২৭ সালের ২৬ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টায়, বাংলার গভর্নর স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন কলকাতা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানিক সম্প্রচার উদ্বোধন করেন। 

নলিনীকান্ত সরকারের ‘আসা যাওয়ার মাঝখানে’ স্মৃতি গ্রন্থ থেকে জানা যায়, প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে ছিলেন সংগীতশিল্পী কৃষ্ণচন্দ্র দে, আঙ্গুর বালা, প্রফুল্ল বালা, সিতাংসুজ্যোতি মজুমদার,বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ রাইচাঁদ বড়াল প্রমুখ।

ব্যক্তিমালিকানায় বেতার সম্প্রচার বিভিন্ন কারণে সুবিধা করতে পারছিল না। বিশেষ করে আর্থিক সংকটের কারণে তাদের টিকে থাকা নিয়েই সংশয় দেখা দেয়। সরকার বেতার সম্প্রচার নিজ আওতায় নিয়ে নেয়। 

১৯৩২ সালের মে মাস থেকে বেতার সম্প্রচার সম্পূর্ণভাবে সরকারি পরিচালনায় নিয়ে আসা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের খবর এবং জনমত পক্ষে ধরে রাখার জন্য ব্রিটিশ সরকার অল ইন্ডিয়া রেডিও’র আওতায় ভারতে নতুন ছয়টি বেতারকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। 

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার নাজিম উদ্দীন রোডে একটি ভাড়া বাসায় বাংলাদেশের প্রথম বেতার কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়। শিল্পী লায়লা আরজুমান্দ বানু  প্রথম দিনেই সংগীত পরিবেশন করেন। পাকিস্তান আমলে ‘রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা’ এই নামে পরিচিত ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশ বেতার ঢাকা’ নামে এই কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ নামে  অস্থায়ী সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে যুদ্ধ সহায়ক অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হতো।

আমরা তখন স্কুলে। চট্টগ্রামে। প্রায় সব মধ্যবিত্ত পরিবারে তখন রেডিও অথবা ব্যাটারি চালিত ট্রানজিস্টার ছিল। জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল নাটক ও গানের অনুষ্ঠান অনুরোধের আসর। ইতোমধ্যে বেশ কিছু আঞ্চলিক সম্প্রচার কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। ঢাকা বেতার কেন্দ্র জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল।

আঞ্চলিক বেতার কেন্দ্রগুলো ঢাকার অনুষ্ঠান রিলে করা ছাড়াও নিজস্ব অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতো। স্থানীয় শিল্পীদের চেনাজানার একটা বড় উপায় ছিল আঞ্চলিক বেতার সম্প্রচার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান। যেমন, চট্টগ্রাম বেতার প্রচারিত গানের অনুষ্ঠানে ঘোষক-ঘোষিকার কণ্ঠে মাঝে মাঝে দুটি নাম শুনতে পেতাম। নাম দুটি এভাবে আসতো- ‘আপনারা শুনছেন আধুনিক বাংলা গান। এবারের গানটি লিখেছেন হেনা ইসলাম, সুর করেছেন জিলু খান আর গানটি গেয়েছেন …।’

আমি ধরেই নিয়েছিলাম হেনা ইসলাম কোন মহিলা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নিজে যখন গান লিখছি তখন হেনা ইসলামের সাথে পরিচয় হয়। দেখলাম, হেনা ইসলাম কোনও মহিলা নয়, তিনি চমৎকার একজন পুরুষ। আর জিলু খান অসাধারণ একজন সুরকার। যিনি ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ গানটির সুর করেছেন। সুরে তার সঙ্গে ছিলেন তারই ছোট ভাই প্রখ্যাত সুরকার-গায়ক নকীব খান। গানটি লিখেছেনও নকীব খান। এভাবেই রেডিও’র মাধ্যমে অনেক কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার ও সুরকারের ক্যারিয়ার শুরু হয়েছে। বেতারকেন্দ্রগুলো ধীরে ধীরে বাণিজ্যিকভাবেও সফল হতে শুরু করে। 

রেডিও’র অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে শিল্পী ও অন্যরা আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন দুইভাবে। প্রথমত, বেতার কর্তৃপক্ষ কম-বেশি সম্মানি দেন। দ্বিতীয়ত, রেডিওর মাধ্যমে পরিচিতি লাভ বা শ্রোতাপ্রিয় হলে, বিভিন্ন ঘরোয়া অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে সভা-সমাবেশে শিল্পীরা গান গাওয়ার ডাক পেতেন। সেই সুবাদে তাদের আয়ের ক্ষেত্র বিস্তৃত হতো। একই সাথে বাদ্যযন্ত্রীদের আয়ও বাড়তো। 

১৯২৮ সালের দিকে শচীনদেব বর্মণ তার নিজের কম্পোজ করা দুটি গান রেডিও তে গেয়েছিলেন। সম্মানি হিসেবে ১০ রুপি পেয়েছিলেন। 

প্রখ্যাত শিল্পী ও সুরকার পংকজ কুমার মল্লিক রেডিওর কলকাতা কেন্দ্রের সংগীতশিল্পী ও সংগীত পরিচালক হিসাবে প্রায় ৫০ বছর কাজ করেন। রাইচাঁদ বড়াল সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে প্রসিদ্ধ  ছিলেন। তিনি সংগীত বিভাগের প্রয়োজক ছিলেন। একইভাবে কৃষ্ণচন্দ্র, আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, শচীন দেব বর্মণ থেকে শুরু করে পরবর্তী জেনারেশনের প্রায় সব শিল্পীই বেতারে কম-বেশি গান করেছেন। 

চলবে…

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গীতিকবি

তথ্যসূত্র:
Incomparable Sachin Dev Burman by
HQ Chowdhury 
History of all India Radio 
Davuniversity.org
কলকাতার প্রথম বেতার সম্প্রচার তার হাত ধরেই
অমিতাভ পুরকায়স্থ

প্রথম পর্ব: অ্যাঞ্জেলিনা ইয়ার্ড থেকে সুপার স্টার গওহর জান হয়ে ওঠার ইতিহাস

দ্বিতীয় পর্ব: শিল্পীদের আয়ের বিজ্ঞানসম্মত পথ খুলে দেয় গ্রামোফোন

তৃতীয় পর্ব: গান-বাণিজ্যে গওহর জান নায়িকা হলে, লালচাঁদ বড়াল নায়ক

চতুর্থ পর্ব: ‘সেকালের কলকাতার লোকেরা ছিলেন সংগীত-ছুট’

পঞ্চম পর্ব: রেকর্ডিং কোম্পানিগুলোর কাছে যোগ্য সম্মানি পাননি কে. মল্লিক

ষষ্ঠ পর্ব: অমলা দাশের কারণেই অনেক প্রতিভাবান শিল্পী এসেছিলেন

সপ্তম পর্ব: প্রথম রেকর্ড হাতে পেয়ে ইন্দুবালা নিজেই ভেঙে ফেলেন!

/এম/এমওএফ/
সম্পর্কিত
‘পদ্মশ্রী’ প্রাপ্তিতে সংগীত ঐক্যর পক্ষ থেকে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে ফুলেল শুভেচ্ছা
‘পদ্মশ্রী’ প্রাপ্তিতে সংগীত ঐক্যর পক্ষ থেকে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে ফুলেল শুভেচ্ছা
৫০-এ সোলস: ব্যান্ডের লোগো নির্বাচন ও গান লিখতে পারবেন আপনিও
৫০-এ সোলস: ব্যান্ডের লোগো নির্বাচন ও গান লিখতে পারবেন আপনিও
রবীন্দ্রনাথের সকল গানের ভাণ্ডারি দিনেন্দ্রনাথ
গানের শিল্পী, গ্রামোফোন, ক্যাসেট ও অন্যান্য: পর্ব ১৬রবীন্দ্রনাথের সকল গানের ভাণ্ডারি দিনেন্দ্রনাথ
নজরুল-আব্বাসউদ্দীন: ইসলামি গান সৃষ্টি ও জনপ্রিয়তার নেপথ্য গল্প
গানের শিল্পী, গ্রামোফোন, ক্যাসেট ও অন্যান্য: পর্ব ১৫ (গ)নজরুল-আব্বাসউদ্দীন: ইসলামি গান সৃষ্টি ও জনপ্রিয়তার নেপথ্য গল্প
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
কান উৎসব ২০২৪১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
এই জন্মদিনে আরেক সিনেমার ঘোষণা
এই জন্মদিনে আরেক সিনেমার ঘোষণা
ভোট দিতে এসে কেউ উৎফুল্ল, অনেকেই ক্ষুব্ধ!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনভোট দিতে এসে কেউ উৎফুল্ল, অনেকেই ক্ষুব্ধ!