আন্তর্জাতিক বাজারে গত তিন বছরে জ্বালানি, খাদ্যশস্য, ভোজ্যতেল ও সারের মতো প্রধান ভোগ্যপণ্যের দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশে সেই মূল্য হ্রাসের প্রতিফলন তেমন দেখা যায়নি। বিশ্ববাজারে পণ্যদামের পতন সত্ত্বেও দেশের বাজারে অনেক পণ্যের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে, আবার কিছু ক্ষেত্রে বেড়েছেও।
২০২২ সালের প্রথমার্ধে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে আন্তর্জাতিক বাজারে যে পণ্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি শুরু হয়েছিল, তা এখন স্পষ্টভাবে নিম্নমুখী ধারায় প্রবেশ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে সেই অনুপাতে দাম কমেনি। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ‘কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক’ অনুযায়ী, ২০২৫ সালে গড়ে পণ্যমূল্য ১২ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে আরও ৫ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। অনেকেরই প্রশ্ন, এ বৈশ্বিক প্রবণতা বাংলাদেশের ভোক্তা ও নীতিনির্ধারকদের জন্য কতটা ইতিবাচক? কারণ, দেশের বাজারে এর প্রতিফলন হচ্ছে ধীরে ও খণ্ডিতভাবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিশ্ববাজারে মূল্যহ্রাস নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য একটি স্বস্তির সুযোগ তৈরি করেছে। কিন্তু এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনায় সংস্কার আনতে হবে। সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে।
বিশ্ববাজারে এখন পাম অয়েল, গম, চিনি, ইউরিয়া সার, এলএনজি ও জ্বালানি তেলের দাম নিম্নমুখী। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক মূল্য ব্যারেলপ্রতি ৭০.৭০ ডলার থেকে কমে ৬৫.৯০ ডলারে নেমেছে। গমের দাম কমে দাঁড়িয়েছে টনপ্রতি ২১৯.৬০ ডলার, ইউরিয়া সার ৩৮৬.৯০ ডলার এবং পাম অয়েল ৯৯৪ ডলারে।
গত ২ মে প্রকাশিত ‘কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক’ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে বেশিরভাগ জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম কমেছে। তবে কিছু কৃষিপণ্যে উল্টো ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা গেছে।
কমেছে সয়াবিন, চাল ও গমের দাম
বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, কৃষিপণ্যের মধ্যে কোকো ও কফির দামে বড় উল্লম্ফন হলেও চাল, গম, চা ও সয়াবিনের দাম কমেছে। কোকোর দাম দ্বিগুণ বেড়ে প্রতি কেজি ৮ দশমিক ১৫ ডলার দাঁড়িয়েছে। রোবাস্তা কফির দামও বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৪৩ ডলার।
বাংলাদেশের বাজারে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে এমন পণ্য—চাল ও গমের দামও কমতির দিকে। থাইল্যান্ডের ৫ শতাংশ ভাঙা চালের দাম এপ্রিল মাসে প্রতি টন ৪১৫ ডলারে নেমে এসেছে, যেখানে ২০২৪ সালে গড় মূল্য ছিল ৫৮৮ ডলার। হার্ড রেড উইন্টার গমের দাম কমে এপ্রিল মাসে দাঁড়িয়েছে ২৪৯ দশমিক ৬ ডলার প্রতি টন, যা আগের বছরের প্রথম প্রান্তিকে ছিল ২৬৮ দশমিক ৭ ডলার।
তেলজাতীয় পণ্যের বাজার স্থিতিশীল
তেলজাতীয় কৃষিপণ্যের মধ্যে সয়াবিন তেলের গড় দাম ছিল ১০১১ ডলার প্রতি টন, নারকেল তেলের দাম ২৪৮৩ ডলার। উভয় পণ্যের দাম গত মাসের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। তবে সয়াবিনের দাম কমে এপ্রিল মাসে দাঁড়ায় মাত্র ৪০৭ ডলার প্রতি টনে।
বিশ্বব্যাংক বলছে, চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সরবরাহ চেইনের অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে এ মূল্যপ্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, খাদ্যপণ্যের বাজারে চলতি বছরের শেষার্ধে কিছুটা স্থিতিশীলতা এলেও জ্বালানি খাতে মন্দার ধারা অব্যাহত থাকতে পারে।
জ্বালানির দামে মিশ্র প্রবণতা
জ্বালানি খাতে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো কয়লার দাম হ্রাস। ২০২৫ সালের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে অস্ট্রেলিয়ান কয়লার গড় মূল্য দাঁড়ায় প্রতি মেট্রিক টন ৯৮ দশমিক ৬ ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২২ শতাংশ কম। দক্ষিণ আফ্রিকার কয়লার দামও কমে হয়েছে ৯৫ দশমিক ৬ ডলার।
অপরদিকে, গ্যাসের দামে কিছুটা বৃদ্ধি লক্ষ করা গেছে। ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাসের গড় মূল্য দাঁড়িয়েছে প্রতি মিলিয়ন বিএইচইউ ১১ দশমিক ৫৯ ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় সামান্য বেশি। তবে জাপানে এলএনজি গ্যাসের দাম কিছুটা কমে এসেছে ১২ দশমিক ৪৩ ডলারে।
তেলের বাজারেও দরপতন স্পষ্ট। ব্রেন্ট ক্রুডের দাম মার্চে কমে দাঁড়ায় ৬৭ দশমিক ৭ ডলার/ব্যারেল, যা জানুয়ারিতে ছিল ৭৫ দশমিক ৬ ডলার। ডব্লিউটিআই তেলের দাম একই সময়ে কমে ৬৩ দশমিক ১ ডলারে দাঁড়ায়।
বিশ্ববাজার বনাম বাংলাদেশের বাস্তবতা
বাংলাদেশ মূলত আমদানিনির্ভর একটি অর্থনীতি। জ্বালানি, ভোজ্যতেল, গম, চিনি, তুলা, সার—সবই বিপুল পরিমাণে আমদানি করতে হয়। কাজেই আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার ঘটনা দেশের জন্য স্বস্তিদায়ক হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পণ্যের দাম বিশ্ববাজারে বাড়লে তা দেশে তাৎক্ষণিকভাবে বাড়ানো হলেও দাম কমার প্রভাব স্থানীয় বাজারে পড়ে অনেক ধীরগতিতে, কখনও কখনও পড়েও না। এর পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে—পর্যাপ্ত আমদানি না হওয়া, ব্যাংক ঋণপত্র (এলসি) জটিলতা, ডলার সংকট, সরবরাহ চেইনের দুর্বলতা এবং কিছু ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের একচেটিয়া মুনাফার প্রবণতা।
পণ্যের দাম না কমার পেছনে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকেই দায়ী করেছেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘যেদিকে তাকাই, দেখি ব্যবসায়ীদের কোনও না কোনও সিন্ডিকেট সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। বাজার ব্যবস্থায় কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে না পারার অন্যতম কারণ হলো—ব্যবসায়ী মহলের অনেকেই নিজেদের স্বার্থে সরকারের সঙ্গে গোপনে সমঝোতায় যাচ্ছেন।’
সম্প্রতি রাজধানীর বনানীর একটি হোটেলে আয়োজিত ‘বাংলাদেশ ২০৩০: অংশীদারত্বমূলক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে’ শীর্ষক বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন।
খুচরা বাজারে প্রতিফলন
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ কিংবা ঢাকার কাওরান বাজারের মতো পাইকারি বাজারে ইতোমধ্যে কিছু পণ্যের—বিশেষত ভোজ্যতেল, চিনি ও গমের দামে হ্রাসের প্রবণতা দেখা গেছে। কিন্তু খুচরা বাজারে এখনও সেই প্রভাব পুরোপুরি পৌঁছায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে দেশের আমদানি খাতে পণ্যগুলোর ব্যয় ছিল যথাক্রমে— গমে ১১৮ কোটি ডলার, ভোজ্যতেলে ২০৬ কোটি, চিনি ৮৬ কোটি, জ্বালানিতে ৪০৯ কোটি, তুলায় ২৬২ কোটি এবং সার আমদানিতে ২২৫ কোটি ডলার। তবু বাজারে দাম কমার গতি তুলনামূলক ধীর।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের তুলনায় বেশিরভাগ পণ্যের আন্তর্জাতিক মূল্য প্রায় ২০ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশে পণ্যের দাম কমেছে খুব সীমিত পরিসরে, কিছু ক্ষেত্রে আবার উল্টো বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ প্রসঙ্গে রাজধানীর মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কিছুটা কমলেও দেশের বাজারে এর তাৎক্ষণিক সুফল মিলছে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে ডলারের মূল্য দেশে এখনও উল্লেখযোগ্য হারে কমেনি। ফলে আমদানিকারকরা ব্যয় কমাতে পারছেন না।’ তবে তিনি আশা প্রকাশ করেন, অদূর ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজারের এ পরিবর্তনের ইতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে।
তিনি বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রশমিত হওয়ার ইঙ্গিত ও মার্কিন নির্বাচনের পর সংকট কমায় পণ্যমূল্য স্থিতিশীল হতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের বাজারও এর সুফল পাবে।’
অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করছেন, আন্তর্জাতিক বাজার স্থিতিশীল হলেও দেশের উৎপাদন ও পরিবহন খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। এই ব্যয় হ্রাস করতে হলে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ডিজেলের মূল্য কমানো দরকার, যা সরকারের পক্ষে বাস্তবায়ন করা বর্তমানে কঠিন।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমলেও দেশের বাজারে এর খুব বেশি প্রভাব পড়ছে না। কারণ, আমদানি হওয়া পণ্য যখন বাজারে আসে, তখন মধ্যস্বত্বভোগীরা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ফলে আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণ যতটা জরুরি, তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনায় কার্যকর হস্তক্ষেপ।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য কমায় বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ কিছুটা কমার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে বাস্তবায়নের জন্য দরকার সরকারি মনিটরিং, বাজার ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা এবং ডলার সরবরাহে ধারাবাহিকতা। নীতিনির্ধারকরা যদি এসব নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে ভোক্তারা শিগগিরই স্বস্তির প্রতিফলন দেখতে পাবেন।’
আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশে তার সুফল মিলছে না, বরং বেশ কয়েকটি কারণে দেশে পণ্যের দাম উল্টো বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, বর্তমানে দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ৯ শতাংশ, যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত উচ্চমাত্রার।
তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কারোপ-সংক্রান্ত উত্তেজনার মধ্যেও আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও পণ্যের দাম কমতির দিকে, যা বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাব্য সুফল বয়ে আনতে পারে। তবে এই সুবিধা কাজে লাগাতে হলে আমাদের মুদ্রাবাজার ও আমদানি ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে শুল্ক ছাড়ের সুবিধা যেন প্রকৃত অর্থে ভোক্তারা পান, তা নিশ্চিত করতে হবে। যাতে ব্যবসায়ীরা এই সুবিধা নিজেরা ভোগ করে বাজারে মূল্য বাড়িয়ে দিতে না পারেন, সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।’
জাহিদ হোসেন মনে করেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক বাজারের দামের পরিবর্তনের প্রতিফলন ঘটাতে হলে শুধু বিশ্ববাজার পর্যবেক্ষণ নয়, বরং দেশের বাজার ব্যবস্থাপনাকে সুশৃঙ্খল ও জবাবদিহিমূলক করাও জরুরি।
রিজার্ভ, ডলার ও আমদানি নীতির প্রভাব
আইএমএফের কিস্তি ছাড়, রিজার্ভে ইতিবাচক প্রবণতা এবং ডলার বাজারে সরবরাহ কিছুটা বেড়ে যাওয়ার কারণে সরকার আমদানিতে আরোপিত বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা শিথিল করছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যাংকগুলোর সহযোগিতা বাড়লে এবং ঋণপত্র খোলার প্রক্রিয়া সহজ হলে তারা আগের চেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করতে পারবেন। এর প্রভাবে সরবরাহ বাড়বে এবং বাজার স্থিতিশীল হবে।
উৎপাদন খাতে স্বস্তি, কৃষি ও প্রক্রিয়াজাতে সম্ভাবনা
দেশে চলতি মৌসুমে কোনও বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়ায় কৃষি উৎপাদন স্থিতিশীল ছিল। ফলে বিশ্ববাজারে সারের দাম কমার সঙ্গে মিল রেখে কৃষি খাতে উৎপাদন ব্যয়ও কমতে শুরু করেছে। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে খাদ্যপণ্যের প্রক্রিয়াজাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।