২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সরকার আয়করের ক্ষেত্রে ১২টি এসআরও (স্ট্যাচুটোরি রেগুলেটরি অর্ডারস) বাতিল করেছে। এসব এসআরও-এর মাধ্যমে বিভিন্ন খাতে কর ছাড় বা কর অব্যাহতির সুবিধা দেওয়া হতো। এবার এসব সুবিধা বাতিল করে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো এবং কর ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ ও কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার (১০ জুন) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, গত ২ জুন বাতিলকৃত এসআরওগুলোর মধ্যে রয়েছে— কৃষি, মৎস্য, সঞ্চয়পত্র, দানশীল প্রতিষ্ঠান, জ্বালানি খাতসহ বিভিন্ন খাতের কর ছাড়। দীর্ঘদিন ধরে এসব সুবিধার অপব্যবহার ও রাজস্ব ক্ষতির কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পদক্ষেপের পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা আইএমএফের চাপ এবং দেশের আর্থিক ব্যবস্থার টেকসই উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা। কর ছাড়ের সুযোগ বন্ধ করে সরকার বাজেট ঘাটতি কমাতে চাইছে।
এক নম্বর এসআরও ছিল ২০০৯ সালে জারি করা, যেখানে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কর ছাড় দেওয়া হতো। এছাড়া, কৃষি ও পশুপালন খাতে কর ছাড়ের বেশ কয়েকটি এসআরও রয়েছে, যেগুলো গত কয়েক বছরে অপব্যবহারের অভিযোগে বাতিল করা হয়েছে।
সরকারি কর নীতি বিশ্লেষকদের মতে, এসআরও বাতিলের ফলে রাজস্ব আয় বাড়বে এবং কর ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আসবে। তবে কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ওপর এর প্রভাব কেমন হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাতিলকৃত এসআরওয়ের কারণে দেশের রাজস্ব আয় বছরে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া, করফাঁকি ও অনিয়মের সুযোগও কমবে।
রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জানিয়েছে, আগামীতে কর সংগ্রহে আরও আধুনিকায়ন ও কঠোরতা আনা হবে, যাতে কর প্রদায়নের হার বৃদ্ধি পায়।
বিশ্লেষকদের মতে, এই পদক্ষেপ দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে এবং বাজেটের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়তা করবে।
নিচে প্রতিটি এসআরও এবং তার মূল সুবিধাসমূহ সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
১. এসআরও-৩৩/২০০৯ (৯ মার্চ ২০০৯)
সুবিধা: তিনটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে (বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট, আরসিএইচ, এসএফডি হাসপাতাল) দান করমুক্ত। বাতিলের কারণ: বিতর্কিত ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা।
২. এসআরও-৩৯৩/২০১৩ (২ জানুয়ারি ২০১৩)
সুবিধা: ‘ঢাকা স্কুল অব ইকোনোমিকস ফাউন্ডেশন’-এ দান করমুক্ত। বাতিলের কারণ: জনহিতকর দানের অপব্যবহার ও কর ফাঁকির অভিযোগ।
৩. এসআরও-১৯৯/২০১৫ (১ জুলাই ২০১৫)
সুবিধা: কৃষি, হাঁস-মুরগি, মাছ, ফুল, রেশম, মাশরুমসহ ১২+ খাতে আয়ের ওপর কর হ্রাস (৩%-১৫%)। বাতিল কারণ: দীর্ঘমেয়াদে বহাল থাকায় রাজস্ব ক্ষতি; নিয়ন্ত্রণহীন ছাড়।
৪. এসআরও-২৫৫/২০১৫(১৮ আগস্ট ২০১৫)
সুবিধা: মৎস্য, পোলট্রি, হ্যাচারির আয়ে করছাড় (প্রথম ১০ লাখ টাকায় শূন্য কর)। বাতিলের কারণ: কালো টাকা সাদা করার অভিযোগ, অপব্যবহার, এনবিআরের আপত্তি।
৫. এসআরও-১৩২/২০১৮ (১৩ মে ২০১৮)
সুবিধা: প্রাকৃতিক গ্যাসে কর অব্যাহতি। বাতিলের কারণ: জ্বালানি খাতে রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর প্রয়াস।
৬. এসআরও-২৭/২০১৯ (৩১ জানুয়ারি ২০১৯)
সুবিধা: ‘গফুর মরিয়ম সাত্তার সাকেরা ফাউন্ডেশন’-এ দান করমুক্ত। বাতিলেল কারণ: জনহিতকর খাতে কর ছাড়ের সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণ না থাকায় অপব্যবহার।
৭. এসআরও-১৫৭/২০২২ (১ জুন ২০২২)
সুবিধা: হাঁস-মুরগি ও মাছ চাষের আয় ধাপে ধাপে করছাড় (শূন্য থেকে ১৫ শতাংশ)। বাতিলের কারণ: আগের ছাড়ের পুনরাবৃত্তি ও অপব্যবহারের আশঙ্কা।
৮. এসআরও-২৫৩/২০২৩ (২৩ আগস্ট ২০২৩)
সুবিধা: সঞ্চয়পত্র, সঞ্চয়ী আমানত, রফতানিভিত্তিক নগদ সহায়তার ওপর উৎসে করই চূড়ান্ত। অতিরিক্ত করদায় থেকে অব্যাহতি। বাতিলের কারণ: উচ্চ আয়ের করদাতাদের করফাঁকির সুযোগ।
৯. এসআরও-২৮৬/২০২৩ (১১ অক্টোবর ২০২৩)
সুবিধা: সম্পত্তি হস্তান্তরে উৎসে কর চূড়ান্ত, বাড়তি করের দায় নেই। বাতিলের কারণ: চূড়ান্ত করদায়ের ছত্রছায়ায় মূলধনি আয়ের কর ফাঁকি।
১০. এসআরও-৩৮২/২০২৪ (৩ নভেম্বর ২০২৪)
সুবিধা: সিদ্ধ ও নন-সিদ্ধ চাল আমদানিতে কর অব্যাহতি। বাতিলের কারণ: আমদানি ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় স্থানীয় কৃষকের ক্ষতি।
১১. এসআরও-৩৮৩/২০২৪ (৪ নভেম্বর ২০২৪)
সুবিধা: আইনের সপ্তম তফসিল সংশোধন করে বিশেষ করহার প্রণয়ন, যা অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগে কর সুবিধা দিতো। বাতিলের কারণ: অপ্রদর্শিত আয়ের বৈধতা প্রদান নিয়ে সমালোচনা।
১২. (অপ্রকাশিত এসআরও)
উল্লেখযোগ্য হলেও রিপোর্টে ১২ নম্বরটি পরিষ্কারভাবে আলাদা করা হয়নি। সম্ভাব্য এসআরও-৩৪১-এর সংশোধন বা পূর্ববর্তী কোনও এসআরও।
প্রসঙ্গত, এই ১২টি এসআরও বাতিলের মাধ্যমে কৃষি, পোলট্রি, মৎস্য, জনহিতকর দান, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা, সম্পত্তি হস্তান্তর, ও গ্যাস আমদানির করছাড় বন্ধ হলো। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ এবং রাজস্ব ঘাটতি কমানো ও স্বচ্ছতা বাড়ানো এই সিদ্ধান্তের মূল কারণ।