দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের অঙ্ক ভয়াবহভাবে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকায়, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। রবিবার (১৫ জুন) বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর খেলাপি ঋণের ‘আসল চিত্র’ প্রকাশ পেতে শুরু করে। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ শ্রেণিকরণ ও আদায় ব্যবস্থায় কড়াকড়ি আরোপ করলে সেই চিত্র সামনে আসে।
তিন মাসেই বেড়েছে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ মাসের শেষে ব্যাংক খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। এর বিপরীতে খেলাপি ঋণের অঙ্ক ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা—তিন মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা।
রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকে বিপর্যয়
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৪৫.৭৯ শতাংশ, যেখানে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে এই হার ছিল ৪২.৮৩ শতাংশ। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০.১৬ শতাংশ, যা আগে ছিল ১৫.৬০ শতাংশ।
পুরনো সরকারের ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীর ঋণ এখন খেলাপি
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ও ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ব্যাংক থেকে বিপুল ঋণ নিয়েছে, যার বড় অংশই এখন খেলাপি হয়েছে। বিশেষ করে ইসলামী ধারার পাঁচ ব্যাংক— ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক—এসব গ্রুপের অধীনে থাকার সময় ঋণ অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণ হয়েছে বলে উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, “খেলাপি ঋণের কোনও তথ্য গোপন করা হবে না। এখন থেকেই জোরালো আদায় কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। পাশাপাশি নতুন ঋণ যেন খেলাপিতে পরিণত না হয়, সে জন্য কড়াকড়ি আইন এবং নজরদারি আরোপ করা হয়েছে।”
রাজনৈতিক পরিবর্তনেই প্রকৃত চিত্র
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার সময় দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। গত ১৫ বছরে এটি প্রায় ১৮ গুণ বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, এ ঋণের বড় অংশই ‘নেম-লোন’, যেটি নামে থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তা ছিল রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় সুবিধাভোগের কৌশল।
গত সরকারের সময় বারবার খেলাপিদের সুবিধা দিতে নিয়ম-কানুন শিথিল করা হয়েছিল। যেমন- ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ, নামমাত্র কিস্তিতে ঋণ হালনাগাদ দেখানো ইত্যাদি। এসব বন্ধ হতেই প্রকৃত খেলাপিরা ধরা পড়ছে।
‘একীভূতকরণে’ সমাধান খোঁজার চেষ্টা
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, ইসলামী ধারার যেসব ব্যাংকে খেলাপির হার অতিমাত্রায় বেড়েছে, সেগুলোকে একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে দায়-দায়িত্ব ভাগ করে ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে আনার পরিকল্পনা চলছে।
সামনের দিন আরও কঠিন?
বিশ্লেষকরা মনে করেন, খেলাপি ঋণের এই ‘নতুন চিত্র’ আসলে দীর্ঘদিনের গোপন সংকটের প্রকাশমাত্র। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়াকড়ি, নীতিগত স্বচ্ছতা ও আদালতের সহযোগিতা ছাড়া এই প্রবণতা থামানো সম্ভব নয়। পাশাপাশি প্রভাবশালীদের দায়মুক্তির সংস্কৃতি ভাঙা না গেলে ভবিষ্যতে ব্যাংক খাত আরও গভীর সংকটে পড়বে।