X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ

মো. সামসুল ইসলাম
১৩ অক্টোবর ২০১৮, ১৪:০০আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০১৮, ১৪:০৬

মো. সামসুল ইসলাম বিদেশে বাংলাদেশের ইমেজ নিয়ে মাঝে মাঝেই মিডিয়ায় প্রবাসীদের বিভিন্ন কথাবার্তা শুনি বা দেখি। অনেকে বিদেশে বাংলাদেশের ইমেজে সংকটের কথা বলেন আবার কেউ বা বাঙালির বিভিন্ন কৃতিত্বের কথা উল্লেখ করে দেশকে নিয়ে গর্বের কথাও জানান। 
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকরা বিদেশে একটি রাষ্ট্রের ইমেজকে সবিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ইদানীং তারা এক্ষেত্রে ‘সফট পাওয়ার’ নামে একটি পরিভাষা বেশিমাত্রায় ব্যবহার করেন। সোজা ভাষায় এটি হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের ইমেজ, মূল্যবোধ বা সংস্কৃতির মাধ্যমে অন্য রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা। ‘হার্ড পাওয়ার’ বা সামরিক সক্ষমতার সাথে সাথে ‘সফট পাওয়ারের’ গুরুত্ব কিন্তু বৈদেশিক নীতিতে কম নয়।
হঠাৎ করে বিদেশে বাংলাদেশের ইমেজ নিয়ে আলোচনা করছি এইজন্য যে অতি সম্প্রতি আমাদের দেশের মিডিয়ায় বাংলাদেশের ইমেজ সম্পর্কিত দুটো খবর প্রকাশিত হয়েছে। যার একটি নেতিবাচক ও অপরটি ইতিবাচক।

নেতিবাচকটি হচ্ছে বৈশ্বিক পাসপোর্টের র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ পাঁচ ধাপ পিছিয়েছে। গত বছর বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯৫তম অবস্থান যা ২০১৮ সালে হয়েছে ১০০ তম। যুক্তরাষ্ট্রের হেনলি অ্যান্ড পার্টনারস সংস্থাটি ভিসা ছাড়া শুধু পাসপোর্ট দিয়ে বিদেশে যাওয়ার জরিপের মাধ্যমে এ র‍্যাংকিং করেছে। বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে ভিসা ছাড়া বিশ্বের ৪১টি দেশে ভ্রমণ সম্ভব। অপরদিকে র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষে অবস্থানকারী সবচেয়ে শক্তিশালী পাসপোর্ট হচ্ছে জাপানের, যে দেশের পাসপোর্ট নিয়ে ভিসা ছাড়া বিশ্বের ১৯০টি দেশে যাওয়া সম্ভব।  

আর ইতিবাচক সংবাদটি হলো বিশ্বব্যাংকের করা বৈশ্বিক মানবসম্পদ সূচক বা হিউম্যান ক্যাপিটাল ইনডেক্সে ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংকের ১৫৭টি সদস্য রাষ্ট্রের ওপর জরিপ করে এই তালিকাটি করা হয়েছে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হার, তাদের স্কুলে যাওয়ার গড় সময়, টিকে থাকার হার ইত্যাদি মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে করা সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রীলঙ্কা ও নেপালের পর ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।

ইতিবাচক বা নেতিবাচক যাই বলা হোক না, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে একসময়ের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ অভিধা থেকে বাংলাদেশ অনেক আগেই বেরিয়ে এসেছে। বিদেশে বাংলাদেশিদের আর এরকম প্রশ্ন শুনতে হয় না যে ‘তোমাদের দেশে কি ইলেকট্রিসিটি আছে?’ এ মাসেই  HSBC Global Research প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর ৪২তম বৃহত্তম অর্থনীতি, যা ২০৩০ সালে হবে পৃথিবীর ২৬তম বৃহত্তম অর্থনীতি। বাংলাদেশের পেশাজীবীরা এখন যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন।

পোশাক শিল্প, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে অংশগ্রহণ, বিভিন্ন দেশের মূলধারার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, ক্রিকেটসহ খেলাধুলায় উন্নতি ইত্যাদির মাধ্যমে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ এখন মোটেই খারাপ নয়।

তবে এটা অস্বীকার করা যাবে না যে সাম্প্রতিক কালে মিয়ানমার হতে বিতাড়িত লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে আশ্রয়দান বিদেশে বাংলাদেশের, সেইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি ব্যাপকমাত্রায় বৃদ্ধি করেছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যা আর স্বল্পসম্পদ সত্ত্বেও গতবছর থেকে নতুন করে আরও প্রায় ৭ লক্ষের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বজনমতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বাংলাদেশে অবস্থিত রোহিঙ্গাদের ইস্যুটি এখন বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম ফোকাল পয়েন্টে পরিণত হয়েছে।  

কিন্তু রাষ্ট্রের ইমেজ বৃদ্ধি বা রক্ষা একটি চলমান প্রক্রিয়া যেখানে সরকারসহ দেশি বা প্রবাসী সব নাগরিকেরই দায়িত্ব রয়েছে। একটি রাষ্ট্র সামরিক ভাবে শক্তিশালী হলেও তার ইমেজ সংকট থাকতে পারে। যেমন, ২০১৮ সালের সফট পাওয়ার র‍্যাংকিং এ যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ৪, অপরদিকে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটেনের অবস্থান এক নম্বরে। বোঝাই যায় ব্রিটিশ কাউন্সিল, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস বা ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ ইত্যাদির কারণে পৃথিবীব্যাপী ব্রিটেনের ইমেজ এখন যথেষ্ট উজ্জ্বল। অপরদিকে এতদিনের পররাষ্ট্রনীতির মূল্যবোধ থেকে সরে এসে America First নীতি বা বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি অক্ষুণ্ণ থাকলেও তারা আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে। আর সফট পাওয়ারের এ র‍্যাংকিংটি করেছে যুক্তরাষ্ট্রেরই একটি সংস্থা ও একটি বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে।        

আমরা চাইবো বাংলাদেশ অন্যদেশে তার public diplomacy প্রচেষ্টা বাড়ানোর মাধ্যমে দেশের সফট পাওয়ারের আরও উন্নয়ন ঘটাবে। সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ও শিক্ষা বিনিময় এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে বিদেশি শিক্ষার্থীরা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে আসবেন এবং দেশে ফিরে গিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করবেন– এটাতো আমাদের এক্ষেত্রে একটি অন্যতম প্রথম কৌশল হওয়া উচিত।

কিন্তু গতবছরে প্রকাশিত ইউজিসি রিপোর্ট অনুসারে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি ছাত্রের সংখ্যা কমছে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাড়লেও আমার কাছে পুরো সংখ্যা মোটেই আশানুরুপ মনে হয়নি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আন্তর্জাতিকীকরণের ক্ষেত্রে আরও প্রচেষ্টা নেওয়া উচিত– আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষ শিক্ষকের কিন্তু অভাব নেই।

দেশের ইমেজ বৃদ্ধিতে প্রবাসীদের ভূমিকা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। ইদানীং যুক্তরাজ্য, কানাডা প্রভৃতি দেশের মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রাজনীতিবিদদের অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে। এ সংখ্যা আরও বাড়ানো উচিত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিরা যদি সেসব দেশে নিজেদের দেশের দলাদলি পরিহার করে ঐক্যবদ্ধভাবে সেই সব দেশের রাজনীতিতে অংশ নেন তাহলে তা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়াতে সহায়ক হতে পারে।

একই কথা বলা যেতে পারে বিভিন্ন দেশের মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় কাজ করার ক্ষেত্রে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা প্রভৃতি দেশের মূলধারার মিডিয়ায় কাজ করেন এরকম বাংলাদেশি আমি খুব কমই দেখি। হয় তারা সেখানকার বাংলা মিডিয়ায়, অথবা সেদেশের গণমাধ্যমের বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। নামকরা পত্রিকায় মাঝে মাঝে বাঙালিদের লেখা থাকলেও তাও বাংলাদেশ সম্পর্কিত। এগুলোর কোনোটাই আমি খারাপ বলছি না। কিন্তু বাংলাদেশিরা যদি সেসব দেশের মূলধারার মিডিয়ায় পূর্ণকালীন কাজ করেন তাহলে তা দেশের ইমেজ বৃদ্ধিতে কাজে লাগতে পারে। দেশের বিরুদ্ধে যেকোনও অপপ্রচার রোধে তারা প্রয়োজনে সহায়তা করতে পারেন।

অপপ্রচার, প্রোপাগান্ডা বা ইনফরমেশন ওয়ারফেয়ার এখন আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্যতম বাহন। বাংলাদেশকেও মাঝেমাঝেই এসব মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বাংলাদেশকে জঙ্গিরাষ্ট্র হিসেবে চিত্রিত করার সাম্প্রতিক প্রচেষ্টাতো আমরা দেখেছি। সেইসঙ্গে মিয়ানমারের প্রোপাগান্ডাতো অব্যাহত আছেই।

সম্প্রতি মিয়ানমার তাদের একটি মানচিত্রে বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে তাদের ভূখণ্ডের অংশ হিসেবে দেখিয়েছে। দুঃখজনক হলেও এটা সত্য যে ভবিষ্যতেও আমাদের দেশকে বিদেশি বিভিন্ন রাষ্ট্র বা সংগঠন কর্তৃক এধরনের অপপ্রচারের মুখোমুখি হতে পারে। বিদেশে বাংলাদেশের ইমেজ নিয়ে তাই সরকারসহ দেশের প্রতিটি নাগরিককে সতর্ক হতে হবে। দেশের ইমেজ বৃদ্ধি যেমন কঠিন কাজ, ইমেজ রক্ষাও কিন্তু কম কঠিন নয়।     

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

ইমেইলঃ [email protected]                      

  

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ