‘১৬ ডিসেম্বর, দুপুর একটা। বিয়ার এসে বললে—‘চলো তোমাকে একটা দৃশ্য দেখিয়ে আনি’। ওর সঙ্গে আমি গাড়িতে উঠলাম। সার্কিট হাউসে পাকিস্তানি সামরিক অফিসারদের আত্মসমর্পণ শুরু হয়েছে, আমরা সারেন্ডার দেখলাম। তারপর বিয়ার গাড়ি ঘুরিয়ে আমাকে গল্লামারি রেডিও স্টেশনের কাছে নিয়ে গেলো। সেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পোড়ামাটি নীতি প্রয়োগ করে শেষ মুহূর্তে লেকের দু’ধারে অসংখ্য মানুষ মেরে ফেলে রেখেছে। সদ্য হত্যা করা লাশগুলো একের পর এক মাইলজুড়ে পড়ে আছে। পাটের ক্ষেতে বাতাসে দুলে যায় শুধুই লাশ। কত যে লাশ তা গণনা করা বা বুঝিয়ে বলা অসম্ভব। আমার কাছেও যেন খুব কঠিন দৃশ্য মনে হচ্ছিল না। গত নয় মাস ধরে প্রতিদিনই কিছু ছিন্নভিন্ন বীভৎস শরীরের অংশবিশেষ বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকতে দেখেছি। সেই সব খণ্ড-বিখণ্ড ঘটনারই যোগফলই আজকের স্বাধীনতা। মহান বিজয়।
সন্ধ্যা নেমে এসেছে প্রায়। পেছন ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পাই একতলা বাড়ির সমান উচ্চতায় দুটি পাহাড়ের মতো স্তম্ভ, যার ওপর থেকে নিচে পাদদেশ পর্যন্ত কঙ্কাল, মাথার খুলি, হাত, বুকের পাঁজরের দৃশ্যমান পাহাড়। গত ন'মাসের অপকীর্তি বিশেষ।’
‘১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের ন’মাস সময়ে সমুদ্র পেরিয়ে আসার পর, মনে হলো— আমি পৃথিবীর চেয়ে অনেক বড়। যে কোনও দুর্যোগের মুখোমুখি দাঁড়াবার শক্তি এবং শক্তের জন্য নিজেকে তৈরি করতে হবে।
আজীবন লড়াই করে বাঁচতে হবে আমাকে। আমি প্রস্তুত বারবার মুখে কলঙ্ক মেখে নেবার জন্য। আমি প্রস্তুত মানুষের কটূক্তি, অবজ্ঞা, অবিশ্বাস সবকিছু সহ্য করে নেবার জন্য। ’
(ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর আত্মজীবনী ‘নিন্দিত নন্দন’ থেকে )
ডিসেম্বর। রক্তে রঞ্জিত বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ।
একটি লাল- সবুজ পতাকা। পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মানচিত্র। বিজয়ের আনন্দের সঙ্গে মিশে থাকা কত আত্মত্যাগ! কত অশ্রুপাত! অস্তাচলে যায় কত তরুণ অরুণ! দামাল গেরিলারা অনেকেই ফিরে আসে বীরদর্পে, বিজয় মিছিলে উড়িয়ে জয়ধ্বজা, কণ্ঠে জয়ধ্বনি।
আর বীরাঙ্গনা বলে অভিহিত নারী মুক্তিযোদ্ধারা? বঙ্গবন্ধু তাঁদেরকে স্বীয় কন্যার আসনে স্থান দিলেও সমাজ ছাড়ে না তাঁদের পিছু। তাঁদের জীবনে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের পর আরেক অন্তহীন যুদ্ধ। পরিবার, সমাজ তাঁদেরকে এ বিজয় মিছিলের অংশীদার হতে দেয়নি। বরং লুকিয়ে রাখতে শিখিয়েছে ওই পোড়ামুখ। যুদ্ধের নারকীয় দংশনেই শেষ হয়নি তাঁদের যন্ত্রণা। বাকিটা জীবন করতে হয়েছে সমাজের সঙ্গে অস্তিত্বের লড়াই। বীরাঙ্গনাদের মধ্যে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, শহীদের তালিকায় তাঁদের ক’জনের নাম আছে?
একজন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর দীর্ঘ ২৫ বছর লেগে যায় নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে সমাজের ভ্রুকুটির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেকে বীরাঙ্গনা বলে পরিচয় দিতে।
ডিসেম্বর। বিজয়ের মাস। বিভিন্ন সভায়, অনুষ্ঠানে মায়ের আমন্ত্রণ থাকতো। শরীরটা অনেক বছর থেকেই ভালো যাচ্ছিলো না। হাঁটতে সমস্যা হতো। আমি বলতাম—একটু বিশ্রাম নাও না। মুখের হাসিটা অমলিন রেখেই আবারও কোথাও যাওয়ার জন্য তৈরি হতো। শরীরে- হৃদয়ে বয়ে নিয়ে চলা ৪৭ বছরের ক্ষতকে তুচ্ছ মেনে জাতীয় দিবসগুলোতে বাৎসরিক আনুষ্ঠানিকতার বাইরে মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ ছিল তাঁর প্রতিদিনের সূর্যোদয়ে, রোজকার জীবনচর্চায়। মা হয়তো জানতো, হাতে আর খুব বেশি সময় নেই, তাই যতক্ষণ পেরেছে ছুটে গেছে ক্লান্তিহীন, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা ছড়িয়ে দিতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। মা নিজেকে শেকড়ের সন্ধান খুঁজে ফেরা প্রতিটি যুদ্ধশিশুর ‘মা’ বলে ভাবতো।
একজন বীরাঙ্গনা-মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে মুক্তিযুদ্ধ ব্যক্ত করা খুব সহজ ছিল না।
মা নিজে থেকে না বললে আমি কোনোদিন তাঁর কাছে জানতে চাইনি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও আদর্শ তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে উদগ্রীব হলেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতনের সেই বর্বর অধ্যায় বারবার মনে করতে মায়ের মধ্যে প্রচণ্ড স্নায়ুচাপ তৈরি করতো। সেকথা জীবনের প্রায় শেষ সময়গুলোতে মা নিজেই আমাকে জানিয়েছিলেন। নির্যাতনের ভয়াবহতা আমৃত্যু শরীরে বহন করেছেন। কষ্টটা আমরা মেয়েরা জানলেও কারণটা মা কাউকে বলেননি কোনোদিন।
বছর কয়েক আগে তীব্র যন্ত্রণায় হঠাৎ ফোনে আমাকে জানালে ফোনের এ প্রান্তে আমি নীরবে চোখের জলে ভাসি, কিন্তু মাকে কিছু বলি না।
আমাদের খুব কাছের, সুহৃদ একজন চিকিৎসক পরম যত্নে মাকে দেখেছিলেন এবং বলেছিলেন যে, এমন একজন বীর মায়ের চিকিৎসা করতে পেরে তিনি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছেন।
শেষ দিনগুলোতে মায়ের ছায়াসঙ্গী ছিলাম।
হাসপাতালে বেশিরভাগ কর্মীই মাকে ‘মা’ বলে ডাকতো, যত্নে রাখতো।
আমার প্রিয়দর্শন, অভিষেক, অপ্সরী, ঊর্বশী তাদের নানির সেবায় চব্বিশঘণ্টা প্রস্তুত ছিল।
বাড়িতে বাচ্চাদের ছাড়া আমি কারও হাতে মায়ের কোনও কাজ সহজে ছাড়তে চাইনি।
আমার বারবার মনে হতো— আমি তার যন্ত্রণার কথা জানি। আমি জানি, সে কতটা স্নেহের কাঙাল। আমিই জানি, কতটা মমতায়, কতটা যত্নে তাঁকে স্পর্শ করতে হবে।
১৬ ডিসেম্বর, ২০১৭। গতবছরের বিজয় দিবস। মা তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের আইসিইউ (ICU) তে ভর্তি। দিন-তারিখ- সময়ের হিসাব তাঁর থাকার কোনও উপায় নেই। প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে অনিশ্চয়তায়, অজানা আশঙ্কায়।
দুদিন আগে থেকেই ব্যাগে একটা পতাকা আর লাল টিপ নিয়ে ঘুরছিলাম। মাকে কিছু বলি না আগে থেকে। বিজয় দিবসে ধীরপায়ে আইসিইউ-তে ঢুকি। পতাকাটা তাঁর খাটের মাথার কাছে বাঁধা হয়। লাল টিপটা পরিয়ে দিই কপালে। আদর করে জানতে চাই, ‘আজকে কী দিন মাগো , মনে আছে?’
মা আমার হাতটা ধরে খুব কষ্টে মুখে হাসি এনে বলে, ‘মনে নেই আবার? এদিন কি ভোলা যায়?’ একটু পরে আমাকে আরও কাছে ডেকে হাসপাতালের কর্মীদের দেখিয়ে বলে, ওদের সবাইকে সরকারের পক্ষ থেকে বিজয় দিবসে বিশেষ ভাতা দিলে ওদের উপকার হতো।
বিভিন্ন উৎসবভাতার কথা জানলেও বিজয় দিবসে ওরা বিশেষ কোনও ভাতা পায় কিনা আমার আর জানা হয়নি। আমি আমার মাকে জানি, সারাজীবন কেবল অন্যের কথাই ভেবেছে। তারপরেও হাসপাতালে শয্যাশায়ী একজন মুক্তিযোদ্ধার মানুষের জন্য ভাবনা সেদিন আমাকে অভিভূত করেছিল। দায়িত্বরত একজন নার্সের অনুমতি নিয়ে আমি মায়ের সঙ্গে একটি ছবি তুলেছিলাম। এটাই ছিল মায়ের সঙ্গে কাটানো শেষ বিজয় দিবস।
ল্যাব এইড হাসপাতালের মেডিক্যাল টিম মাকে দেশের বাইরে চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দিলে মা গেয়ে উঠেছিলেন,
‘আমার এই দেশেতে জন্ম
যেন এই দেশেতেই মরি। ’
মেডিক্যাল টিমের চিকিৎসকরা সেদিন শ্রদ্ধায় মাথা নত করেছিলেন বেশ কিছুক্ষণ।
প্রিয়ভাষিণীর সন্তান হিসেবে এভাবেই বারবার গর্বিত হওয়ার সুযোগ এসেছে এই ক্ষুদ্র জীবনে।
‘আবার যদি ইচ্ছে করো
আবার আসি ফিরে
দুঃখসুখের ঢেউ খেলানো
এই সাগরের তীরে।’
কবিগুরু কিংবা জীবনানন্দ দাশের নায়িকা হয়ে ওঁদের কবিতায় প্রিয়ভাষিণী হয়ে ফিরে আসবো এই সোনার বাংলায়। দীপ্তিময় বীরাঙ্গনা মায়ের মর্যাদা আত্মত্যাগী লাখো শহীদের ভালোবাসা আর আত্মত্যাগের এই স্বাধীন বাংলায় বার বারই ফিরে আসবো। মায়ের আঁচলে সবুজ পতাকা নিয়ে ফিরে আসবো। লাখো বীরাঙ্গনা মায়ের জন্য কৃতজ্ঞতা এবং শ্রদ্ধা জানিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হবো আজীবন। কারণ, আমি বাঙালি, আমার দেশ বাংলাদেশ। ’
(- ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর আত্মজীবনী ‘নিন্দিত নন্দন’ থেকে। )
আমার দুটো হাত এখন বড় পুণ্য, বড় পবিত্র মনে হয় যখন ভাবি আমি কেবল খুব কাছে থেকে আমার মায়ের সেবা করার সুযোগ পাইনি, একজন রক্তমাংসের মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা মায়ের শুশ্রূষা করার সৌভাগ্য অর্জন করে ধন্য হয়েছি। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী -এই লাল- সবুজ পতাকায় লক্ষ লক্ষ নামের সাথে যাঁর নামটি ছোট্ট করে হলেও লেখা থাকবে বাংলাদেশের বিজয়ের ইতিহাসে। আমি তাঁকে খুঁজে নেবো লক্ষ মায়ের আঁচলে, সবুজ পতাকায়, রক্তিম সূর্যোদয়ে - এই বাংলায়।
আজ ১৬ই ডিসেম্বর।
মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।
লেখক: ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর কন্যা