X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়!’

চিররঞ্জন সরকার
২৯ এপ্রিল ২০১৬, ১১:৫৮আপডেট : ২৯ এপ্রিল ২০১৬, ১২:০২

চিররঞ্জন সরকারএ এক আশ্চর্য দেশে আমাদের বাস বসবাস! কেউ কারও দায়িত্ব নিতে চায় না। সরকার না। পুলিশ না। এমনকি অভিভাবকও না। ঘর থেকে বের হবেন, অভিভাবকরা বলবেন, সাবধানে যেও। সাবধানে থেকো। তারা অবশ্য বলেই খালাস। এরপর কিছু ঘটলে বলবে, আমি কিন্তু আগেই সাবধান করে দিয়েছিলাম। বাসে-ট্রেনে উঠবেন, সেখানে লেখা-‘মাল নিজ দায়িত্বে রাখুন। ‘কোনও কিছু হারানো গেলে কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।’ আরে ব্যাটা, কর্তৃপক্ষ যদি দায়ী না হয়, তাহলে দায়ী কে? আমি? আমার জন্ম? বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া?
ইদানীং রাষ্ট্রও নাগরিকের দায়িত্ব নিচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীও না। তিনি পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, ধর্মকে কটাক্ষ করে কেউ যদি কিছু লিখে, সে যদি খুন হয় তাহলে সরকার সেই খুনের দায় নেবে না। প্রধানমন্ত্রীর এই বাণীর পর দেশে খুনের আবাদ বেড়ে গেছে। খুনের কারবারিরা প্রধানমন্ত্রীর কথার সম্মান রাখতে প্রাণান্ত ভূমিকা পালন করে চলেছে!
আমাদের পুলিশপ্রধান আরও এক ধাপ এগিয়ে। তিনি বলেছেন, প্রত্যেকের ‘নিজস্ব নিরাপত্তাবলয় তৈরি করতে হবে।’ সাবধান থাকতে হবে। একে অপরকে সহযোগিতা করতে হবে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, ‘মাল নিজ দায়িত্বে রাখুন।’ অর্থাৎ আপনার জীবন-মালের নিরাপত্তা আপনাকেই দিতে হবে। প্রয়োজনে ব্যাঙের মতো গর্তে প্রবেশ করতে হবে। লোহার সিন্দুক বানিয়ে তাতে ঢুকে ভেতর থেকে তালা লাগিয়ে দিতে হবে। তাহলে খুনিরা আপনাকে খুঁজে পাবে না। আপনি নিরাপদ থাকবেন!
আমাদের দেশে একটা প্রবাদ আছে, ‘সাবধানের মার নেই।’ কিন্তু সত্যিই কি তাই? আপনি সাবধানী হয়ে ফুটপাতের এক কোনা দিয়ে হাঁটছেন। কোনও এক দূরন্ত মোটরসাইকেলচালক আপনাকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলো। আপনি আর কত সাবধান হবেন? ‘নন্দনালের’ মতো ঘরে শুয়ে শুয়ে তো জীবন পার করা যায় না। বাঁচতে হলে নানা বৃত্তির সঙ্গে যোগ থাকতে হয়। নানা জায়গায় যেতে হয়। নানা কিছু করতে হয়। এসব করতে হলে অন্য কারও সঙ্গে মনোমালিন্য হতেই পারে। আর হলেই খেল খতম! ঘরেও আমরা নিরাপদ নই। জুলহাজ মান্নান ও তনয়কে তো ঘরের ভেতরে গিয়েই মেরে ফেলা হয়েছে। তাহলে কিসের সাবধানতা? ‘সাবধানের মার নেই’ এখন একটা অচল বাক্য। এখন তো দেখা যাচ্ছে- মারের সাবধান-অসাবধান নেই। যে টার্গেট হচ্ছে, সেই মারা পড়ছে। কুপিয়ে-গুলি করে মেরে ফেলা হচ্ছে। আর এই হত্যার নিশানায় কে নেই? ‘ব্লগার’, লেখক, প্রকাশক, শিক্ষক, ছাত্র, ইমাম-মুয়াজ্জিন, পুরোহিত, নাট্যকর্মী, এনজিওকর্মী। এদের হত্যাকাণ্ডগুলোকে বলা হচ্ছে আদর্শিক খুন। অর্থাৎ চিন্তা, বিশ্বাস বা চর্চার জন্য তারা হত্যার শিকার হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। পুলিশের তরফে এসব ‘আদর্শিক খুনের’ জন্য দায়ী করা হচ্ছে অজ্ঞাত জঙ্গিদের। ইদানীং আবার ‘দেশকে পরিকল্পিতভাবে অস্থিতিশীল করার জন্য জামায়াত-বিএনপি এসব করছে’ বলে রব তোলা হচ্ছে। কথা হলো, ঘটনা যেই ঘটাক, যে কারণেই ঘটাক, তাদের ধরা যাচ্ছে না কেন? তাদের যদি ধরাই না যায়, তাহলে মন্ত্রী-সান্ত্রী-পুলিশ এসব পোষা হচ্ছে কেন? সে কি কেবল ‘ভিভিআইপি’দের নিরাপত্তার জন্য? আমার ব্যবস্থা যদি আমাকেই নিতে হয়, নিজের নিরাপত্তার দুর্গ নিজেকেই গড়তে হয়, তাহলে আমার পরিশ্রমের টাকা ট্যাক্স বাবদ দেব কেন? তা কি কেবল মন্ত্রী-সান্ত্রীদের চর্বিওয়ালা চেহারা টিভিতে দেখার জন্য? তাদের ‘পিত্তগরম করা’ সব বুলি শোনার জন্য?

আরও পড়তে পারেন: বেড়েছে সিসি ক্যামেরা বিক্রি
সময়টা আদৌ সুখের নয়, স্বস্তির নয়। বাতাসে মিশে গিয়েছে ঘৃণার বাষ্প এবং তা দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে দেশের সর্বত্র। একের পর এক মানুষকে এই বিষ বাষ্পে প্রাণ হারাতে হচ্ছে। ভিন্ন ধর্মী, ভিন্ন মতাবলম্বীরা আজ ভয়ানক অনিরাপদ। অথচ আমাদের সংবিধানই আমাদের মতামত প্রকাশ করার, চিন্তার স্বাধীনতার অধিকার দিয়েছে। প্রত্যেকটি মানুষের কথা বলার, নিজস্ব ধর্মাচরণের স্বাধীনতা দিয়েছে। আজ সেই স্বাধীনতার টুঁটি চেপে ধরা হচ্ছে।

সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখন পর্যন্ত এমন একটি কথাও বলেননি যার ফলে বহুত্ববাদী সমাজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে। দেশের সব মানুষের নিরাপত্তা বিধান করা, তাদের অধিকার রক্ষা করা- এটা সরকারের প্রাথমিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। প্রত্যেকটি ধর্মের নিজস্ব জায়গা আছে, সম্মান আছে। এই বহুত্ববাদই আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের অলঙ্কার। তার ওপর যদি খাঁড়া নেমে আসে, তবে আমরা বেঁচে থাকব কিসের জোরে?

দার্শনিক সক্রেটিস হেমলক বিষ পান করার আগে বলেছিলেন, আমি চললাম মৃত্যুর দিকে। আপনারা চলুন জীবনের পথে। প্রশ্ন থেকে গিয়েছে, সক্রেটিস কি মৃত্যুর পথেই হেঁটেছিলেন? নাকি যারা তার মৃত্যুদণ্ড দিতে তৎপর ছিলেন, তারাই আসলে জীবন থেকে বিচ্যুত ছিলেন?

সক্রেটিসকে যখন জেরা করা হচ্ছিল, তখন মিলেটাস তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন, সক্রেটিস যুবকদের বিপথগামী করছেন। প্লেটো তার ‘অ্যাপোলজি’ গ্রন্থে মিলেটাসের সঙ্গে সক্রেটিসের কথোপকথনের যে নমুনা দিয়েছেন, তাতে আছে, মিলেটাস বলছেন যুবকদের সঠিক পথ চালাতে পারে আইন। সক্রেটিস জিজ্ঞাসা করছেন, আইন ব্যবহারকারী মানুষটি কে? মিলেটাস বলছেন, উপস্থিত শ্রদ্ধেয় জুরিরা। যুবকদের পথনির্দেশক সিনেটের সভ্যরা। বিধান পরিষদের সকল সভ্য।
আরও পড়তে পারেন: এটা যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈতনীতি!

তখন সক্রেটিস বলেন, মিলেটাস, তোমার কথা অনুসারে আমিই যুবকদের অকল্যাণ করি। আর এথেন্সের সকলে উন্নতির পক্ষে। মিলেটাস: এই কথাটিই তো আমি বলিষ্ঠভাবে উচ্চারণ করতে চাই। তখন সক্রেটিস বলেন, তা হলে যুবকদের মহাভাগ্য যে তাদের অপকার করার লোক আমি একা। আর সমাজের সকলেই তাদের উপকার করতে চাইছেন। তা হলে আমাকে নিয়ে এত সমস্যা কিসের?

সক্রেটিস এসব কথা বলেছিলেন খ্রিস্টের জন্মের ৪৭০ বছর আগে। আজও এত বছর পরে সক্রেটিসের মতো বলতে হয়, সমাজের সবাই যদি কল্যাণ এবং সঠিক পথে থাকেন, তাহলে দু-চারজন ভিন্ন মতাবলম্বীকে কেন শায়েস্তা করতে হবে? শক্তি ও ধমক দিয়ে দমাতে হবে?

সক্রেটিস থেকে ব্রুনো, গ্যালিলিও থেকে কোপার্নিকাস, সকলেই রাজশক্তির অসহিষ্ণুতার শিকার হয়েছিলেন। তোরিয়ান গ্রে সলেখার পর অস্কার ওয়াইল্ডকে কিরকম কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল, সে কথাও আমরা জানি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল সমকামিতার। দস্তয়েভস্কিকে জারেরা বরফে ঢাকা সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করেছিলেন। ভগৎ সিংহ থেকে নাট্যকার বের্টোল্ট ব্রেখট, তাদের আদালতে গিয়ে দাঁড়াতে হয়েছিল মতাদর্শের কারণে। কারও হয়েছে ফাঁসি, কারও হয়েছে নির্বাসন। কিন্তু এখন সমাজে আরেক চিত্র। অজ্ঞাত ঘাতকরা চরাও হচ্ছে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নিরীহ মানুষের ওপর। চাপাতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। নির্মমভাবে খুন করছে। আর মানুষের নিরাপত্তা দিতে চরম ব্যর্থ সরকার বসে বসে তামাশা দেখছে। নানা ধরনের অসংলগ্ন কথা বলছে। প্রকারান্তরে খুন হওয়া ব্যক্তিটির ওপরই কলঙ্ক আরোপ করা হচ্ছে! যেন সে খুন হয়ে মহাঅপরাধ করে ফেলেছেন!

আরও পড়তে পারেন: সহিংসতা ঠেকাতে পুলিশের ১০ হাজার সাউন্ড গ্রেনেড আমদানি

সরকারের এই ব্যর্থতা ও অসহিষ্ণুতা সমাজকে চরম নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই অসহিষ্ণুতার জবাবে সমাধানের রাস্তা না পেয়ে জনতাও অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। এর পর যদি উন্মত্ত হয়ে ওঠে তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হতে বাধ্য। এমন বাস্তবতায় ডাকাত সন্দেহে গ্রামবাসী মানুষকে পিটিয়ে মারে। আইন নিজের হাতে নেওয়ার এক ভিড়তন্ত্র তৈরি হয়। তাই শাসক দলের অসহিষ্ণুতার বদলে হত্যাকাণ্ড বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ এখন বড় বেশি প্রয়োজন।

মানুষই একমাত্র প্রাণী যে ভালোবাসতে যেমন জানে, ঘৃণা করতেও জানে। ঘৃণা নয়, আজ সমাজে সহিষ্ণুতাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। ভিন্নমত ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন সম্প্রদায়কে শ্রদ্ধা করতে শিখতে হবে। আমার ধর্মই সেরা-এমন মত আরেক ধর্মকে ছোট করে। সেই ধর্ম ও সম্প্রদায়ের প্রতি তাচ্ছিল্য ও ঘৃণাও তৈরি করে। কাজেই শুধু নিজের ধর্মকে সেরা না বলে অন্য ধর্মকেও ভালো বলে মানতে হবে। ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন মতসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। বিতর্ক হওয়া উচিত। কারণ বিতর্ক ছাড়া সমাজ এগোয় না।

বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের জ্ঞানী-গুণী-বুদ্ধিজীবীদের এগিয়ে আসতে হবে। ভিন্ন মতাবলম্বীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। যেকোনও খুনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। আমরা জানি সৎ বুদ্ধিজীবীরা মানুষের স্বপক্ষে কথা বলেন। এটা তাদের অধিকার ও দায়বদ্ধতা। তারা সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর। এখানে সবাই-ই রাজনৈতিকভাবে একই মতাদর্শে বিশ্বাস নাও করতে পারেন। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা, মুক্তচিন্তা, বহুত্ববাদী সমাজ নির্মাণ, মৌলবাদ বিরোধিতার প্রশ্নে সবাইকে একজোট হতে হবে। পৃথিবীর সব দেশে এরকমটাই হয়। অপশাসকের অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষ যখন দল, মত, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে তার ‘মানুষ’ পরিচয়ে ভর করে জেগে ওঠেন, তখন সমাজের প্রতিটি অংশে মানুষ আপনা থেকেই বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মানবতাবাদীরা মানুষের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা থেকে তাদের প্রতিবাদের ভাষা সেই স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহী চিৎকারে মিশিয়ে দেন। এই প্রক্রিয়া শুরু করার সময় দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছে! নাকি তারাও বলবেন- এসবের জন্য ‘কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়!’

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ব্রাজিলে বৃষ্টিপাতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৭৮, এখনও নিখোঁজ অনেকে
ব্রাজিলে বৃষ্টিপাতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৭৮, এখনও নিখোঁজ অনেকে
হারিয়ে গেছে প্রাণ, নদীর বুকে বুনছে ধান
হারিয়ে গেছে প্রাণ, নদীর বুকে বুনছে ধান
টিভিতে আজকের খেলা (৬ মে, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (৬ মে, ২০২৪)
নারায়ণগঞ্জে চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ, আহত ৩
নারায়ণগঞ্জে চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ, আহত ৩
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ