X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

ইসলামি রাষ্ট্রের ‘লম্পট’ নেতা

প্রভাষ আমিন
৩১ জুলাই ২০১৮, ১৭:১৩আপডেট : ৩১ জুলাই ২০১৮, ১৭:২০

প্রভাষ আমিন পাকিস্তান নিয়ে এখনও বাংলাদেশের মানুষের প্রবল আগ্রহ। গত কয়েকদিন বাংলাদেশের গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দেখলেই সেটা বোঝা যাবে। পাকিস্তানের নির্বাচন ফলো করেননি বা কোনও মন্তব্য করেননি এমন মানুষ বোধহয় খুব বেশি নেই। ৪৭ বছর আগে স্বাধীন হলেও এখনও বাংলাদেশে বেশ কিছু আটকেপড়া পাকিস্তানি আছেন। শারীরিকভাবে আটকেপড়া পাকিস্তানিরা বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকেন। আর মানসিকভাবে আটকেপড়া পাকিস্তানিরা সারাক্ষণ অন্তর্জ্বালায় জ্বলেন, পাকিস্তানে কিছু হলে লাফিয়ে ওঠেন, উল্লসিত হন, পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে মাঠে যান, আফ্রিদি মাঠে থাকলে 'ম্যারি মি' লেখা প্ল্যাকার্ড দেখান, বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখেন। পাকিস্তানের নির্বাচন এবং তার ফল নিয়ে বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের মধ্যে দারুণ উল্লাস। এই বুঝি পাকিস্তানকে বিশ্বকাপ জেতানো একমাত্র অধিনায়ক ইমরান খান ডুবন্ত পাকিস্তানকে ভাসিয়ে তুলবেন। আমি পাকিস্তানকে অন্তর থেকে ঘৃণা করি, তাদের পতন চাই, চাই সবাই মিলে ডুবুক। শুধু ঘৃণা করি বা চাই বলেই নয়; আমার ধারণা ইমরান খানের নেতৃত্বে পাকিস্তার আরও তাড়াতাড়ি ডুববে।
পাকিস্তানের এবারের নির্বাচন নিয়ে দুই ধরনের মত পাওয়া যাচ্ছে। নির্বাচনের পর হেরে যাওয়া দলগুলো কারচুপির অভিযোগ এনে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে। এটা অস্বাভাবিক নয়। হেরে গেলে কারচুপির অভিযোগ আনা এ অঞ্চলের মানুষের মজ্জাগত। অস্বাভাবিক হলো ইমরান খানের তেহরিক-ই ইনসাফ ছাড়া বাকি দলগুলো আগে থেকেই কারচুপির আশঙ্কা করে আসছিল। নির্বাচনের পর ইমরান খান এই নির্বাচনকে পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে বলে দাবি করেছেন। আর পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান এ নির্বাচনকে সবচেয়ে নোংরা ও নিয়ন্ত্রিত হিসেবে অভিহিত করেছেন। দুজনের কথাই সত্য। নির্বাচন এতটাই স্বচ্ছ ছিল, নির্বাচনের অনেক আগেই সবাই জানেন ইমরান খানকেই প্রধানমন্ত্রী বানাচ্ছে সেনাবাহিনী। আর নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন তো বটেই। কারণ, পুরো নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করেছে সেনাবাহিনী।

অনেকে বলতে পারেন, একটি বোমা হামলায় ৩১ জনের মৃত্যুর ঘটনা বাদ দিলে পাকিস্তানের মানদণ্ডে নির্বাচন ভালোই হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৫৫ ভাগ মানুষ ভোট দিয়েছেন। অনেক এলাকায় নারীরা প্রথমবারের মতো ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। তাহলে নির্বাচনে তো জনমতেরই প্রতিফলন ঘটেছে। কিন্তু আসলে নির্বাচনে জনমত নয়, সেনামতের সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে। ইমরান খানকে জেতানোর জন্য অনেক আগে থেকেই প্লট সাজিয়েছে সেনাবাহিনী। এই ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছে বিচার বিভাগও। ঠুনকো অজুহাতে সরিয়ে দেওয়া হয় নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে। শুধু তাই নয়; তাকে রাজনীতিতে আজীবন নিষিদ্ধ করে কন্যাসহ জেলে ঢুকানো হয়েছে। এর মাধ্যমে সেনাবাহিনী ইমরানের পথের সবচেয়ে বড় কাঁটাটি সরিয়ে দেয়। ছোটখাটো যেসব কাঁটা ছিল তাও ভয় দেখিয়ে দলে টেনে বা বসিয়ে দিয়ে সব ফকফকা করে ফেলা হয়। ইমরান খানের জয় নিশ্চিত হওয়ার পরই সবচেয়ে স্বচ্ছ ও নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনটি করেছে সেনাবাহিনী। কাগজে-কলমে নির্বাচন কমিশন করলেও নির্বাচনটি আসলে করেছে সেনাবাহিনী।

সাংবাদিক গাজী নাসির উদ্দিন খোকন ফেসবুকে লিখেছেন, 'সব দেশে একটা সেনাবাহিনী থাকে আর পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর একটা দেশ আছে। আরেকটু বলি, আসলে আইএসআইয়ের একটি সেনাবাহিনী আছে। তাতে যা দাঁড়ায়, আইএসআইয়ের একটি দেশ আছে, তার নাম পাকিস্তান'। স্বাধীনতার পর ৭০ বছরের অর্ধেকেরও বেশি সময় প্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তান শাসন করেছে সেনাবাহিনী। বাকি সময়টাও দেশ চলেছে তাদের ইশারায়। যখনই কেউ সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেছে; তখনই তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে, নয়তো দেশ ছাড়তে হয়েছে, নয়তো পৃথিবী। সেনাবাহিনীর সর্বশেষ শিকার নওয়াজ শরিফ। আর তাদের সর্বশেষ পাপেট ইমরান খান। এখন আর বিশ্বে সেনাশাসন গ্রহণযোগ্য নয়। তাই পাকিস্তান সেনাবাহিনী সরাসরি ক্ষমতা না নিয়ে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ে। নির্বাচনে সরকার গঠিত হবে পাঁচ বছরের জন্য। কিন্তু নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গেই আলোচনা শুরু হয়েছে, ঝুলন্ত পার্লামেন্টে ইমরান কয়দিন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন? এই প্রশ্নের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উত্তর হলো, সেনাবাহিনী যতদিন চাইবে ততদিন।

নওয়াজ শরিফও সেনাবাহিনীর পছন্দেরই ছিলেন। তাহলে বিরাগভাজন হলেন কেন? তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নের চেষ্টা করেছিলেন, চেষ্টা করেছিলেন জঙ্গিদের ওপর থেকে আশীর্বাদ সরিয়ে নিতে। সেখানেই সেনাবাহিনীর গোস্বা। নিজেদের অপরিহার্যতা প্রমাণে সেনাবাহিনী সবসময় ভারতের সঙ্গে একটা উত্তেজনা বজায় রাখতে চায়। জঙ্গিদের নিয়ে খেলতে চায়। এ কারণেই নওয়াজ শরিফকে ছুঁড়ে ফেলে ইমরানকে কোলে তুলে নিয়েছে। পাশ্চাত্যে পড়াশোনা করলেও ইমরান এখন কট্টর জাতীয়তাবাদী, ভারতের ব্যাপারে যুদ্ধংদেহী, বাংলাদেশকে ঘৃণা করেন, জঙ্গিদের আদর করেন, নারী স্বাধীনতার বিরোধী। সব একদম খাপে খাপ সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে যায়।

গোটা পাকিস্তানই বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর। একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য তারা কখনোই ক্ষমা চায়নি, আসলে স্বীকারই করেনি। বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের ফেরত নেয়নি। বাংলাদেশের পাওনা ফেরত দেয়নি। ইমরান খান আরো ক্ষতিকর। একাত্তরের পর থেকেই ইমরান বাংলাদেশবিদ্বেষী। কাদের মোল্লার ফাঁসির পর ইমরান বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছিলেন।

ব্রিটিশদের কাছ থেকে পাকিস্তান আর ভারত স্বাধীনতা পেয়েছিল একদিন আগে পরে। ৭০ বছরে ভারতের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাব শূন্য। আর পাকিস্তানে শতভাগ। কারণ, পাকিস্তানের জন্মটাই হয়েছিল ধর্মীয় জেহাদি জোশকে পুঁজি করে। সেই জোশেই চলছে পাকিস্তান। চলছে অবশ্য পেছনের দিকে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার চিরদিনের কৃতজ্ঞতা, কারণ তারা জীবনের মায়া না করে পাকিস্তান থেকে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। সেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল আর পাকিস্তান একটি অকার্যকর, জঙ্গি রাষ্ট্র। এবারের নির্বাচনে পাকিস্তানি জঙ্গিরা এখন পার্লামেন্টে বসতে যাচ্ছে। সকল সূচকেই বাংলাদেশ এখন পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে।

নির্বাচনে জয়ের পর প্রথম প্রতিক্রিয়ায় ইমরান খান তার নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর স্বপ্নের পাকিস্তান গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। শুনে আমার কাছে মনে হয়েছে, চোরের সাক্ষী মাতাল। ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে পাকিস্তান গড়েছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনি ছিলেন ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানের কায়েদে আযম। কিন্তু তার চলনে-বলনে ইসলামের কোনও ছোঁয়া ছিল না। জিন্নাহ পশ্চিমা স্টাইলে জীবনযাপন করতেন। তার প্রিয় পানীয় ছিল উন্নতমানের স্কচ হুইস্কি। পাকিস্তানের আরেক সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের মদ আর নারীপ্রীতি তো উপন্যাসের মর্যাদা পেয়েছে। একাত্তরে ইয়াহিয়া যখন মদে ডুবেছিলেন, তখন তার বাহিনী ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খোলা আকাশের নিচে অস্ত্রসমর্পণ করেছিল। প্রচলিত পারিবারিক উত্তরাধিকারের বাইরে গিয়ে ইমরানের জয়কে অনেকে পাকিস্তানের বদলে যাওয়ার শুরু বলে মনে করছেন। কিন্তু ইমরানের জীবনযাপন তার নেতা জিন্নাহর মতোই। অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করে স্মার্টনেস শিখেছেন বটে, সেই স্মার্টনেস দিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক মেয়েও পটিয়েছেন; কিন্তু মানসিকতায় ইমরান মধ্যযুগীয়, গোড়া সাম্প্রদায়িক। সর্বশেষ নিজের পীরকে বিয়ে করেছেন। কিন্তু আগের দুই স্ত্রীই ছেড়ে যাওয়ার পর ইমরানের বিরুদ্ধে শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন। তিনটি বিয়ে করেছেন। কিন্তু এর বাইরে দেশে-বিদেশে তার বান্ধবীর সংখ্যা আমার ধারণা ইমরানও মনে করতে পারবেন না। ইমরানের এই বিয়ে-বহির্ভূত সম্পর্কের ফসল ছড়িয়ে আছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তাদের কাউকে কাউকে ইমরান স্বীকার করেন, অধিকাংশকেই করেন না। দেশ হিসেবে ভারত তার অপছন্দের হলেও সেখানেই তার বান্ধবী সবচেয়ে বেশি। দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে কোনও সম্পর্কে জড়ালে ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনও আপত্তি নেই। তবে ইসলাম তো তা অনুমোদন করে না। সেখানে তিনি এখন ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী! ইমরান যেমন ক্রিকেটে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, তেমনি লাম্পট্যেও। সেই লাম্পট্যে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মুখে যখন মদিনার মতো রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয় শুনি, তখন বুঝি বিশেষণ হিসেবে 'ভণ্ড' অনেক দুর্বল।

জিন্নাহ থেকে ইমরান- পাকিস্তানি নেতাদের চরিত্র, জীবনযাপন, পোশাক, আচরণ বিশ্লেষণ করলে একটা বিষয় পরিষ্কার;  ইসলাম তাদের কাছে নিছক ক্ষমতায় যাওয়ার এবং টিকে থাকার হাতিয়ার। ইসলামের সঙ্গে তাদের দূরতম কোনও সম্পর্ক নেই। আহমদিয়াদের তারা অমুসলিম ঘোষণা করেছে। এখন দাবি করছে শিয়াদেরও অমুসলিম ঘোষণার। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি আসলে পুরোটাই ভণ্ডামিতে ঠাসা।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
অনেক নার্ভাস ছিলেন সাইফউদ্দিন
অনেক নার্ভাস ছিলেন সাইফউদ্দিন
বকশিবাজার মোড়ে বাসের ধাক্কায় পথচারী নিহত
বকশিবাজার মোড়ে বাসের ধাক্কায় পথচারী নিহত
১২ বছর পর মুম্বাইয়ের মাঠে কলকাতার জয়
১২ বছর পর মুম্বাইয়ের মাঠে কলকাতার জয়
বেড়িবাঁধে উন্নত নিরাপত্তা ও গতিশীলতা: মেয়র আতিকের কাছে ইউল্যাবের আবেদন
বেড়িবাঁধে উন্নত নিরাপত্তা ও গতিশীলতা: মেয়র আতিকের কাছে ইউল্যাবের আবেদন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ