X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

এসবই কি হওয়ার কথা ছিল?

আমীন আল রশীদ
২৪ জুলাই ২০২০, ১৯:০৮আপডেট : ২৪ জুলাই ২০২০, ১৯:১০

আমীন আল রশীদ পৃথিবীতে একটা মহামারি আসবে অথচ সেই মহামারিকে পুঁজি করে দেশের একটি অসৎ ও দুর্নীতিবাজ গোষ্ঠী ব্যবসা করবে না বা মানুষের অসহায়ত্বকে হাতিয়ার বানিয়ে কোটি কোটি টাকা কামাবে না— তা যেন আমাদের ভাবনারও অতীত।
করোনার প্রকোপ শুরুর পরে পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে বিভীষিকাময় চিত্র উন্মোচিত হলো; তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা অনিয়ম ও দুর্নীতির যে বিশাল জাল আবিষ্কৃত হলো, তার সাথে বেশ মিলে যাচ্ছে ২০০৭ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ‘ওয়ান ইলেভেনের’ সময়কালের বেশ কিছু ঘটনা।
২০০৭ সালের ৮ মার্চ যায়যায়দিনে এই লেখকের একটি রিপোর্টের শিরোনাম ছিল ‘বেরিয়ে আসছে অজগর কুমির জাগুয়ার’। রিপোর্টে বলা হয়, ‘দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান শুরুর পর থেকে শখবিলাসীদের শখের কুমির, অজগর প্রভৃতি প্রাণী ও ব্ল্যাক জাগুয়ারের মতো অভিজাত গাড়িও বেওয়ারিশ হয়ে যাচ্ছে। রাস্তার পাশে পড়ে থাকছে। মালিক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রাস্তায় নেমে আসছে ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানার অজগর। পুরান ঢাকার পুকুরের ঘাটলায় রোদ পোহাচ্ছে কুমিরের ছানা।’ অর্থাৎ অবৈধভাবে যারা এসব সংগ্রহ করেছিলেন, যেসব কালো টাকার মালিক অবৈধ পয়সা দিয়ে বিলাসবহুল গাড়ি কিনেছিলেন, তারা যৌথ বাহিনীর অভিযানে ধরা পড়ার ভয়ে এগুলোকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছেন। সে রকমই স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির নানা চিত্র এখন বেরিয়ে আসছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান এবং গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে। অব্যাহত বিতর্কের মুখে গত ২১ জুলাই পদত্যাগ করেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ। যদিও এই পদত্যাগের মধ্য দিয়েই তিনি দায়মুক্ত হলেন কিনা; যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে মামলা হবে কিনা; পদত্যাগ করলেও তিনি বর্তমান বেতন ও সুযোগ-সুবিধায় সরকারের অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হবেন কিনা, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে।
করোনা শুরুর পর স্বাস্থ্য খাতের যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা বেরিয়ে আসে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছে ভয়াবহ এবং অভিনব প্রতারণার অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমের গ্রেফতার। সেই সঙ্গে করোনার ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগে ‘জিকেজি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক, সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সাবরিনা এবং তার স্বামী আরিফ চৌধুরীর গ্রেফতারও সাম্প্রতিক সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনা।  
করোনার প্রকোপ শুরুর পরপরই বেসরকারি হাসপাতালগুলো শাটডাউন; বিভিন্ন হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার নামে মানুষের গলাকাটা; সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক হাওয়া; সরকারি হাসপাতালে নকল মাস্ক সরবরাহ; সরকারি হাসপাতালে সরবরাহকৃত জিনিসপত্রের অবিশ্বাস্য দাম; করোনার পরীক্ষা নিয়ে প্রতারণা করার মামলায় সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং একজন চিকিৎসকসহ তিন জনকে গ্রেফতারও আলোচনায় এসেছে।
প্রশ্ন উঠেছে, কাদের প্রশ্রয়ে রিজেন্ট ও সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কর্তৃপক্ষ এসব অনিয়ম করতে সাহস পেলো? সরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজে কোন মাস্ক দেওয়া হয়েছে, কত টাকার মাস্ক দেওয়া হয়েছে, সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের চাহিদা অনুযায়ী মাস্ক দেওয়া হয়েছে কিনা, এসব বিষয় কি কর্তৃপক্ষ দেখেনি? নাকি নকল মাস্ক সরবরাহের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল বা সরকারের কোনও একটি অংশও জড়িত?
প্রশ্ন হলো, এসবই কি হওয়ার কথা ছিল? বছরের পর বছর ধরে আমরা যে ধরনের রাজনীতি, সরকার, ব্যবসার পরিবেশ এবং সম্পর্কের কাঠামো গড়ে তুলেছি, তাতে মহামারি নিয়ে একশ্রেণির লোক ব্যবসা করবে, সেটিই কি স্বাভাবিক ছিল না? রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যে দেশে অবৈধভাবে ধনী হওয়া যায় এবং অবৈধভাবে ধনী হওয়াই যে দেশে সহজ, সেই দেশে ঘুষ, অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাট থামানো কি এত সহজ?  
দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, গণমাধ্যমের অনুসন্ধান, সোশ্যাল মিডিয়ার চাপ আর কিছু সৎ,সাহসী ও দেশপ্রেমিক কর্মকর্তার সুবাদে কিছু লোক ফেঁসে যাচ্ছেন বলেই কি আমরা এই উপসংহারে পৌঁছাতে পারি যে, দেশ থেকে সব অন্যায় রাতারাতি দূর হয়ে যাবে? আগামী বছর থেকে দেশে আর দুর্নীতি হবে না, সরকারি প্রকল্পে বিস্ময়কর সব লুটপাট হবে না– এই কথা কি জোর দিয়ে কেউ বলতে পারবেন? পারবেন না। কারণ এটি একটি বিশাল চক্র। একজন সাহেদ বা সাবরিনার গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে বছরের পর বছর ধরে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব নয়। এই সিন্ডিকেটের সবশেষ প্রান্ত স্পর্শ করা খুব কঠিন।
কিছু লোককে গ্রেফতার করে তাদের আইনের আওতায় এনে বিচার সম্পন্ন করাও যথেষ্ট নয়। বরং এই অন্যায় ও অনিয়মের রাশ টানতে হলে আইনি প্রক্রিয়ায় বিচারের পাশাপাশি প্রয়োজন সম্পত্তি জব্দ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নেওয়া। কারণ, যিনি অবৈধভাবে, অনিয়ম ও লুটপাট করে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, তিনি ৫ বছর জেলে থাকলেও তার কিছু যায় আসে না। কারণ, তার সম্পদ ও সম্পত্তি তার উত্তরাধিকাররা ভোগ করতে থাকবেন। সুতরাং অবৈধভাবে গড়ে তোলা সম্পদ ও সম্পত্তি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নিয়ে অপরাধীদের দেউলিয়া করে দিতে না পারলে বা তাদের পথে বসিয়ে দিতে না পারলে বাকিদের মনে কখনোই ভয় ঢুকবে না। বরং সবাই ভাববে, টাকা দিয়ে সবকিছু কিনে নেওয়া যাবে।
পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধীদের বিরুদ্ধে যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়, তার ওপরেই নির্ভর করে অপরাধীর কী শাস্তি হবে। অতএব, যিনি অন্যায়ভাবে জনগণের হক নষ্ট করে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, তিনি মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে দুর্বল তদন্ত রিপোর্ট লেখানোর চেষ্টা করবেন এবং এই কাজে সফল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ফলে যাকেই ধরা হোক না কেন, তার সম্পদ ও সম্পত্তিতে হাত না দিলে কেবল প্রচলিত আইনে বিচার করে অপরাধীদের মনে চূড়ান্ত রকমের ভয় ঢুকানো সম্ভব নয়। আর মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত না ভয় পায়; যতক্ষণ না সে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয় যে, সে কোনও না কোনোভাবে ধরা পড়ে যাবে এবং ধরা পড়লে রাষ্ট্র তাকে পথে বসিয়ে দেবে, ততক্ষণ তার মনে অন্যায় করার প্রবণতা বন্ধ হবে না।
এর জন্য সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। রাষ্ট্রীয় বা রাষ্ট্রের কোনও এক বা একাধিক অংশের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কারও পক্ষে অবৈধভাবে ধনী হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং রাষ্ট্রকে দুর্নীতিমুক্ত করতে চাইলে সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতাই প্রধান শর্ত। করোনাকালে পরে স্বাস্থ্য খাতে যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর বেরিয়েছে, যারা এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত, তারা সবাই সরকারের কোনও না কোনও অংশের সাথে ঘনিষ্ঠ। কেউ কেউ ক্ষমতাসীন দলের সাথেও যুক্ত। সুতরাং কিছু সৎ ও সাহসী কর্মকর্তা চাইলেই যে সব অপরাধীকে ধরে ফেলতে পারবেন বা সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে পারবেন, সেটি খুব সহজ নয়।
অপরাধের দায় নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক পদত্যাগ করেছেন অথবা করতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু গত অর্ধশতাব্দীতে দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বলে যে কোনোকিছুই দাঁড়ালো না, সেখানে দায় শুধু একজন মহাপরিচালক বা কোনও একজন মন্ত্রীর নয়। এই দীর্ঘ সময়ে যারা মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন, তাদের কেউই এই দায় এড়াতে পারেন না। স্বাস্থ্য খাতে যে ‘মিঠু সিন্ডিকেটের’ কথা বারবার আলোচিত হচ্ছে, সেই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনও অভিযান হয়েছে? ধরা যাক মিঠু সিন্ডিকেটের সদস্যদেরও ধরা হবে। কিন্তু এরকম সিন্ডিকেটের সংখ্যা কত, তা কি কেউ জানে? জনগণের এই লুটপাটকৃত অর্থের ভাগ-বাটোয়ারা রাষ্ট্রের কোন স্তর পর্যন্ত পৌঁছায়, তা কি আমরা জানি?
কোথাও কোনও ইতিবাচক পরিবর্তন যে হয়নি তা তো করোনা এসে মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা আর লুটপাট অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে; বিশেষ করে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যে ন্যূনতম কোনও সিস্টেম নেই, চেইন অব কমান্ড নেই, মানবিকতা নেই– সেটি আরও বেশি স্পষ্ট হয়েছে। সুতরাং এখন স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতির যেসব চিত্র বেরিয়ে আসছে বলে অনেকেই এই ভেবে আশাবাদী হচ্ছেন যে, এবার বোধ হয় স্বাস্থ্য খাত বদলে যাবে– সেই প্রত্যাশা আখেরে কতটা পূরণ হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
যারা গ্রেফতার হয়েছেন, তাদের কিছু লোকের হয়তো বিচার হবে। অনেকে আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে পার পেয়ে যাবেন। অনেকে নির্দোষও প্রমাণিত হতে পারেন। আবার যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের সবাই ধরা পড়ছে না বা ধরা হচ্ছে না। দেখা যাবে, করোনার প্রকোপ কেটে গেলে আরও অনেক ইস্যু গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় জায়গা করে নেবে। তখন স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতির ইস্যু আর হালে পানি পাবে না। মানুষ ভুলে যেতে থাকবে। ফলে যে পরিবর্তনের আশায় মানুষ বুক বাঁধছে, পরবর্তী সুনামি আসার আগ পর্যন্ত মানুষ হয়তো জানতেই পারবে না, তাদের আশা কতটুকু পূরণ হলো?

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ