X
বুধবার, ০১ মে ২০২৪
১৮ বৈশাখ ১৪৩১

অকূল পাথারে ফিলিস্তিনিরা

আনিস আলমগীর
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৫:৪২আপডেট : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৫:৪৪

আনিস আলমগীর দীর্ঘদিন ধরে তিন ‘না’-এর ওপর চলে আসছিল আরব-ইসরায়েল সম্পর্ক। ইসরায়েলের সঙ্গে কোনও শান্তি না, ইসরায়েলকে কোনও স্বীকৃতি না এবং ইসরায়েলের সঙ্গে কোনও সমঝোতা না। কিন্তু এখন একের পর এক মধ্যপ্রাচ্যের আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে বৈরিতা পরিত্যাগ করে সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে এবং কূটনৈতিক সম্পর্কও স্থাপন করছে। সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে বা কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করবে—এটা মোটেও উদ্বেগের কোনও বিষয় নয়। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে যেই ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে ১৯৪৮ সাল থেকে এই পর্যন্ত তারা পরস্পর পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, সেই ফিলিস্তিন বিষয়ে উভয়ের মধ্যে কোনও আলোচনাই নেই।
ফিলিস্তিনিরা এখন যদি বলে আরব রাষ্ট্রগুলো তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তবে সেটি কোনও মিথ্যা অভিযোগ হবে না। মূলত মধ্যপ্রাচ্যে মূল সমস্যাই হচ্ছে ফিলিস্তিন। এ সমস্যা সমাধানের বিষয়ে আমেরিকা ১৯৪৮ সাল থেকে লেগে আছে। কিন্তু আমেরিকার মধ্যস্থতাতে সততার অভাব ছিল বলে বিশ্বের তাবৎ বিশ্লেষকরা মনে করেন। যে কারণে এ সমস্যাটার কোনও সমাধান সম্ভব হয়নি। বরং আমেরিকা ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর অস্তিত্বই বিপন্ন করে ফেলেছে। ইরাকের আর লিবিয়ার আজকের অবস্থার জন্য শতাংশে আমেরিকাই দায়ী এবং তা করা হয়েছে ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য। মিশরের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে সরিয়ে তার জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল সিসিকে প্রেসিডেন্ট করা হয়েছে একই কারণে।

মোটামুটি প্রেসিডেন্ট জিমি কাটার থেকে আরম্ভ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত সবাই সমস্যাটি নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে গ্রহণযোগ্য সমাধানের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোন রূপরেখার ভিত্তিতে ফিলিস্তিন সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান হবে তার সুস্পষ্ট ধারণা সবার মধ্যে ছিল না—এটি কী দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান হবে নাকি এক রাষ্ট্রের ভিত্তিতে হবে। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মধ্যস্থতায় ১৯৯৮ সালে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। ইয়াসির আরাফাত এবং নেতানিয়াহু ক্লিনটনের উপস্থিতিতে হোয়াইট হাউসে এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তখনই দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের রূপরেখা সুস্পষ্ট রূপ নেয়। 

১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কিছু জায়গার অধিকার পায়। ২০০৪ সালে ফিলিস্তিনিদের শক্তিশালী নেতা ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পর ফিলিস্তিন আন্দোলনের গতি স্তিমিত হয়ে পড়ে। আরাফাতের মৃত্যুর পর বড় ঘটনা হচ্ছে ৩১ জুলাই ২০১৯ সালে জাতিসংঘের ১৩৮টি সদস্য দেশের ভোটে রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি পাওয়া। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি অগ্রগতিতে সবচেয়ে বাধা হয়ে কাজ করছেন এখন বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু খুবই কট্টর ও কঠিন প্রকৃতির লোক। তিনি এক রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পক্ষের লোক, যে কারণে সমাধানের বিষয়ে পূর্বের আলোচনার আর কোনও অগ্রগতি হয়নি। 

ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির জন্য গত বছর ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ নামে একটি পরিকল্পনার কথা ফাঁস করেছিল ইসরায়েলের একটি হিব্রু-ভাষার নিউজ আউটলেট। তাতে বলা হয়েছিল ইসরায়েল, পিএলও ও হামাসের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে গাজা এবং পশ্চিম তীরের কিছু জায়গা নিয়ে ‘নিউ ফিলিস্তিন’ নামে একটি রাষ্ট্র গঠন করা হবে। ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেমে তার রাজধানী প্রতিষ্ঠার দাবি ছেড়ে দেবে আর ইসরায়েল রামাল্লার আশপাশে ফিলিস্তিনিদের জন্য দু’চারটা গ্রাম ছেড়ে দেবে, সেখানেই তারা রাজধানী প্রতিষ্ঠা করবে। গত ২৮ জানুয়ারি ২০২০ ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে নিয়ে হোয়াইট হাউসে ‘ট্রাম্প পিস প্ল্যান’ ঘোষণাও করেন, কিন্তু সমঝোতার জন্য ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের কাউকেই তিনি সেখানে ডাকেননি।

নেতানিয়াহু এক রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পক্ষে ভালোই কিছু গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করার চেষ্টা করছেন। এই বিষয়ে ট্রাম্প আরব রাষ্ট্রগুলোর শেখদের সমর্থন আদায়ের ব্যবস্থা করেন। এখন নেতানিয়াহু শেখ-শাসিত রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সমঝোতা স্থাপন, কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ইত্যাদির প্রয়াস চালাচ্ছেন এবং সফলকামও হচ্ছেন।  সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে ১৩ আগস্ট ২০২০, বাহরাইনের সঙ্গে ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ সেই সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। এর আগে ১৯৭৯ সালে মিশর এবং ১৯৯৪ সালে জর্দানের সঙ্গে চুক্তি করে পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে ইসরায়েল। তবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের নতুন মাত্রা নিয়ে সব ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে সত্য, কিন্তু ফিলিস্তিনের বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে গেছে। 

সৌদি আরবের বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজ বলছেন তিনি ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান ছাড়া ইসরায়েলের সঙ্গে কোনও চুক্তি বা সমঝোতা করবেন না। এটি লোক দেখানো বা মুসলিম বিশ্বকে বোকা বানানোর প্রয়াস মাত্র। মধ্যপ্রাচ্যের শেখ শাসিত রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতার চাবিকাঠি যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। সম্প্রতি একজন মার্কিন অনুসন্ধানী সাংবাদিকের প্রকাশিতব্য বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে খবর বের হয়েছে যে, তুরস্কে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের পর, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া থেকে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে রক্ষা করেছেন বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন। কথাটা সর্বতোভাবে সত্য। যদিও ট্রাম্প বলেছেন, খাশোগিকে হত্যার নির্দেশ সৌদি যুবরাজ দিয়েছেন বলে বিশ্বাস করেন না তিনি। যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে দেখা গেছে, হত্যাকাণ্ডটির নির্দেশনা সৌদি যুবরাজই দিয়েছিলেন।

যাক, ট্রাম্পের এই প্রয়াস সফল হওয়ার পর ফিলিস্তিনিরা নিঃসঙ্গ হওয়ার কথা। অবশ্য তুরস্ক, ইরান এবং পাকিস্তান যদি শেখ শাসিত রাষ্ট্রগুলোর বিকল্প হিসেবে ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ায় তবে ফিলিস্তিনিদের দাবি হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে। শেখ শাসিত মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ছাড়া বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বের অবশিষ্ট দেশগুলো এখনও ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য দাবি সমর্থন করে যাচ্ছে। শেখ শাসিত রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করছে তা যদি কার্যকরভাবে আরব স্বার্থ তথা ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ রক্ষার কাজে ব্যবহার করে তবে উত্তম ফলাফলও বের হয়ে আসতে পারে। 

এখন হিজবুল্লাহ, হামাস ইত্যাদির মতো শক্তিশালী গোষ্ঠীগুলোকে নিষ্প্রাণ করে ফেলার জন্য ইসরায়েল অব্যাহত বোমা মেরে যাচ্ছে। শেখ শাসিত রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলকে অনুরূপ নির্মম কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা উচিত। তারা কিন্তু সব সময় ফিলিস্তিনিদের পক্ষে অবহেলার দৃষ্টি দিয়ে দেখেন, এটা ফিলিস্তিনিদের সর্বক্ষণিক অভিযোগ। ইসরায়েল-আমেরিকার হাতে মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর সীমানা বিন্যাসের এক মহা-পরিকল্পনা রয়েছে। লেবানন থেকে সিরিয়া সীমান্ত, জর্দান থেকে সিনাই-ইহুদিরা বলে এটি ‘প্রতিশ্রুত জায়গা’, যা ইহুদিদের জন্য নির্ধারিত করেছে স্বয়ং ঈশ্বর। ওই জায়গায় ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ইহুদিরা বদ্ধপরিকর, তাদের ধীর পদক্ষেপ থেকে মনে হচ্ছে তারা তাদের জায়গা থেকে পিছু হটবে না। সুতরাং থলের বিড়াল বের করার আগে আরব রাষ্ট্রগুলোর ঐক্যের প্রয়োজন। 

লেখক:সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

[email protected]

 

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মন্ত্রী-এমপি’র আত্মীয়দের নিয়ে আ.লীগ কী ‘ইউটার্ন’ নিচ্ছে!
উপজেলা নির্বাচনমন্ত্রী-এমপি’র আত্মীয়দের নিয়ে আ.লীগ কী ‘ইউটার্ন’ নিচ্ছে!
‘মানুষের কত ফ্রেন্ড, কাউকে পাশে পাইলে আমার এমন মৃত্যু হইতো না’
‘মানুষের কত ফ্রেন্ড, কাউকে পাশে পাইলে আমার এমন মৃত্যু হইতো না’
বরগুনায় দুই সাংবাদিকসহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা
বরগুনায় দুই সাংবাদিকসহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা
ভিনিসিয়ুসের জোড়ায় প্রথম লেগে বায়ার্নকে জিততে দেয়নি রিয়াল
চ্যাম্পিয়নস লিগ, সেমিফাইনালভিনিসিয়ুসের জোড়ায় প্রথম লেগে বায়ার্নকে জিততে দেয়নি রিয়াল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ