X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার তৃতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে নাগরিক দায়িত্ব

ড. প্রণব কুমার পান্ডে
০৭ জানুয়ারি ২০২২, ২০:০৭আপডেট : ০৭ জানুয়ারি ২০২২, ২০:০৭
ড. প্রণব কুমার পান্ডে প্রায় দুই বছর ধরে পৃথিবীব্যাপী চলমান কোভিড-১৯ অতিমারির তাণ্ডবে প্রায় সব দেশ অর্থনৈতিক এবং স্বাস্থ্য খাতের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করছে। কখনও কখনও সংক্রমণ চূড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে, আবার কখনও কখনও সরকারের কঠোর অবস্থান এবং ভ্যাকসিন কার্যক্রমের ফলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে থাকছে। ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ,  যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সংক্রমণের তৃতীয় ধাপে, আবার কোনও কোনও দেশ সংক্রমণের চতুর্থ ধাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে করোনা দ্বিতীয় ধাপে। এরপরে রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। তবে তুলনামূলক বিচারে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার অনেক কম রয়েছে। গত বছরের মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত করোনার দ্বিতীয় ঢেউে আমাদের দেশ ভয়াবহ অবস্থা পার করেছে। ঠিক একই সময়ে ভারতে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। মৃত্যুর সংখ্যা এবং সংক্রমণের হারে ভারতের অবস্থা খুব খারাপ হয়েছিল।

পরে ২০২১ সালের আগস্ট মাস পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে, যা ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এর ফলে প্রায় দুই বছরের বন্দিদশা থেকে মানুষ মুক্তি পেতে শুরু করে।

২০২১ সালের মধ্য নভেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকায় আবিষ্কৃত করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট পৃথিবীব্যাপী তাণ্ডব চালানো শুরু করছে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে। পুরো ডিসেম্বর মাসে ইউরোপ এবং আমেরিকার দেশগুলো সংক্রমণের উচ্চ হারের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।  প্রথম দিকে যদিও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ওমিক্রনের ভয়াবহতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। পরে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ওমিক্রনে সংক্রমণের হার বেশি হলেও মৃত্যু ঝুঁকি ডেল্টার তুলনায় কম। আরও দু-একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির হার ডেল্টার তুলনায় ৭০ শতাংশ কম। যদিও এটি একটি স্বস্তির খবর, তবু যেভাবে বিশ্বব্যাপী ওমিক্রন তাণ্ডব শুরু করেছে, তা যেকোনও সময় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

২০২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ভারতে ওমিক্রনের সংক্রমণ চিহ্নিত হলেও খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। ওমিক্রনের সঙ্গে সঙ্গে ডেল্টা ভাইরাসের সংক্রমণ পুনরায় ব্যাপক আকার ধারণ করা শুরু করেছে ভারতে। ভারতের মতো বাংলাদেশেও গত সপ্তাহে সংক্রমণের উচ্চ হার পরিলক্ষিত হচ্ছে। সংক্রমণের হার যেখানে ০১ শতাংশের কাছাকাছি ছিল, সেটি চার দিনের ব্যবধানে ০৫ শতাংশে পৌঁছেছে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ২০ জনের শরীরে ওমিক্রন শনাক্ত হলেও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তাণ্ডব শুরু হয়েছে বলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। তবে এটি যে ওমিক্রনের সংক্রমণ নয় তা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। কারণ, অধিক হারে জিনোম সিকোয়েন্স না করলে এই বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কঠিন।

ফলে, এই মুহূর্তে প্রয়োজন সবার সচেতনতা।  ওমিক্রনের সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকার দুই সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন ধরনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকাসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। একই সঙ্গে  বাইরে থেকে বাংলাদেশে আসা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আরটিপিসিআর পরীক্ষা এবং সংক্রমিত ব্যক্তির কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সরকারের বহুমুখী সিদ্ধান্তের ফলে করোনার সংক্রমণ তেমনভাবে বৃদ্ধি না পেলেও এক সপ্তাহ ধরে যেভাবে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেটি সবার জন্য একটি ভয়ের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

স্বভাবতই যে প্রশ্নটি সবার মধ্যে আলোচিত হচ্ছে সেটি হলো দেশে করোনা পরিস্থিতি প্রায় তিন মাস নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকলেও হঠাৎ খারাপ হচ্ছে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, পৃথিবীব্যাপী ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের যে তাণ্ডব শুরু হয়েছে তার প্রভাব থেকে বাংলাদেশ মুক্ত থাকতে পারবে না। এটাই স্বাভাবিক। সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের ফলে এতদিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও আবার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, গত ৩ মাস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকায় জনগণের মধ্যে সুরক্ষাবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে উদাসীনতা লক্ষ করা গেছে। মানুষ যেভাবে গণপরিবহনে গাদাগাদি করে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছে, মাস্ক পরা থেকে বিরত থাকছে এবং সামাজিক দূরত্ব না মেনে চলাচল করছে, তাতে খুব স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, যেকোনও সময় এই পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে পারে।

আমরা জানি, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট যে ধরনের ভয়াবহতা সৃষ্টি করতে পারে সেই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে ওমিক্রনের সংক্রমণ ছাড়াই পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যেতে পারে। কয়েক দিন আমরা সংক্রমণের যে ধারা প্রত্যক্ষ করেছি তা সত্যিই বিপজ্জনক হতে পারে। রোগীর সংখ্যা ইতোমধ্যে ১০০০ পেরিয়েছে। প্রতিদিনের সংক্রমণের হার প্রায় পাঁচ শতাংশের কাছাকাছি। এই ধারা চলতে থাকলে দুই সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি গত বছরের মতো খারাপ হয়ে যাবে- তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

আমরা জানি করোনাভাইরাস উচ্চ সংক্রমণশীল একটি ভাইরাস। এটি শুধু বিধিনিষেধ আরোপের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক সুপারিশকৃত করোনা সুরক্ষাবিধি (অর্থাৎ ঘন ঘন হাত ধোয়া, মাস্ক পরা এবং তিন ফিট দূরত্ব বজায় রাখা) মেনে চলার মাধ্যমে এর সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।  আবার যখন সংক্রমণ চূড়ায় পৌঁছে তখন লকডাউনের মাধ্যমেও সংক্রমণ কমানো যায়। দুই বছর ধরে বিভিন্ন দেশে লকডাউন বাস্তবায়িত হয়েছে। এমনকি আমাদের দেশেও ২০২০ এবং ২০২১ সালে কয়েক মাস লকডাউন বাস্তবায়িত হয়েছে। লকডাউনের মাধ্যমে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সফল হলেও এর নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে মানুষের জীবন-জীবিকার ওপরে।

আমরা জানি বাংলাদেশের একটি বড় জনগোষ্ঠী তাদের দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল। লকডাউন দিলে এই জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা ব্যাহত হয়।  লকডাউনকালে সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে এই শ্রেণিকে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দিতে। একই সঙ্গে বিভিন্ন বেসরকারি উদ্যোগে এই জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করা হয়েছে।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ সবে নতুন উদ্যমে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করা শুরু করেছিল। করোনায় বিভিন্ন দেশের জিডিপি যখন ৩ শতাংশের নিচে রয়েছে, তখন বাংলাদেশে সরকারের নানামুখী সিদ্ধান্তে তা ৬ শতাংশের ওপরে। এটা ছিল অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক। বাংলাদেশ সরকার এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার মতে,  ২০২২ সালে বাংলাদেশের জিডিপি হবে ৬  শতাংশের ওপরে। এই মুহূর্তে করোনার তৃতীয় ঢেউ যদি আবার আঘাত হানে, তবে তা শুধু স্বাস্থ্য ঝুঁকিই বাড়াবে না, অর্থনীতি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ কারণেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের পাশাপাশি জনগণের সচেতন হওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

যেকোনও অতিমারি নিয়ন্ত্রণের দায় শুধু সরকারের না।  দায়িত্বশীল হিসেবে সবার দায়িত্ব রয়েছে আচরণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সমস্যা উত্তরণের চেষ্টা করা। মানুষ যদি তাদের আচরণ পরিবর্তন না করেন, সুরক্ষাবিধি মেনে না চলেন, তাহলে  শিগগিরই ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে।

এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় জনগণের সচেতনতা। সরকার বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা করেছে।  শুধু কর্মসূচি বাস্তবায়ন করলে হবে না, জনগণকে সেই বার্তা গ্রহণ করে আচরণ পরিবর্তন করতে হবে। আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এটা করা না গেলে করোনার তৃতীয় ঢেউ বাংলাদেশে আঘাত হানবে। সংক্রমণের হার যদি বৃদ্ধি পায় তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
আসুন, নিজেদের আচরণ ও চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করি, করোনা সুরক্ষাবিধি মেনে চলি। দেশ ও জাতিকে অতিমারির ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করি।

লেখক: অধ্যাপক, লোক-প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ