X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘শো মাস্ট গো অন’

প্রভাষ আমিন
২৪ জুন ২০২২, ১৮:০৭আপডেট : ২৪ জুন ২০২২, ১৮:০৭

অবস্থানগত কারণেই বাংলাদেশে প্রতিবছর বন্যা হয়। বাংলাদেশের অবস্থান ভাটিতে, উজানের পানি বাংলাদেশের ওপর দিয়েই বঙ্গোপসাগরে যাবে। বন্যা ঠেকানোর কোনও উপায় নেই। চেষ্টা করতে হবে, বন্যার পানি যাতে লোকালয়ে কম ঢুকতে পারে বা ঢুকলেও তা যেন দ্রুত সরে যেতে পারে। নিয়মিত স্বাভাবিক বন্যা বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ। নিয়মিত বন্যা হয় বলেই আমরা এখনও খেয়ে-পরে বাঁচতে পারছি। বন্যার পানির সঙ্গে আসা পলিমাটি আমাদের জমিকে আরও উর্বর করে। এইটুকু দেশের জমি থেকেই আসে ১৮ কোটি মানুষের খাবার। বহুল উত্তোলনের ফলে আমাদের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায়। বন্যা আর বৃষ্টিতে আবার সেটা রিফিল হয়ে যায়।

তবে এই আশীর্বাদের বন্যা কখনও কখনও অভিশাপ হয়ে যায়। বানের পানি যখন ভাসিয়ে নিয়ে যায় সবকিছু, মানুষ তখন অসহায় হয়ে যায়। এমনিতে ১০-১২ বছর পর পর একটা বড় বন্যার কথা বলেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতে প্রকৃতির ক্যালেন্ডারও লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। এখন হুটহাট বন্যা এসে ভাসিয়ে নেয় সবকিছু। আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা দাউদকান্দির বন্যাপ্রবণ প্লাবনভূমিতে। বন্যার সঙ্গেই আমাদের নিত্য বসবাস। তবে আমার স্মৃতিতে সবচেয়ে বড় বন্যা ১৯৮৮ সালে। তখন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এক মাসেরও বেশি সময় পানিতে ডুবেছিল, বন্ধ ছিল সব ধরনের সড়ক যোগাযোগ। আমাদের বাড়ি একদম মহাসড়কের পাশে। আমাদের বাড়ির পাশেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে একটি ব্রিজ আছে। সেই ব্রিজ এবং সংলগ্ন অল্প একটু জায়গাই ছিল মাটি, আর আশপাশের সবকিছু ডুবে গিয়েছিল। আমরা ছেলে-বুড়োরা সারা দিন গাদাগাদি করে ওই ব্রিজে আড্ডা মারতাম আর আশপাশের দুর্গত মানুষের খোঁজ-খবর নিতাম। তবে একেবারে ছেলেবেলায়, সম্ভবত ৭৪ সালের বন্যার স্মৃতি শুধুই আনন্দের। বন্যার দুঃখ, কষ্ট, দুর্ভোগ, ঝুঁকি বোঝার বয়স তখনও হয়নি। তখন শুধু খাটে বসেই পানি ধরা যাচ্ছে, এই আনন্দেই বিভোর ছিলাম।

বাংলাদেশে এবারের চেয়ে বড় বন্যা আরও হয়েছে, ৮৮ সালে তো ঢাকাও ডুবে গিয়েছিল। তবে এটা মানতেই হবে, সিলেট অঞ্চলে এবারের চেয়ে ভয়াবহ বন্যা আর কখনও হয়নি। প্রবীণদের স্মৃতিতে নেই। হাওরাঞ্চলে প্রতিবছরই কমবেশি বন্যা হয়। গত কয়েক বছর ধরে হাওরের দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি পর্যটকদেরও টানছে। দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি যতটা মোহনীয়, বিপদসীমা পেরুলে সেটা ততটাই ভয়ংকর। আর এবার তো বিপদের সব সীমাই ছাড়িয়ে গিয়েছিল। শ’তিনেক পর্যটকও আটকা পড়েছিল বন্যায়। নানাভাবে তাদের উদ্ধার করা গেলেও সুনামগঞ্জ আর সিলেটের দুর্গম এলাকায় আটকেপড়া সবাইকে উদ্ধার করা যায়নি। খেয়ে, না খেয়ে, চালের ওপর ঝুলে থেকে নাক ভাসিয়ে বেঁচে থাকার মতো টিকে ছিলেন অনেকে। সিলেটে বড় বন্যার পূর্বাভাস ছিল, তবে এত বড় বন্যা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। চেরাপুঞ্জিতে রেকর্ড বৃষ্টি সিলেটে রেকর্ড বন্যার কারণ হয়ে যায়। একপর্যায়ে সিলেট-সুনামগঞ্জের প্রায় পুরোটাই ডুবে যায়। সুনামগঞ্জ সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ট্রলারের ভাড়া ছাড়িয়ে যায় হেলিকপ্টারের ভাড়াকেও। সিলেটের সাথে বিমান ও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এমনিতে পানি দ্রুত এলে দ্রুত নেমে যায়। এবার সেটা হচ্ছে না। পানি কমছে খুব ধীরে।

হঠাৎ বন্যায় সবার মধ্যে একটা ভ্যাবাচ্যাকা ভাব সৃষ্টি হলেও দ্রুতই তা কাটিয়ে উঠেছেন সবাই। সারা দেশ দাঁড়িয়ে যায় সিলেটের পাশে। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে অঢেল ত্রাণের ব্যবস্থা হয়েছে। তবে এ ধরনের দুর্যোগে যেটা হয়, ত্রাণ বিতরণে ন্যায্যতা বজায় রাখা যায় না। শহরের আশপাশে বা বড় জোর সন্ধ্যার মধ্যে ফেরত আসা যাবে, এমন জায়গায় ত্রাণ পৌঁছায়, বারবার পৌঁছায়। কিন্তু ঝুঁকির কারণে দূরবর্তী স্থানগুলোতে ত্রাণকর্মীরা যেতেই পারেন না। তাই যাদের ত্রাণ সবচেয়ে বেশি দরকার, তারা পান সবচেয়ে কম। বিশেষ করে সুনামগঞ্জের অনেক এলাকা আছে, সাধারণ সময়েও যেখানে যেতে দিন পেরিয়ে যায়। তবে স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, সশস্ত্র বাহিনীর দেশপ্রেমিক সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুর্গম অঞ্চলে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। বেসরকারি ত্রাণ কর্মীদের অনেকেই তাদের ত্রাণসামগ্রী সেনাবাহিনীর হাতে দিয়ে নিশ্চিন্তে ফিরে গেছেন। তারা জানেন, সেনাবাহিনী সঠিক লোকটির হাতেই ত্রাণ পৌঁছে দেবে।

শুরুর দিকে অতিরিক্ত ট্রলার ভাড়া, দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া, ডাকাতির মতো কিছু অমানবিকতার গল্প শুনলেও শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছে মানবিকতারই। চট্টগ্রামের মানুষ ত্রাণ নিয়ে ছুটে গেছেন সুনামগঞ্জে। দুর্যোগ এলেই আমরা আমাদের অন্তর্নিহিত শক্তিটা টের পাই। মানুষের শক্তিতেই আমরা বারবার ঘুরে দাঁড়াই।

সিলেটের নজিরবিহীন বন্যা নিজ চোখে দেখতে ছুটে গেছেন প্রধানমন্ত্রী। স্থানীয় প্রশাসন, সশস্ত্র বাহিনী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও কাজ করছেন। কিন্তু আগেও যেমনটি বলেছি, পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী থাকলেও বিতরণ ব্যবস্থাপনাটা ত্রুটিমুক্ত ছিল না। অনেক জায়গায় অবশ্য স্থানীয় প্রশাসনও বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তবে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, দুর্যোগ যত ভয়াবহ, রাজনীতিবিদদের উপস্থিতি ততটা নয়। বৃহত্তর সিলেটের মন্ত্রী-এমপিদের জলভাসি মানুষের পাশে খুব একটা দেখা যায়নি। এই সমস্যা অবশ্য নতুন নয়। অনেক বছর ধরে সরকার অনেক বেশি আমলানির্ভর, রাজনীতিবিদরা রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে দূরেই থাকছেন। সে সমস্যা ভিন্ন। ত্রাণ আছে; এখন নিশ্চিত করতে হবে, যাদের দরকার তারা সবাই যেন ত্রাণ পান।

বৃহত্তর সিলেটসহ উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলা যখন বন্যাকবলিত; তখন আমাদের মর্যাদার প্রতীক পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মাহেন্দ্রক্ষণ দোরগোড়ায়। রাত পোহালেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবার জন্য খুলে দেবেন তাঁর একক সিদ্ধান্তে নিজেদের অর্থে বানানো পদ্মা সেতু। এই মাহেন্দ্রক্ষণ উদযাপনে সরকার ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে তো বটেই, দেশজুড়ে বিষয়টি উদযাপনের আয়োজন চলছে অনেক দিন ধরেই। হঠাৎ বন্যা সেই আনন্দ আয়োজনে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। পদ্মা সেতুর উৎসবমুখর উদ্বোধনই হবে, তবে বন্যাকবলিত জেলাগুলোয় কোনও আয়োজন থাকবে না। অনেকে দাবি করছেন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধন বন্ধ করে সেই অর্থ বন্যাদুর্গতদের মাঝে বিতরণ করার। ফেসবুকে এমন উদ্ভট দাবি দেখি। নিজেদের টাকায় বানানো হলে পদ্মা সেতুতে টোল দিতে হবে কেন, এমন উদ্ভট আবদারও ভেসে বেড়ায় ফেসবুকে। সরকার পরিচালনা সম্পর্কে যাদের সাধারণ ধারণা আছে তারা বুঝবেন, পদ্মা সেতু বানানোর জন্য সেতু মন্ত্রণালয় অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে টাকা ধার করেছে। এখন টোলের টাকায় সেতু মন্ত্রণালয় অর্থ মন্ত্রণালয়কে ঋণ শোধ করবে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনে জমকালো আয়োজন করছে সেতু মন্ত্রণালয়। এখন উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বাতিল বা স্থগিত করলেই কি সেই টাকাটা বন্যার্তদের দেওয়া সম্ভব?

কমনসেন্স বলে, সম্ভব নয়। বন্যার্তদের ত্রাণ দেওয়ার জন্য ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়’ নামে আলাদা একটি মন্ত্রণালয় আছে। সেই মন্ত্রণালয়ের আলাদা বাজেট আছে, প্রয়োজনে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো যেতে পারে। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা যেতে পারে। কিন্তু সেতু মন্ত্রণালয়ের অর্থ তো আর বন্যার্তদের জন্য ব্যয় হবে না। ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পারফরম্যান্সের সমালোচনা হতে পারে, যথার্থভাবে ত্রাণ বিতরণ করতে না পারাটা অবশ্যই তাদের ব্যর্থতা, অদক্ষতা। কিন্তু ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতায় তো সেতু মন্ত্রণালয়ের এতদিনের এত আয়োজন থেমে যেতে পারে না। পারফরম্যান্স জগতে একটা কথা প্রায়ই শুনি- শো মাস্ট গো অন। যত বেদনাই আসুক, জীবন থেমে থাকে না। সিলেট-সুনামগঞ্জসহ বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণকাজ চলুক আরও দক্ষতার সাথে, সমন্বিতভাবে। তবে গোটা জাতির স্বপ্ন হয়ে ঝলমল করে হেসে উঠুক স্বপ্নের পদ্মা সেতুও।

লেখক: সাংবাদিক

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
রবিবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
রবিবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
চুয়াডাঙ্গায় ৪২ পেরোলো তাপমাত্রা, জনজীবনে হাঁসফাঁস
চুয়াডাঙ্গায় ৪২ পেরোলো তাপমাত্রা, জনজীবনে হাঁসফাঁস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ