X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোটরসাইকেল: সম্ভাবনা না সংকট

প্রভাষ আমিন
০৭ জুলাই ২০২২, ১৯:৫৯আপডেট : ০৭ জুলাই ২০২২, ২০:২৭

একসময় মোটরসাইকেল ছিল নায়কের বাহন। নায়ক সাঁই সাঁই করে মোটরসাইকেল চালাচ্ছে, বাতাসে তার চুল উড়ছে, পেছনে বসে আছে নায়িকা–একসময় বাংলা সিনেমার খুব পরিচিত দৃশ্য ছিল এটি। কিন্তু এখন মোটরসাইকেল নিজেই খলনায়কে পরিণত হয়েছে যেন। ঢাকা শহরের রাস্তায় মহাউৎপাতের নাম মোটরসাইকেল। ঢাকার রাজপথে মোটরসাইকেলের উৎপাত দেখলে মনে হতে পারে, তাদের জন্য কোনও আইন-কানুন নেই। যেদিক দিয়ে পারছে, সেদিক দিয়েই মোটরসাইকেল চলছে। মোটরসাইকেল চালকদের দাপটে ফুটপাতে হাঁটার জো নেই। কয়েক বছর আগে ঢাকার পূর্বাচলের ৩০০ ফুট সড়ক মোটরসাইকেল চালকদের ফ্রি রাইডের রাস্তা হয়ে উঠেছিল।

বাইকাররা দলবেঁধে বেপরোয়া মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটতো। অনেকবার এমন হয়েছে, দলবদ্ধ বাইকারদের মহড়া থেকে বাঁচতে নিজের গাড়ি রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে তাদের যাওয়ার সুযোগ দিয়েছি। মোটরসাইকেল নিয়ে কত রকমের ক্যারিকেচার সম্ভব, তার দৃশ্যায়ন দেখা যেতো ৩০০ ফুট সড়কে। এ যেন লাইভ সার্কাস বা সিনেমার দৃশ্য। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে চালুর পর ৩০০ ফুটের দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হতে থাকে সেখানে।

এটা মানতেই হবে, গত কয়েক বছরে দেশে মোটরসাইকেলের উৎপাত বেড়েছে। বাড়তে বাড়তে যখন তা সীমা ছাড়িয়ে গেছে, তখন সরকারের টনক নড়েছে। এখন নানাভাবে সরকার মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। চালুর দিনেই পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুজনের মৃত্যুর পরদিন থেকে সেতুতে মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ঈদের আগের ও পরের মোট ৭ দিন মহাসড়কে মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখন প্রজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে, মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশনের জন্য মালিকের ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকতে হবে। সরকারের সব সিদ্ধান্তের পক্ষেই যুক্তি আছে। তবে যুক্তিটা যেন মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার মতো।

মোটরসাইকেল চালকদের চার ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগ, ধনাঢ্য পরিবারের উঠতি বয়সী সন্তানের আবদার মেটাতে কিনে দেওয়া মোটরসাইকেল। এটা খুব দরকারি নয়। স্রেফ হিরোইজম দেখানো, মাস্তানি করা, বেপারোয়া গতিতে চালানো, মানুষকে বিরক্ত করাই এই চালকদের লক্ষ্য। দ্বিতীয় ভাগের চালকরা মোটরসাইকেলকে নানা অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করেন। চুরি, ছিনতাই, অপরাধ করে দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও মোটরসাইকেলের জুড়ি নেই। রাজনৈতিক কাজেও মোটরসাইকেলের বহুল ব্যবহার হয়ে থাকে। আরেক ভাগ মানুষ আছেন, যারা পারিবারিক বাহন হিসেবে মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন। ঢাকার যানজট এড়িয়ে দ্রুত অফিস করা, পারিবারিক কাজে ব্যবহার করা এই মোটরসাইকেল চালকরা সাধারণত নিয়ম মেনে সাবধানে চলাচল করেন। তবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে রাইড শেয়ারে মোটরসাইকেলের ব্যবহার চালুর পর। প্রয়োজন সকল উদ্ভাবনের চাবিকাঠি। ঢাকার অসহনীয় যানজটে নাকাল মানুষ মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ার সেবা চালুর পর যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। সময় বাঁচাতে অনেকেই এই সেবা গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। বিত্তশালী লোকেরাও অনেক সময় জরুরি কাজে নিজের গাড়ি ফেলে রাইড শেয়ারের মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন। ঢাকায় কর্মজীবী নারীরাও এখন অনায়াসে অপরিচিত বাইকারের বাইকে চড়ে গন্তব্যে যান। নির্দিষ্ট অ্যাপসের মাধ্যমে রাইড শেয়ার নিয়ন্ত্রণের কথা থাকলেও আমরা দ্রুতই ডিজিটাল এই সেবাকে অ্যানালগ বানিয়ে ফেলেছি। রাস্তার মোড়ে মোড়ে এখন রিকশার মতোই মোটরসাইকেলের জটলা থাকে। তারা খদ্দের ধরার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমে ডাকাডাকি করে।

নগরবাসীকে স্বস্তি দিয়েছে যে রাইড শেয়ারের মোটরসাইকেল, সেই মোটরসাইকেলের চাপেই এখন ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ার দশা।

দুই চাকার একটি মোটরসাইকেল এখন অনেক মানুষের রুটি-রুজি। রাইড শেয়ারিং করে সংসার চালান অনেকে। ছাত্ররাও আগের মতো টিউশনির পেছনে না ছুটে পার্টটাইম মোটরসাইকেল চালিয়ে আয় করেন। মোটরসাইকেল এখন অনেকের পেশা। করোনায় ব্যবসা বা চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে যাওয়া অনেকে কোনোরকমে একটা মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছেন; তাতেই রুটি, তাতেই ভাত।

ঈদের সময় মোটরসাইকেলে শত মাইল পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফেরার ঘটনা আগেও ঘটেছে। তবে রাইড শেয়ার চালুর পর বাড়ি ফিরতে মোটরসাইকেলের ব্যবহার দ্রুত বাড়তে থাকে। পরিবারের সবাইকে আগেভাগে বাড়ি পাঠিয়ে শেষ মুহূর্তে বাড়ি ফেরার জন্য রাইড শেয়ার ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছিল। তবে গত ঈদে মহাসড়কে মোটরসাইকেলের দাপটে সবার টনক নড়ে। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুতে হাজার হাজার মোটরসাইকেলের সারি বা কোনও কোনও ফেরিতে শুধু মোটরসাইকেল পারাপারের ছবি নীতিনির্ধারকদের ভাবনায় ফেলে। তবে ভাবনাটা শঙ্কায় পরিণত হয়, ঈদের সময় মহাসড়কে দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান। ঈদুল ফিতরের পর রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের এক রিপোর্টে দেখা যায়, গত ঈদে অন্তত ২৫ লাখ মানুষ মোটরসাইকেলে বাড়ি ফিরেছে। তবে সবাই নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারলে তো কথাই ছিল না। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ঈদের সময় মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ৪১‌ ভাগই মোটরসাইকেল আরোহী।

গত ঈদের সময় ১২৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫৬ জন মারা গেছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের আরেক রিপোর্টে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে মানে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার ৪০ ভাগ মৃত্যুর দায় মোটরসাইকেলের।

এই পরিসংখ্যান দেখার পর আমি ঈদের সময় মহাসড়কে মোটরসাইকেল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তকে অবশ্যই স্বাগত জানাচ্ছি। বাইকাররা নানাভাবে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। সরকারের এই সিদ্ধান্ত কিন্তু বাইকারদের জীবন বাঁচানোর জন্যই। আগে তো জীবন, তারপর জীবিকা, প্রয়োজন, চাহিদা ইত্যাদি। তবে আগেই বলেছি, পদ্মা সেতুতে এবং ঈদের সময় মহাসড়কে মোটরসাইকেল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার মতো। মাথা ব্যথার ওষুধ দিতে হবে, মাথা কেটে ফেলা কোনও সমাধান নয়। দুর্ঘটনা তো বাসেও হয়, লঞ্চেও হয়, ট্রেনে হয়, বিমানে হয়। তাই বলে তো সব বন্ধ করে দিয়ে ঘরে বসে থাকলে হবে না। বলা হচ্ছে, স্পিডগান এবং সিসিটিভি বসানোর পর পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চালানোর অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। শুধু পদ্মা সেতু নয়, দেশের সব মহাসড়কেই স্পিডগান বসাতে হবে, সিসিটিভি বসাতে হবে, হাইওয়ে পুলিশের টহল বাড়াতে হবে। হেলমেট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। মোটরসাইকেলে দুজনের বেশি মানুষ বহন নিষিদ্ধ করতে হবে। ঢাকায় প্রয়োজনে মোটরসাইকেলের জন্য আলাদা লেন করতে হবে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজাতে হবে। ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থাকে উন্নত করতে হবে। কেউ তো আর শখ করে ঝুঁকি নিয়ে মোটরসাইকেলে চড়ে না। যতদিন পর্যাপ্ত গণপরিবহন নিশ্চিত করা না যাবে, ততদিন কোনও আইন করেই মোটরসাইকেলের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। 

পদ্মা সেতুতে চালুর দিন কয়েক হাজার মোটরসাইকেল গেছে। তার মধ্যে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে একটি। এই একটি দুর্ঘটনার কারণেই বন্ধ হয়ে গেছে মোটরসাইকেল। তেমনই অল্প কিছু বাইকার হয়তো বেপরোয়া চালান। কিন্তু তাদের জন্য ভুগতে হয় সবাইকে। তাই ট্রাফিক আইন মেনে চলা, গতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, হেলমেটসহ সব ধরনের নিরাপত্তা গিয়ার ব্যবহার নিশ্চিত করেই মোটরসাইকেলকে নিরাপদ বাহনে পরিণত করতে হবে। এটা বুঝতে হবে, অল্প কয়েকজনের জন্য মোটরসাইকেল হয়তো শখ। অধিকাংশের জন্যই কিন্তু মোটরসাইকেল প্রয়োজন, অনেকের জন্য পেশা। সম্ভাবনার মোটরসাইকেলকে যেন আমরা সংকটে পরিণত না করি।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সবজির বাজার ঊর্ধ্বমুখী, তীব্র গরমকে দুষছেন বিক্রেতারা
সবজির বাজার ঊর্ধ্বমুখী, তীব্র গরমকে দুষছেন বিক্রেতারা
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কথা না বলতে আদালতের নির্দেশ
ইমরান খান ও বুশরা বিবিরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কথা না বলতে আদালতের নির্দেশ
বিতর্কিত আউটের ছবি পোস্ট করে মুশফিক লিখলেন...
বিতর্কিত আউটের ছবি পোস্ট করে মুশফিক লিখলেন...
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ