X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

মূল্যস্ফীতি ও বাণিজ্যের ভারসাম্যহীনতা

প্রণব মজুমদার
১১ জুলাই ২০২২, ১৬:৩৮আপডেট : ১৭ আগস্ট ২০২২, ১৬:২৫

সরকার সবই পারে কিন্তু বাজারে হারে! ক্রমবর্ধমান পণ্য বাজারের মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি কলামে এমন মন্তব্য করেছেন সাংবাদিক এক নেতা। ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী জ্যেষ্ঠ সেই সাংবাদিক নেতা বাজারে গিয়ে দ্রব্যের উচ্চমূল্য দেখে বিস্মৃত হয়েছেন। অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাওয়া নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের সেই সকরুণ চিত্র তুলে ধরেছেন জাতীয় একটি দৈনিকের মতামত কলামে। 

আমিও তা-ই বলি– সরকার বাজারে হারে। বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকার ব্যর্থ। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সদস্য, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, খাদ্য অধিদফতর, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশসহ (টিসিবি) অন্যান্য দফতর বাজার নিয়ন্ত্রণে ঠুঁটো জগন্নাথ। ক্রেতার স্বার্থরক্ষায় এসব প্রতিষ্ঠান নিয়মিত বাজার মনিটরিং করে না বলেই বাজার অস্থিতিশীল থাকে। যার প্রভাব মূল্যস্ফীতিতে আমরা দেখতে পাই। অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেশন দেশে কোনও সরকারই ভাঙতে পারেনি। বাজার অস্থিতিশীল করায় গোষ্ঠীবদ্ধ মজুতদার হোতাদের জরিমানা ছাড়া দৃষ্টান্তমূলক বিচার এ দেশের জনগণ কোনোদিন দেখেনি। 

এর অন্যতম একটি কারণ দলীয় প্রভাব, নিয়োজিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অনিয়ম ও দুর্নীতি। প্রধানমন্ত্রী ব্যবস্থা গ্রহণে সচল হলে কিছু দিন সংশ্লিষ্ট দফতরের নিয়োজিত লোকজন নড়েচড়ে বসেন। তারপর সেই আগের অবস্থা! আমার মতো সীমিত আয়ের ব্যক্তি যারা নিয়মিত বাজার করেন, তারা বোঝেন ঘর্মাক্ত শরীরের অতিরিক্ত মন যন্ত্রণা। ১০ টাকা মূল্যের নিচে কোনও খাদ্যপণ্য নেই। রাস্তার ভিক্ষুক রুটি খাবে বলে এখন ২০ টাকা চায়!

মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। গত মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৪২ শতাংশে। এপ্রিল মাসে এই হার ছিল ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ।

১৯ জুন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মে ’২২ মাসের সার্বিক মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে এক মাসের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতির এত বড় উল্লম্ফন গত কয়েক বছরে দেখা যায়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে তাতে মুদ্রা সংকোচনের ওপর নজর দেওয়ার কথা বলেছে। মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের নিচে রাখা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। বিশ্ব অর্থনীতির বার্ষিক সার্বিক গড় মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের অধিক বিষয়টি মাথায় রেখে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিবেচনায় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ শতাংশের কম হবে না বলে ধারণা। আমাদের দেশের বাজার অর্থনীতিতে কোনও পণ্যের দাম বাড়লে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অর্থাৎ আমদানি শুল্ক কমিয়ে পণ্য সরবরাহ বৃদ্ধি করলেও মূল্য হ্রাসে খুব একটা প্রভাব পড়ে না। জনগণ উপকৃত হওয়ার বদলে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা বেশি লাভবান হন।

যদিও বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোতে জ্বালানি, খাদ্যপণ্যের দাম ও জাহাজ ভাড়া বেড়ে গেছে। ফলে প্রায় সকল দেশেই মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধিতে অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে বিশ্ব বাণিজ্যের টালমাটাল অবস্থা! বিশ্ব বাণিজ্যের বিরাজমান সংকট উত্তরণে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, যুক্তরাজ্য বৈঠকে বসেছে।

বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ ৩৯ দশমিক ১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি দেখা যাচ্ছে চীনা ঋণের ভারে জর্জরিত দেশ শ্রীলঙ্কায়। অন্য দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানে ১৩ দশমিক ৮, ভারতে ৭ দশমিক ৭৯, নেপালে ৭ দশমিক ২৮, ভুটানে ৫ দশমিক ৫৭, আফগানিস্তানে ১ দশমিক ৫৬ ও মালদ্বীপে ১ দশমিক ২ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ২ দশমিক ৩ ও চীনে ২ দশমিক ১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি চলছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মূল্য প্রভাব আমদানিনির্ভর দেশের অর্থনীতির মূল্যস্ফীতিতে যুক্ত হবেই।

ক’দিন আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট পাস হয়ে গেলো। অর্থমন্ত্রী বাজেটকে কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন বলে আখ্যা দিয়েছেন।

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি রাখা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এর পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বাজেট ঘাটতি বাড়ছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ রফতানির চেয়ে আমদানির পরিমাণ বেড়ে যাবে।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২২-এর প্রকাশিত পরিসংখ্যানে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যহীনতা লক্ষণীয়। প্রদত্ত উপাত্তে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরের ৮ (জুলাই- ফেব্রুয়ারি) সার্বিক লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২২৩০৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। একই সময়ে ঘাটতি আগের অর্থবছরে ছিল ১২৩৫৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। রফতানি আয় বৃদ্ধির চেয়ে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় এ বাণিজ্য ঘাটতি!

বিশ্ব অর্থনীতির পরিস্থিতি ভালো না হলে আমাদের অর্থনীতিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এটাই স্বাভাবিক। দেশে মার্কিন ডলারের মূল্য বাড়ছে। প্রতি ডলারের ক্রয়মূল্য দাম ১০০ ছুঁই ছুঁই করছে।

রফতানিনির্ভর দেশ হলে টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য বৃদ্ধির সুফল আমরা পেতাম। কিন্তু রফতানির চেয়ে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বেশ চাপ রয়েছে। তাছাড়া বিদেশি ব্যাংকে অসাধু ব্যবসায়ীদের অর্থপাচারের আশঙ্কা তো আছেই।

সরকারের অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ে কঠোর হওয়ার সাম্প্রতিককালের সিদ্ধান্ত প্রশংসাযোগ্য। যেসব দ্রব্য দেশে উৎপাদিত হয় তা আমদানি না করার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তও সময়ের দাবি। যদিও আগে তা নেওয়া উচিত ছিল।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বড় অবদানের শক্তি দেশের বৃহত্তম পদ্মা বহুমুখী সেতু আমাদের বাণিজ্য প্রসারে গতি সঞ্চার করবে নিঃসন্দেহে। প্রত্যাশা করতেই পারি এই সেতু জিডিপিতে ১ দশমিক ২ শতাংশ হারে অবদান রাখবে।

আশার কথা, প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স কমলেও রফতানি আয়ে রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ে শেষ হলো ২০২১-২২ অর্থবছর। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে ৫ হাজার ২০৮ কোটি ২৬ লাখ (৫২.০৮ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক আগের বছরের (২০২০-২১) চেয়ে ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক বছরে পণ্য রফতানি থেকে এত বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে আসেনি। হালনাগাদ এ উপাত্ত রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি)।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি, করোনার চতুর্থ ওয়েভ, ইউক্রেন-রাশিয়া চলমান যুদ্ধ, বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি আমাদের উন্নয়নের ধারাকে ব্যাহত করতে পারে আগামীতে!

দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য রফতানি বাণিজ্যই অন্যতম শক্তি। যেসব পণ্য আমাদের দেশে উৎপাদন হয় সেসব দ্রব্য উৎপাদকের শিল্প প্রসারে তাদের সরকারি সহযোগিতা বাড়িয়ে অপ্রয়োজনীয় পণ্য ও বিলাসবহুল দ্রব্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত করতে হবে।

বিগত বছরগুলোতে আমরা লক্ষ করেছি দেশের বাইরে অপ্রচলিত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা। এসব পণ্য যেমন টুপি, পরচুলা, চালের কুড়া, সবজি, মাছ, গরুর নাড়ি ভুড়ি, কাঁকড়া, কুঁচিয়া, মাস্ক, গ্লাভস ও গাউন ইত্যাদি অপ্রচলিত পণ্য রফতানিতে আরও নজর দিতে হবে। যদিও সরকার অপ্রচলিত পণ্য রফতানিকারকদের প্রণোদনা দেওয়ার কথা ভাবছে। বিদেশে অবস্থিত দেশের দূতাবাসগুলোর বাণিজ্য উইং রফতানির নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি পরিকল্পনা মাফিক উদ্যোগ নিতে হবে। দেশ প্রেমের কথা বিবেচনায় রেখে রফতানি বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা যেন দেশেই পুনরায় বিনিয়োগ হয় সেদিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে তৎপর ও উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। আর বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত তদারকির পাশাপাশি ন্যায্য মূল্যে বেশ কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ভোক্তাদের সরবরাহে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। বিদেশে অর্থ পাচার রোধ, বাজার ব্যবস্থাপনায় সিন্ডিকেট ভাঙতে যেমন হবে তেমনি দেশ অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির স্বার্থে দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন নীতি অনুসরণে সরকারকে হার্ডলাইনে যাওয়ারও পরামর্শ দেই।

লেখক: অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও সাহিত্যিক

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/এমএম/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ