X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিমানবন্দর ঠিক হবে কবে?

আমীন আল রশীদ
১৯ জুলাই ২০২২, ১৮:০৬আপডেট : ১৯ জুলাই ২০২২, ১৮:০৬

মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) বাংলা ট্রিবিউনের একটি খবরের শিরোনাম: ‘বিয়ে করতে দেশে এলেন দুবাই প্রবাসী, লাগেজের মালামাল গায়েব।’ খবরে বলা হয়, মির্জা সেলিম নামে একজন দুবাই প্রবাসী বিয়ে করার জন্য এক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে এসেছেন গত ৮ জুলাই। বিয়ে উপলক্ষে বিদেশে কেনা নানা জিনিসপত্রে ভর্তি ছিল লাগেজ। কিন্তু ঢাকায় হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে সেই লাগেজ খুঁজে পাননি। চার দিন পর লাগেজ ফিরে পেলেও প্রায় ১০ কেজি ওজনের জিনিসপত্র গায়েব।

দেশের প্রধান বিমানবন্দরে যাত্রীদের লাগেজ খোয়ানোর ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এ রকম ভুক্তভোগীর সংখ্যা অনেক। অনেকে দেনদরবার করে লাগেজ ফিরে পেলেও মালামাল পান না। অনেকে লাগেজও পান না।

মূলত বিমানবন্দরের লাগেজ বেল্ট থেকেই এসব লাগেজ হাওয়া হয়ে যায়। কারা চুরি করেন, সেটাও গোপন কিছু নয়। লাগেজ চুরির দায়ে কারও চাকরি গেছে বা বড় ধরনের শাস্তি হয়েছে, এমনটা শোনা যায়নি। তবে বছর কয়েক আগে হয়রানির শিকার এক যাত্রীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিমানবন্দরের এক কর্মকর্তাকে ভ্রাম্যমাণ আদালত জরিমানা করেছিল। কখনও যাত্রীদের পুরো লাগেজ হাওয়া হয়ে যায়। কখনও লাগেজ কেটে মালামাল কেটে নেওয়া হয়। বেল্টে যাত্রীরা কাটা অবস্থায় লাগেজ পান। এরকম ঘটনাও ভূরি ভূরি।

গত ৩১ মে একাধিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে বাসায় গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা তৌহিদ হোসেন দেখেন তার লাগেজে থাকা লাখ টাকা গায়েব। এই বিষয়ে বাংলাদেশ বিমানসহ বিমানবন্দরের বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ দিয়েও নিজের খোয়া যাওয়া টাকা তিনি পাননি।

অভিযোগ আছে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রীদের হারানো মালামালের সন্ধান পাওয়ার পর সেগুলো যেই বিভাগের নিরাপত্তায় থাকে, তার ব্যবস্থাপনায়ও মারাত্মক অনিয়ম রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে। ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ বিভাগের স্টোর রুমের চাবি সংরক্ষিত জায়গায় না রাখায় অন্য বিভাগের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তা ব্যবহার করেন, যে কারণে সেখান থেকে মালামাল চুরির ঘটনা ঘটে বলে সন্দেহ করা হয়।

বাংলা ট্রিবিউনের খবর বলছে, সম্প্রতি ব্যাগেজ লেফট-বিহাইন্ড বেড়ে যাওয়ায় অসংখ্য যাত্রীকে এরকম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। সাধারণত বাজেট (লো কস্ট ক্যারিয়ার) এয়ারলাইন্সগুলোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যাগেজ লেফট-বিহাইন্ড হয়। বর্তমানে শুধু বাজেট এয়ারলাইন নয়, সব ধরনের এয়ারলাইনের ক্ষেত্রে ব্যাগেজ লেফট-বিহাইন্ড বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত। এরমধ্যে জাজিরা এয়ারওয়েজ, সালাম এয়ার, কাতার এয়ারওয়েজ, সৌদি এরাবিয়ান এয়ারলাইন্স, ফ্লাই দুবাই, এয়ার এরাবিয়া, ওমান এয়ার, গালফ এয়ার, কুয়েত এয়ারওয়েজের ক্ষেত্রে ব্যাগেজ লেফট-বিহাইন্ড বেশি হচ্ছে। কিন্তু বারবার এরকম ঘটনা ঘটলেও এর সমাধানে যে কার্যকর কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি, তার সবশেষ উদাহরণ দুবাসী প্রবাসী মির্জা সেলিম এবং আওয়ামী লীগ নেতা তৌহিদ হোসেন। তবে সংবাদ হয়নি, এরকম ঘটনা নিশ্চয়ই আরও আছে।

বলা হয়, একটি দেশের বিমানবন্দর হচ্ছে সেই দেশের ‘ফার্স্ট লুক’ অথবা মর্নিং শোজ দ্য ডে। অর্থাৎ সেই দেশটি কেমন, তার অনেকখানি বোঝা যায় সেই দেশের প্রধান বিমানবন্দরে পা দিয়ে। ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তারা যাত্রীদের সঙ্গে কী রকম আচরণ করেন; তাদের অপ্রাসঙ্গিক ও অসম্মানজনক প্রশ্ন করা হয় কিনা; প্রবাসী শ্রমিকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে পয়সা আদায় করা হয় কিনা; যাত্রী অনুপাতে ইমিগ্রেশনের বুথ সংখ্যা পর্যাপ্ত কিনা; লাগেজ বেল্টে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়; সেখানে শৃঙ্খলা কেমন; নিরাপত্তা, শুল্ক ফাঁকি ও চোরাচালান ইস্যুতে কাস্টমসের কর্মকর্তারা যাত্রীদের ব্যাগ তল্লাশির সময় কতটা আন্তরিক থাকেন; তল্লাশির নামে যাত্রীদের হয়রানি ও দুর্ভোগের চিত্র কেমন; একেকজন যাত্রীকে ক্লিয়ারেন্স দিতে কত সময় লাগে; লাগেজ বহনের জন্য পর্যাপ্ত ট্রলি আছে কিনা; ট্রলির জন্যও বিমানবন্দরের কর্মচারীরা পয়সা চায় কিনা, এমনকি টয়লেট কতটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন—সেটিও একটি বিমানবন্দরের আধুনিক ও যাত্রীবান্ধব হয়ে ওঠার অন্যতম শর্ত। এখন আমরা এই শর্তগুলো আমাদের জাতীয় বিমানবন্দরে গিয়ে মিলিয়ে দেখতে পারি।

ঢাকা বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে যাত্রীদের অপ্রাসঙ্গিক ও অসম্মানজনক প্রশ্ন করা; বিশেষ করে প্রবাসী শ্রমিকদের হেয় করে কথা বলার অভিযোগ বহু পুরনো। অথচ এই মানুষগুলোর পাঠানো অর্থেই দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। করোনার অতিমারিসহ বৈশ্বিক নানা সংকটের ভেতরেও দেশের অর্থনীতি যে একটা মোটামুটি স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে, সেখানে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বা রেমিট্যান্স অন্যতম প্রধান শক্তি। অথচ সেই রেমিট্যান্স যোদ্ধারাই দেশের মাটিতে পা রেখে বিমানবন্দরে নানাভাবে অসম্মানিত হন। এরপর বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে বাসায় যাওয়ার জন্য কোনও গণপরিবহন পান না। সিএনজি অটোরিকশা বা প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসগুলো তিন থেকে চারগুণ ভাড়া হাঁকে। তারাও বিদেশফেরত লোকজনের পকেট কাটার জন্য ওত পেতে থাকে। আবার এসব সিএনজি ও প্রাইভেটকারকে বিমানবন্দর থেকে যাত্রী নিয়ে যেতে নানা জায়গায় চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা দিতে না হলে তারা যাত্রীদের কম ভাড়ায় গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারতো। তার মানে শুধু বিমানবন্দরের ভেতরে হয়রানি ও অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা এবং চুরিই নয়, বরং বিমানবন্দরের বাইরেও যাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করে নানাবিধ অস্বস্তি।

স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছরের ডিসেম্বরে সংস্কারকাজের জন্য রাতে আট ঘণ্টা ফ্লাইট চলাচল বন্ধ রাখা হয় শাহজালাল বিমানবন্দরে। প্রথম দিনেই নানারকম বিশৃঙ্খলার খবর গণমাধ্যমে আসে। সোশাল মিডিয়া অনেকেই নিজেদের বিরক্তির কথা প্রকাশ করেন। টার্মিনালের ভেতরে–বাইরে, এয়ারলাইনসের চেক–ইন কাউন্টার, ইমিগ্রেশন থেকে বোর্ডিং ব্রিজ পর্যন্ত সবখানেই দেখা যায় বিশৃঙ্খলা, যাত্রীদের দীর্ঘ সারি। অনেক ফ্লাইট বিলম্বে ছাড়ে। কিছু যাত্রী ফ্লাইট ধরতে পারেননি বলেও জানা যায়।

ঢাকা বিমানবন্দরের একটি বড় সংকটের নাম ট্রলি। জায়গা মতো ট্রলি না পাওয়া, বিমানবন্দরে প্রবেশের জায়গা ছোট হওয়া এবং গাড়ি পার্কিং পর্যন্ত ট্রলি নিতে না দেওয়ায় অনেককে মাথায় করে লাগেজ বয়ে নিতে হয়। এরকম অদ্ভুত দৃশ্য পৃথিবীর আর কোনও বিমানবন্দরে দেখা যায় কিনা সন্দেহ।

নজরুল ইসলাম নামে একজন প্রবাসী সাংবাদিকদের বলেন, ২৫ বছর কাতার, সৌদি আরব, ওমানে ছিলাম। কোনও দেশের বিমানবন্দরে এভাবে লাগেজ মাথায় তুলতে হয় না। নিজের দেশে এসে মাথায় তুলতে হয়। পার্কিংয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠবে, সেখানে ট্রলি নিলে কী সমস্যা এটাই বুঝতে পারছি না।

প্রশ্ন হলো, এর শেষ কোথায়?

সরকারের তরফে মাঝে মধ্যে নানা রকম পদক্ষেপের কথা শোনা যায়। যেমন গত মে মাসে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পরিদর্শন শেষে বিমান প্রতিমন্ত্রী এম মাহবুব আলী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, প্রয়োজন ছাড়া যাত্রীদের ইমিগ্রেশনে জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে না। তিনি বলেন, ২১ হাজার যাত্রী প্রতিদিন আসা-যাওয়া করে। এত সংখ্যক যাত্রীকে প্রশ্ন করা একদিনে সম্ভব নয়। যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন, কেবল তাদেরই করা হচ্ছে। বাকিরা যাত্রী কিনা, বিষয়টি ইমিগ্রেশন পুলিশ নিশ্চিত করবে। বিমান প্রতিমন্ত্রী বলেন, কাস্টমসের সঙ্গে কথা হয়েছে, যাতে সব যাত্রীর ব্যাগ চেক করা না হয়। কেবল তথ্যের ভিত্তিতে যাকে সন্দেহ হবে, তাকে চেক করা হবে এবং ১ থেকে ২ শতাংশ যাত্রীকে আলাদাভাবে নিয়ে চেক করতে হবে।

একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কর্মী সম্প্রতি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘প্রথম বিদেশে আসি ১৯৯৮ সালে। তখন যে ঢাকা এয়ারপোর্ট দেখেছিলাম সেটা স্পষ্ট মনে আছে। কী সুন্দর ছিমছাম ছিল পরিবেশ। কিন্তু এবার যে ঢাকা এয়ারপোর্ট পার হয়ে এলাম তা ২৩ বছর আগের থেকেও বহু খারাপ। এমন বিশৃঙ্খলা আমি মাছের বাজারেও দেখিনি। ট্রলি পেতে দৌড়াদৌড়ি, বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকতে ঠেলাঠেলি, লাইনে দাঁড়াতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি। সব মিলিয়ে এক অরাজক অবস্থা। একজন এসে বললো তাকে খুশি করলে সে ট্রলির ব্যবস্থা করবে, আরেকজন বললো টাকা দিলে সে কোভিড টেস্টের কাগজপত্রে সিল এনে দেবে। এমন সিলনির্ভর প্রশাসন পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে মনে হয় না। আমার ছেলেমেয়েরা এমন পরিস্থিতি দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। একসময় দেখলাম মেয়েটা ভয়ে কেঁদেও ফেলেছে। এই অবস্থার কি কখনও উন্নতি হবে না।’

প্রশ্নটি আমাদের সবারই।

একজন দায়িত্বশীল পিতা দেখছেন, দীর্ঘদিন পরে তার প্রিয় মাতৃভূমিতে প্রবেশের সময় বিমানবন্দরের অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা দেখে তার ছোট্ট মেয়েটি ভয়ে কাঁদছে। বিদেশের মাটিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই মেয়েটির মনে তার বাবার জন্মভূমি সম্পর্কে কী ধারণা তৈরি হলো? সে কি বড় হয়ে আর পূর্ব পুরুষের ভিটায় আসতে উৎসাহ বোধ করবে?

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি
কুমিল্লা শিক্ষা প্রকৌশল কার্যালয়ে ঠিকাদারকে মারধর২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ